প্রধান বিচারপতি সাংবিধানিক পদ। দেশের বিচার বিভাগ পরিচালনা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পদটির ভূমিকা খুবই তৎপর্যপূর্ণ। দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন রাষ্ট্রের স্বার্থেই একদিনের জন্যেও ‘প্রধান বিচারপতি’ পদ শুন্য রাখা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদটি ৭০ দিন ধরে শুন্য রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ছাড়া দেশের সর্বচ্চো আদালতের কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনার ঘটনা বাংলাদেশে ইতিহাসে বিরল। অতীতেও এমন কোন রেকর্ড নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ এবং ১৯৯০ সালের দুই সপ্তহারে জন্য রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি খালি ছিল। সব অতীত রেকর্ড ভেঙ্গে ২৭ বছর পর ২০১৭ সালে এসে ২ মাস ১০ দিন অতিক্রম করলেও নতুন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বর্তমানে প্রধান বিচারপতির চেয়ারটি খালি। তবে আপিল বিভাগের একজন সিনিয়র বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হার মিঞা বর্তমানে প্রধান বিচাপতির ‘দায়িত্ব’ পালন করছেন। নতুন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দেয়ার ফলেই সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগে দিতে পারছে না সরকার। এমনটাই মনে করছেন সংবিধান বিশেজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদটি খালি রাখা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। বর্তমানে মাথাহীন অবস্থায় রয়েছে বিচার বিভাগ। সরকার দেখাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট ইজ নট ইমপ্রেটেন্ট টু আস। বিচার বিভাগ সম্পন্ন নিয়ন্ত্রণ না হলেও বড় প্রভাব খাটানোর একটা অপকৌশল।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হওয়ার বিচার বিভাগে এক ধরনের স্থবিরতা রিবাজ করেছে। গত বছর ১০ নভেম্বর সরকার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে সিংগাপুর থেকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থারত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায় সরকারের আইন উপদেস্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ইনকিলাবকে বলেছেন, সরকার দেখাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট ইজ নট ইমপ্রেটেন্ট টু আস। এটা প্রমাণসরুপ দেখা যায়, প্রধান বিচারপতিকে অপমান করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে বর্তমান সরকার। অথচ জানুয়ারী মাসে তিনি অবসরে যেতেন। অতএত এগুলো বিচার বিভাগের জন্য শুভ লঙ্গণ নয়। স্বধীান বিচার বিভাগের জন্য শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে নাত অভিযোগ করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আরো বলেন, চীফ জাস্টিস একটা ইমপ্রটেন্ট অরগান। জুডিসারি একটি ইমপ্রেটেন্ট। অথচ মাথাহীন অবস্থায় রয়েছে। অথাৎ সরকারের কাছে আইন শাসন ও স্বাধীন বিচার বিভাগের গুরুত্ব পাচ্ছে না। এত দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি থাকবে কেন? দীর্ঘ সময় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দেয়াটা স্বাধীান বিচার বিভাগের জন্য অশ্রদ্ধা দেখানোর নামান্তর। এটা দেশের জন্য অপমানজনক বটে।
প্রধান বিচারপতির পদ শুন্য প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ড. স্বাধীন মালিক ইনকিলাবেক বলেন, এটা খুবই অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত অনেকেই ধারনা করছেন বিচার বিভাগ সম্পন্ন নিয়ন্ত্রণ না হলেও বড় প্রভাব খাটানোর একটা অপকৌশল সরকার গ্রহণ করেছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বিলম্ব করে সরকার রাষ্ট্র, সমাজ, গনতন্ত্র ও আইনের শাসন কোনটাই সুরক্ষিত করছে না সরকার। বাংলাদেশ ও প্রধান বিচারপতি একটি অবিছদ অংশ। এটাকে উপেক্ষা করে সবকিছুই অমঙ্গল করা হচেছ বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ইনকিলাবকে বলেন, এটা একটি বিরল ঘটনা। যেভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। রাষ্ট্্েরর আইন ও বিচার এবং প্রশাসনিক তিন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর মধ্যে সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে বিচার বিভাগ। সেখানে সবোর্চ্চ পদটি যদি শুন্য থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হবে। সুসাশন ও গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। মোট কথা হল সরকার বিচার বিভাগ সঠিক ভাবে পরিচালিতি হোক এটা চায় না। আমরা আইনজীবীরা এ বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। শুধু আইনজীবী নয় বিচারকরাও চান প্রধান বিচারপতি পদটি যেন খালি না থাকে। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদটি খালি থাকার কারনে বিচারপতি নিয়োগ, বদলিসহ বিচার বিভাগের সব কিছুতেই এক ধরেনর বিশংঙ্খলা সৃষ্টি হচেচ্ছ। অথাৎ বিচার অঙ্গণে কাজেহর এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে নতুন প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকা বা নিয়োগ না দেয়া কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারির জন্য হাইকোর্টে গত ৩ জানুয়ারি একটি রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। রিটে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, কেবিনেট সচিব, আইন সচিব এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে বিবাদী করা হয়। রিট আবেদনটি শুনানীর জন্য ধার্য রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন। এর আগে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে দাখিল করা রিট আবেদন হাইকোর্টের নিজ নিজ বেঞ্চে শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত করতে অপারগতা প্রকাশ করেন পৃথক চারটি আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বসে। এরপর থেকে পর্যায়কমে ২০ জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ইতিহাসে প্রথম প্রধান বিচারপতি হন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০ জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেন। তবে সরকারের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে কোন বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর প্রথম মার্শাল ল এর শাসনামলে তৎকালিন প্রধান বিচারপতি (আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম) এ এস এম সায়েম প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রধান সাময়িক আইন প্রশাসক হন। এসময় ৫ নভেম্বর তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদতাগ করেন। এরপর ১৮ নভেম্বর সৈয়দ এ বি এম মাহমুদ হোসেন প্রধান দেশের দ্বিতীয় প্রধান বিচারপতি হন। এসময় মাত্র ১৩ দিন প্রধান বিচারপতির পদ খালি ছিল। এরপর ১৯৯০ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের স্বৈরাশাসনের সময় এমন একটি ঘটনা ঘটে। যখন দেশে স্বৈরাশাসকের বিরুদ্ধে তথা এরশাদ বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। স্বৈরাাশাসকের পতনের আগ মুহুতে এইচ এম এরশাদ প্রচন্ড চাপের মুখে সন্মুখীন হন। ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারী তৎকালিন পঞ্চম প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অবসর গ্রহণ করেন। এরপর নতুন করে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিতে ১৩র দিন পর। পরবর্তীতে ১৪ জানুয়ারী ষষ্টতম বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় ১৩ দিনের জন্য পদটি অফিস খালি ছিল।
এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট রেকর্ড অনুয়ারী ১৯৭২ সাল থেকে সব ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পদটি এক দিনের জন্য খালি হয়ে যায়। সেটি যখন কোন প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণ করে। এরপন নুতন প্রধান বিচারপতি পদে অন্য বিচারপতিকে নিয়োগ দেয় সরকার।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ২০তম প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন অবসরে যাওয়ার আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সরকার ২১তম প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। তিনিই হন বাংলাদেশের প্রথম কোনো সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রধান বিচারপতি। নিয়ম অনুযারী ২০১৮ সালের তথা চলতি মাসের ৩১ জানুয়ারী অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে মেয়াদের ৮১ দিন আগেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। উল্লেখ গত বছরে ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায় দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এ রায় নিয়ে তোপের মুখে থাকা এসকে সিনহা ছুটি নিয়ে দেশত্যাগের ২৮ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে ১০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। ১৪ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এর আগে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। দেশ ত্যাগের সময় প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, তিনি অসুুস্থ নয় তিনি দ্রুত সময়ে মধ্যে দেশে ফিরবেন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। যদিও এর আগে সরকারের আইন মন্ত্রনালয় বলেছিল প্রধান বিচারপতি অসুস্থ তাই তিনি বিদেশের চিকিৎসার জন্য সময় আবেদন করেছেন। বর্তমানে আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন