দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের ঘাটতির বিষয়টি নতুন নয়। বিগত বছরগুলোতে এ নিয়ে সচেতন মহল থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিচারবর্হিভূত হত্যাকাÐ, গুম, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাব, মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতার সামাজিক নিরাপত্তা সূচকের ক্রমাবনতি নিয়ে অনবরত কথা বলা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারের মধ্যে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা রয়েছে। সরকারের মনোভাব এমন যে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সরকারের এ ধরনের অস্বীকার করার প্রবণতার মধ্যেই বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা এবং পত্র-পত্রিকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা এবং এর সংখ্যা কী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতি বছরের মতো হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালের ঘটনাবলীর পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটির ৬৪৩ পৃষ্ঠার ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে বাংলাদেশ অধ্যায়েরর শুরুতেই বলা হয়েছে, গোপনে গ্রেফতার, গুম-খুন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাÐের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত রয়েছে। এসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এসব গুরুততর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধর্ েদায়মুক্তি পেয়ে আসছে।
বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে, দেশি বা বিদেশি কোনো সংস্থা দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সরকারের পক্ষ থেকে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। অস্বীকার করে বলা হয়, তাদের প্রতিবেদন মোটেও সঠিক নয়। শঙ্কা এবং আশঙ্কার বিষয় এখানেই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান অস্বীকার করার কারণে সমস্যার সমাধান বা এসব অপকর্ম হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হচ্ছে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যারা জড়িত, তারা একদিকে যেমন প্রশ্রয় পেয়ে যায়, অন্যদিকে এক ধরনের দায়মুক্তিও পায়। ফলে তারা আরও দুর্বিনীত হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভীতিকর পরিস্থিতি বা জনগণকে ভীত রেখে কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী, তা এসব সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও সচেতন এবং সাধারণ মানুষের অজানা নয়। যারা ভুক্তভোগী তারা এবং তাদের এলাকার মানুষ আরও বেশি করে জানে। সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সরকারের পক্ষ থেকে তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সংস্থাটি নাকি সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ একটি দলের হয়ে কাজ করছে। অথচ দেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী, তা কারো অজানা নয়। তাদের অত্যন্ত টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। দেশের মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই বলেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সরকারবিরোধী নেতাকর্মী ও জঙ্গি সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। আদালতে তোলার আগে অনেককে দীর্ঘদিন ধরে গোপন আস্তানায় আটক রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে। আগের বছরগুলোতে যারা গুম হয়েছে, তাদের অনেকেই এখনো ফেরেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী মত ও সমালোচনা দমন করতে আইনকে অস্ত্র হিসেবে সরকার ব্যবহার করছে। সমালোচকদের শাস্তি দিতে ৫৭ ধারার জায়গায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে যে আইনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে তাতে আরও কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে যা তুলে ধরা হয়েছে, তা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কারো পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। মত প্রকাশের জায়গাটি যে অত্যন্ত সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে, তা বুঝতে অতি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও জানে, সরকার বিরোধী যে কোনো মতের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু আচরণ করে থাকে। প্রকাশ্যে না হোক, অপ্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রচÐ চাপ সৃষ্টি করা হয়।
দেশের বিভিন্ন খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন বা জরিপ যে পুরোপুরি সঠিক হবে, এমন ভাবা যেমন যৌক্তিক নয়, তেমনি একেবারে উড়িয়ে দেয়াও যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন ছাড়াও পত্র-পত্রিকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত যেসব ঘটনা প্রকাশিত হয়, সেগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। বলা যায়, সংস্থাগুলো পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন এবং তাদের নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। সরকারের উচিত, তথ্য দিয়ে তথ্য মোকাবেলা করা। বলা বাহুল্য, সরকারের চেয়ে ভাল তথ্য আর কেউ তুলে ধরতে পারবে না। সংস্থাগুলোর তথ্যে যদি ভুল-ভ্রান্তি থাকে, তবে তা সরকারের নিজস্ব তথ্য দিয়ে খন্ডন করাই শ্রেয়। তাদের প্রতিবেদন একেবারে বেঠিক বলে আমলে না নেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং বাস্তবতা স্বীকার করে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ বছর নির্বাচনের বছর। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিসহ সার্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা অপরিহার্য। নিপীড়ন, নিষ্পেষণ এবং অবরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে কোনোভাবেই ভাল নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করব, সরকারের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অস্বীকারের প্রবণতা পরিহার করে পরিস্থিতিগত উন্নয়নে মনোনিবেশ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন