সত্যিকারের বন্ধু কে?
সুদিনে অনেক বন্ধু পাওয়া গেলেও কেবল দুর্দিনেই সত্যিকার বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। অতীতে যাদের আমরা বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম, তারা নিজের স্বার্থেই আমাদের বন্ধু হয়ে সাহায্য করেছিল বলে মনে হচ্ছে। স¤প্রতি বাংলাদেশ মানবিক কারণেই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে। আশ্রয় না দিলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে হয়তো আরও তাদের জীবন দিতে হতো। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার এবং এর দায় তাদেরই। মূলত এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রতিবেশী বড় দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে মিয়ানমার তাদের দেশের সমস্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো প্রকার যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি বা হওয়ার ইচ্ছাও নেই। তা সত্তে¡ও আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধু হিসেবে পরিচিত দেশগুলো মানবিক কারণেও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। প্রশ্ন হল, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে এ ধরনের আরও কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আমরা বন্ধু হিসেবে কাকে পাব? এটি এখন আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা কারও সঙ্গে শত্রুতা চাই না, তবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই সত্যিকারের বন্ধু প্রয়োজন। কাছের বন্ধুরা যদি আমাদের দুর্দিনে পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে অবশ্যই দূরের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল বলেই হয়তো মিয়ানমার অমানবিক ও অযৌক্তিকভাবে আমাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে। এমনকি বাংলাদেশকে যুদ্ধে জড়ানোর জন্যও নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের দুঃখ, দুর্দশা ও মানবেতর জীবন-যাপনের করুণ অবস্থা দেখতে বিশ্ব গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও আসছেন। অনেকেই সহানুভূতি জানিয়ে বক্তব্যও দিচ্ছেন। কিন্তু প্রায় তিন মাস হয়ে গেল, অথচ এ মানুষগুলোকে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে তথাকথিত ‘সভ্য’ দুনিয়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। শোনা যাচ্ছে, যেসব দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন করছে, তারাও অদূর ভবিষ্যতে তাদের দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এ রকম ব্যবস্থা নিতে পারে। কাজেই মিয়ানমার যদি তাদের দেশের ১৫-২০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু বৈধ নাগরিককে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে এবং বিশ্ববাসী যদি তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সক্রিয় সহযেগিতা না করে, তাহলে এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ সারাবিশ্বেই এর প্রতিফলন ঘটতে থাকবে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠবে এবং সারা বিশ্বেই তা ছড়িয়ে পড়বে।
স¤প্রতি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত আসেম সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংকট সমাধানে যে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন, সেখানেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো প্রস্তাব নেই। চীনের দেয়া প্রস্তাবগুলো হল- রাখাইনে দ্রুত অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা, সব পক্ষের মধ্যে সংলাপ এবং রাখাইনের উন্নয়ন। তাদের মতে, রাখাইন রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, তাই এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রয়োজন। অর্থাৎ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো কোনো প্রস্তাব চীন দেয়নি। যেহেতু মিয়ানমার সেনাবাহিনী লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে ও প্রায় ৮-৯ লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে ইতিমধ্যে রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করেছে, তাই সেখানে এখন অস্ত্রবিরতির আর কোনো গুরুত্ব নেই। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া শুধু সংলাপের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাবে না। তাহলে বিশ্বের যেসব দেশ নিজেদের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে দাবি করে থাকে, তা আসলে কতটুকু সঠিক? বিশ্বের দুর্বল, অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের সত্যিকারের বন্ধু আসলে কারা?
বিপ্লব বিশ্বাস, শিক্ষক,
গোয়ালচামট, ফরিদপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন