গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।
কবির এ কথার তাৎপর্য আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কিন্তু গুণগত শিক্ষার প্রসারে আমরা কতটুকু সচেতন তা সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিরন্তর পর্যালোচনা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং নিখুঁত মূল্যায়নের মাপকাঠিতে যাচাইযোগ্য। প্রথমেই গুণগত শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি, তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি এর ব্যপ্তি ও প্রভাববলয় সম্বন্ধে ধারণা রাখা সংগতকারণেই জরুরি। বস্তুনিষ্ঠ ও মানসম্মত আদর্শিক ভিত্তিতে অর্জিত শিক্ষাকে আমরা সাধারণ অর্থে গুণগত শিক্ষা বলতে পারি। আদর্শিক ভীত বা ফাউন্ডেশনের অনিবার্য উপাত্ত-উপকরণ যেমন; নীতি-নৈতিকতাবোধ, সুকুমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সদাশয় আচরণ, মননশীল চর্চা, সুস্থধারার সংস্কৃতিবোধ ও পরিমিতিবোধ যথাসময়ে যথাভাবে প্রবিষ্ট বা প্রদত্ত হলেই সার্বিকভাবে আদর্শিক ভিত্তি গড়ে উঠে। জীবন পরিক্রমার শুরু থেকেই ক্রমাগত ধাপসমূহে পারিবারিক সনাতনী শিক্ষা, পারিপার্শ্বিক ইতিবাচক পরিবেশ ও বিদ্যাপীঠের প্রতিটি স্তুরে লব্ধ সদুপদেশ ও অর্জিত জ্ঞান আদর্শিক শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে পরিপক্ক ও পরিণত করে। পরিশীলিত ও পরিমার্জিতরুপে আহরিত ও লালিত অনিন্দ্যসুন্দর আদর্শ সম্ভারের এ বুনিয়াদ ধীরে ধীরে বিকশিত ও প্রসারিত হয়। জ্ঞানাণে¦ষণের মানসে চর্চিত বহুমুখী পাঠাভ্যাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধ্যবসায় জ্ঞানগৃহ স্বরূপ প্রাথমিক বিদ্যানিকেতন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ সু-শিক্ষার ক্ষেত্রকে সুশৃংখলভাবে প্রশস্তায়ন করে।
শিক্ষাই উন্নতির চাবিকাঠি। জাতীয় জীবনে অগ্রগতির মূলমন্ত্র হল শিক্ষা। সমাজ ও যুগের চাহিদা পূরণে সমকালীন জ্ঞানের যে বিস্তার ঘটছে তার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষার মানোন্নয়ন অপরিহার্য। বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে গবেষণার অন্ত নেই। নিত্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষাকে অর্থবহ করার উদ্যোগ সর্বত্র বিরাজমান। আমাদের দেশে নানা রকম এহেন উদ্যোগ সত্বেও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সর্বোত্তম ফল লাভ করা যাচ্ছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে মানের ক্রমাবনতি রোধ না করতে পারলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থহীন হওয়ার আশংকা রয়েছে।
যে বিদ্যা মানুষের কাজে লাগে, সে বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ সর্বাবস্থায় আকাঙ্খিত। আর যে বিদ্যার বাস্তবিক ব্যবহার রয়েছে সে বিদ্যাই সার্থক। যে জ্ঞান বা বিদ্যা মানুষের কল্যাণে আসে না এবং বুলি সর্বস্ব হয়ে বইয়ের পাতায় সন্নিবিষ্ট সে জ্ঞান বা বিদ্যা মূলত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই প্রকৃত শিক্ষাকে আহরণ করতে হলে প্রথমেই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এর বাস্তবিক প্রয়োগিক দিক। আর তাই যে শিক্ষা আমাদের সমাজে প্রচলিত, গুণগত বিচারে তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল নব নব আবিস্কার এবং সৃষ্টিধর্মী নতুন কলাকৌশল আয়ত্বকরণ ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে বিকাশমান। সদা পরিবর্তনশীল এহেন প্রক্রিয়ার অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে শিক্ষক। তাই গুণগত শিক্ষা বিস্তারে সর্ব প্রধান হাতিয়ার গুণগত মানসম্পন্ন সুশিক্ষিত শিক্ষক।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রæত সম্প্রসারণশীল হলেও শিক্ষার গুণগত মানের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও মান এ দু’টি প্রসঙ্গেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি জন্ম দিয়েছে সকল পর্যায়ে ও সকল মহলে এক অস্বস্তিকর দুশ্চিন্তার। এ অনভিপ্রেত অবস্থার প্রধান কারণ হলো আমাদের শিক্ষার মান এখনো পুরোপুরি যুগোপযোগী হয়ে উঠেনি। এর চাক্ষুষ প্রমান হল শিক্ষাক্ষেত্রে দৃশ্যমান দুর্দশা।
শিক্ষার গুণগত মানের অবনতির কতিপয় কারণ: ক। সমাজে আদর্শভিত্তিক-গুণগত শিক্ষকের নিদারুণ স্বল্পতা। খ। পারিবারিক পরিমন্ডলে ও প্রারম্ভিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সুকুমার ও আদর্শিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালনে উল্লেখযোগ্য অমনোযোগিতা। গ। শিক্ষা ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট, সুবিন্যাস্ত ও সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতির প্রয়োগিক অসামঞ্জস্যতা। ঘ। যুগোপযোগী শিক্ষা-সংস্কারমূলক পদক্ষেপের অপর্যাপ্ততা। ঙ। সামাজিক শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির রাহু গ্রাসের কারণে অস্থিতিশীলতা। চ। কোচিং সেন্টার ভিত্তিক অননুমোদিত লেখাপড়ার প্রসার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। ছ। নোট বই/গাইড বইয়ের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত ছড়াছড়ি। জ। সামষ্টিকভাবে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনৈতিক কারসাজির ভয়াবহতা। ঝ। সার্টিফিকেট জালিয়াতির দৌড়াত্ম্য। ঞ। মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব। ট। বিদ্যাপীঠে সুনিয়ন্ত্রিত গঠনতন্ত্রের অপ্রতুলতা।
গুণগত শিক্ষা বিস্তারে করণীয়: শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ সাধনে বিগত তিন দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রণীত নীতিমালার নির্ধারণী কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাসিসট্যান্স প্রজেক্ট (১৯৯৪), ফিমেল স্কুল এ্যাসিসট্যান্স প্রজেক্ট: দ্বিতীয় পর্যায় (২০০১), টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট (২০০৫) এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি এন্ড একসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (২০০৮) অন্যতম। নীতি নির্ধারণী ও বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়াবলির পাশাপাশি পর্যায়ক্রমিক স্থিরকৃত লক্ষ্যসমূহ সর্বাগ্রে চিহ্নিত করা দরকার। স্বীকৃত সামাজিক ব্যধি দুর্নীতির আগ্রাসী ছোবল শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রসারিত এ নিন্দিত ঘাতকের ক্ষতি থেকে শিক্ষা পরিমন্ডলের প্রতিটি স্তরকে মুক্ত রাখতে সকল মহলের ঐকান্তিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক কার্যকরী ব্যবস্থা থাকা বাঞ্চনীয়। সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রের সর্বত্র প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ই-শাসন যথাশীঘ্র চালুকরনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপরোক্ত চিহ্নিত কারণসমূহের সুষ্ঠু সমাধানকল্পে গ্রহণযোগ্য করণীয় নির্ধারণের জন্য অভিভাবক, শিক্ষক সমাজ, সমাজপতি, সুশীল শ্রেণি ও নীতি প্রণেতাদের সমবেত ও সমন্বিতভাবে কাজ করা খুবই জরুরী। কারণ শিক্ষার সুফল বা কুফল জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক বা ব্যক্তির উপর আবর্তিত হয়। সুদূরপ্রসারী এহেন প্রভাববলয়ের কারণে অর্জিত কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত ফলাফল প্রতিনিয়ত যথাযথভাবে মূল্যায়নের বিষয়টি বিরাজমান প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্ববাহী। শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট উন্নতি বা অবনতির সূচকসমূহ সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই সংশোধনমূলক উল্লেখিত সামষ্টিক প্রচেষ্টা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকরকরণের সংস্কৃতি যথাশীঘ্র গড়ে তোলা উচিত। দেশের স্বার্থে গুণগত উন্নতির অনিবার্য ও অপরিহার্য ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ফলভোগী সকল সম্পদায়ের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে অনতিবিলম্বে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করার বিষয়টি অত্যাবশ্যক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। উপরন্তু, প্রস্তাবিত এ কমিশনের সমুদয় কার্যক্রম একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কার্যকরকরণের বিষয়টিও বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বিবেচনাযোগ্য।
গুণগত শিক্ষায় শিক্ষক: শিক্ষক পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেন। শিক্ষাদান করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাই তার যোগ্যতা। তার যোগ্যতার মাপকাঠি- অর্জিত শিক্ষা সফলতা ও অভিজ্ঞতা। নিয়মিত পড়াশোনা, চর্চা ও অনুশীলন তার যোগ্যতাকে কার্যকর সক্ষমতায় রপান্তরিত করে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে-
A lamp can never light another lamp unless it continues to burn its own flame. অর্থাৎ একটি কুপি বাতি নিজস্ব প্রজ্জ্বোলমান শিখা না থাকলে অন্যটিকে কখনো জ্বালাতে পারে না। শ্রেণিকক্ষে সফলভাবে পাঠদানের জন্য শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও সুনিপুণ কলা-কৌশল জানা থাকা বাঞ্ছনীয়। এতদ্বিষয়ে, দুর্নীতি ও প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের বিষয়টি অত্যাবশ্যক হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। অধিকন্তু, শিক্ষক সম্প্রদায়ের জন্য গতানুগতিক প্রশিক্ষণের পরিবর্তে উদ্ধৃত বিষয়াদির আলোকে গুণগত মানসমৃদ্ধ উপযোগী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই জরুরি। বস্তুত শিক্ষককে জীবন্ত উপাদান নিয়ে কাজ করতে হয় বলেই শিক্ষকতা একটি উঁচু দরের শিল্প। ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, সততা, মমতা ও সেবাধর্মী মনোভাবে উজ্জীবিত হয়ে সাবলীল সু-শিক্ষাদানে তাকে হতে হয় আত্মপ্রত্যয়ী। তাঁকে হতে হবে নীতি-নৈতিকতা বোধসমৃদ্ধ সুকুমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এক আদর্শ সমাজসেবী। শিক্ষক তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও মননের উন্মেষ ঘটিয়ে স্বচ্ছতা, জ্ঞানের প্রতুলতা, উদ্দেশ্যের নিদির্ষ্টতা এবং আকাঙ্খার দৃঢ়তাকে আরো মজবুত করে শিক্ষার্থীদের লুপ্ত প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাবেন এটাই প্রত্যাশিত। তবেই গুণগত শিক্ষাদান অনেকাংশেই সফল ও সার্থকভাবে সু-সম্পন্ন হবে।
পাঠের ধারাবাহিক উপস্থাপন: একটি দেশ ও জাতির শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রেণিকক্ষের সামগ্রিক সুবিধাবলীর যথাযথ ব্যবহারের উপর। শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে যথার্থ, মানসম্মত ও কার্যকর পাঠদানে সক্ষম হলেই কেবল সার্থক শিখন প্রক্রিয়া সহজতর হবে। পাঠদান যান্ত্রিক পদ্ধতি নয় বরং মানসিক অনুশীলন। তাই শিক্ষককে পাঠ উপস্থাপনকালে বিষয়বস্তুর নিরিখেই এর কৌশল ও পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সুশৃঙ্খলভাবে প্রদেয় বিষয়বস্তুর বিস্তার অনুযায়ী পাঠ্যাংশকে ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট পর্বে ভাগ করে নিতে হবে। তাই শিক্ষককে পাঠ্যবস্তু সু-সামঞ্জস্য ভারসাম্য বজায় রেখে বর্ণনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়ক্রম অনুসরণ করতে হবে। সুগঠিত ও সুবিন্যস্ত পাঠ পেশের জন্য নিন্মোক্ত ক্রমপর্যায় অনুসরণ করা যেতে পারে: ক। শিক্ষককে পাঠ প্রণালীতে পূর্বাপর সঙ্গতি রক্ষা করা। খ। একটি পর্বের প্রদত্ত পাঠদানের মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী পর্বের উপস্থাপন শুরু করা।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন