বাংলাদেশ রফতানিতে মাত্র একটি পণ্যের উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে। তৈরি পোশাক আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য। এখনও দেশের ৮৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা তৈরি পোশাক থেকে আসছে। রফতানি খাত সম্প্রসারিত করা খুবই প্রয়োজন। নতুন নতুন পণ্য আমাদের রফতানি তালিকায় সংযোজন খুবই জরুরি। আজ নতুন একটি ছোট্ট খাত নিয়ে আমাদের আলোচনা। নারকেলের ছোবড়া থেকে যন্ত্রের সাহায্যে গুঁড়া ও আঁশ তৈরি করা হচ্ছে। বাগেরহাটে ন্যাচারাল ফাইবার কারখানায় নারকেলের ছোবড়া আর ফেলনা নয়। সেই ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে যন্ত্রে তৈরি তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ, যা কয়ার ফেল্ট নামে পরিচিত। এখন নারকেলের ছোবড়ার পাশাপাশি ছোবড়ার গুঁড়াও মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এ গুঁড়াকে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুরুতেই এগুলোর বাজার পাওয়া গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়।
ন্যাচারাল ফাইবার নামের একটি প্রতিষ্ঠানটি বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে ‘কয়ার ফেল্ট’ (ম্যাট্রেস তৈরির কাঁচামাল) তৈরি করে আসছে। সোয়ান, আখতার, পারটেক্স, টাইগারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ম্যাট্রেস উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে এগুলো। এটি মূলত নারকেলের ফেলে দেওয়া ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি হয়। মানভেদে প্রতি ঘনফুট কয়ার ফেল্টের দাম ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। নারকেলের ছোবড়া থেকে আঁশ ছাড়াতে গেলে প্রচুর পরিমাণে গুঁড়া বের হয়। সেই গুঁড়া রোদে শুকিয়ে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে চাপ দিয়ে বøকের মতো প্রস্তুত করা হয়। সেই বøক ‘কয়ার পিট’ নামে পরিচিত। দেশের বাজারে কয়ার ফেল্টের চাহিদা মেটানোর পর এখন নতুন পণ্য কয়ার পিট প্লাস্টিকে মুড়ে রপ্তানি করা হবে। বিভিন্ন দেশে গবাদি পশুপালন ফার্মে ও কৃষিকাজে মাটির বিকল্প হিসেবে কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ছোবড়া থেকে তোশক: নারিকেলের ছোবড়া জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে বর্ষায় ছোবড়া শুকাতে অসুবিধা হতো বলে তা ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বর্তমানে ছোবড়ার আঁশের সঙ্গে রেজিন বা তরল রাবার মিশিয়ে প্রথমে পাতলা শিট তৈরি করা হয়। পরে ম্যাট্রেস কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি শিটকে তাপ ও চাপ দিয়ে এক ইঞ্চি থেকে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি পুরুত্বের কয়ার ফেল্ট প্রস্তুত করা হয়। বিভিন্ন আকারের হলেও দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৭২ ও ৮০ ইঞ্চি কয়ার ফেল্ট করে থাকে তারা। বিসিকের কারখানাটিতে কাজ করেন ৩৫ জন শ্রমিক। দেশে বর্তমানে কয়ার ফেল্টের চাহিদা মাসে প্রায় ৩০ হাজার ঘনফুট। ৫ থেকে ৬ হাজার ঘনফুট উৎপাদন হয় ন্যাচারাল ফাইবার ফ্যাক্টরিতে।
ছোবড়ার পর ছোবড়ার গুঁড়া: ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানটিকে নারকেলের ছোবড়ার আঁশ সরবরাহ করতে আশপাশে ছোট ছোট কিছু কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু পণ্যটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় এ ছোট কারখানাগুলোর সরবরাহে চাহিদা মিটছিল না। এ কারণে গত বছর বাগেরহাটের সদর উপজেলার কররী গ্রামে ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপন করে ন্যাচারাল ফাইবার। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় ৮০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ফেলনা উপজাত হিসেবে বের হয় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া।
ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে কয়ার পিট তৈরি: ভারতের জাতীয় কয়ার বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে নারকেলের আঁশের উৎপাদন বছরে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। এর ৯০ ভাগই জোগান দেয় ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ভারত বছরে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১৪ কোটি ডলারের। আর শ্রীলঙ্কার বার্ষিক রপ্তানি আয় ৬-৭ কোটি ডলার। আমাদের রফতারি আয় এইখাত থেকে দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক মুদ্রা আর্জনে এইখাত বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
দেশে মেধা রয়েছে: আমাদের দেশে বহু মেধাবী যুবক রয়েছে। যারা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রফতানি করতে সক্ষম। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে যে পণ্য তৈরি হচ্ছে তা আমাদের নিকট একেবারেই নতুন। সম্ভাবনার এই খাতকে আমাদের দেখভাল করা প্রয়োজন। সরকার নতুন এই পণ্যের জন্য নানা সুবিধা দিতে পারে, তাতে উদ্যোগক্ততাগণ উৎসাহিত হবে। আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তা এই খাতে এগিয়ে আসবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থান বাড়বে ফলে বেকার সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে। এইখাতকে কর অবকাশ সুবিধা ১০ বছরর জন্য দেয়া যেতে পারে। এই জাতীয় পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা কম পক্ষে ১০ থেকে ২০ শতাংশ দেয়া যেতে পারে। যেমন সরকার বর্তমানে ওষুধ শিল্পে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছেন। এই সকল সুবিধা দিলে কিছু নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন