শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

শ্রেণী কক্ষে পাঠদানের মান বাড়াতে হবে

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রথম থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে পাঠ্যবই। নতুন বই হাতে পেয়ে খুশিতে ভরে উঠেছে তাদের মন। বিনামূল্যে বই বিতরণের উদ্দেশ্য একটাই, দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করা। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শতভাগ সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছানো। কোন মানুষ যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকার প্রতি বছর দেশের শিক্ষাখাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও জাতি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। কারণ দেশের একটি কুচক্রিমহল অতি তাড়াতাড়ি কোটিপতি হওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধবংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বইয়ের বাজারে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রতিটি বইয়ের দোকানে সাজানো আছে নিষিদ্ধ নোট বই বা গাইড বই। সব শ্রেণির, সব বিষয়ের গাইড বই এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বিক্রয় সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও সরকারের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে একটি মহল সেই নোট বা গাইড বই ছাপিয়ে বিক্রি করছে যেগুলোতে ভুলেভরা। আর এ ভুলে ভারা নোট বা গাইড বই পড়ে ছেলে/মেয়েরা সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। এসব বই পড়ে ছাত্র/ছাত্রীরা তাদের মেধাকে বিকশিত করতে পারছে না। ১৯৮০ সালের নোট বই (নিষিদ্ধকরণ) আইনে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান এই আইনে আছে। ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড বইও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এক রায়ে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ বহাল রাখে। গাইড বইয়ের চাহিদা নেই, এ কথা বলা যাবে না। চাহিদা আছে বলেই তো সব শ্রেণির সব বিষয়ের গাইড বইয়ে বাজার সয়লাব। শ্রেণিকক্ষে যে পাঠদান করা হয় তা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য যথেষ্ট নয়। কম মেধাবী বা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষের বাইরে সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। তাই উপায়ান্তর না দেখে অভিভাবকরা গাইড বই তুলে দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের হাতে। স্কুলের আগে বা পরে পাঠাচ্ছেন কোচিং সেন্টারে। অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট প্রকাশকের গাইড বই কেনার জন্য ছাত্র/ছাত্রীদের বাধ্য করে বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়াও কোন কোন স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলে/মেয়েদের নির্দিষ্ট লেখকের নির্দিষ্ট গাইড বই কেনার জন্য স্কুল হতে লিষ্ট দিয়ে দেয়। বলে দেয়, অমুক লাইব্রেরিতে বইটি পাওয়া যাবে। বইয়ের প্রকাশকদের সঙ্গে কিছু কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। শিক্ষাব্যবস্থায় এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, অধিকাংশ ছাত্র/ছাত্রীর টেক্সট বইয়ের সঙ্গে সংযোগ নেই বললেই চলে। শিক্ষাব্যবস্থা গাইড বই আর কোচিং সেন্টারনির্ভর হয়ে পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। তাই পরিশ্রম করে জ্ঞানার্জনের চেয়ে পরীক্ষা পাসের শর্টকাট রাস্তা খুঁজছে সবাই। গাইড বই থেকে কিছু নির্বাচিত প্রশ্নের তৈরি জবাব মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উদগীরণ করতে পারলেই পরীক্ষায় পাস করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে বলেও শোনা যায়।
মানুষের প্রতিভার অনেকটাই জন্মগত। উপযুক্ত পরিবেশ প্রতিভাকে লালন করে। চর্চার মাধ্যমে প্রতিভা বিকশিত হয়। নতুন কিছু জানার মধ্যে আনন্দ আছে, না বুঝে মুখস্থ করার মধ্যে তা নেই। আছে একঘেয়েমি। মুখস্থ বিদ্যার ফলে না প্রকৃত জ্ঞানলাভ হচ্ছে, না হচ্ছে মেধার চর্চা। না বুঝে মুখস্থ বিদ্যার এই হলো বিপদ। একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেই ছাত্র/ছাত্রীরা পরীক্ষার সময় উত্তর লিখতে পারে না। এ ছাড়াও বিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে এটা সবারই জানা। বিশেষ করে অংক ও ইংরেজির ভালো শিক্ষকের অভাব প্রকট। যে স্বল্প সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক আছেন তারা মহাব্যস্ত। দম ফেলার সময় নেই। কোচিং সেন্টারের নামে স্কুল খুলে বসেছেন। সাতসকালে কোচিং সেন্টার, দুপুরে স্কুল, বিকালে আবার কোচিং সেন্টার। মাঝ রাতের আগে ছুটি নেই। এভাবে প্রতিদিন সতের/আঠারো ঘণ্টা একটানা পরিশ্রম করে কীভাবে ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতি তারা সুবিচার করেন সেটাই প্রশ্ন। যে দু/চারজন অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন তাদের লক্ষ একটাই, টাকা রোজগার করা। ছেলে/মেয়েরা কী শিখল আর না শিখল তা তাদের দেখার ব্যাপার না। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাবে এ মহান পেশায় আসতে আগ্রহী নন মেধাবীরা। তাই বলে শিক্ষার ফলাফল শূন্য তাও বলা যাবে না। শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো এসব খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে, এটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। এই যে শিক্ষা বছরের শুরুতেই সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে, এটা কম অর্জন নয়। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন পাঠ্যবই পেতে শিক্ষার্থীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো। শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠ দানের মান উন্নত না হলে শুধু আইন প্রণয়ন করে গাইড বইয়ের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, এ সত্যটি কী শিক্ষক, কী অভিভাবক, কী শিক্ষার্থী, সবারই উপলব্ধি করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত নির্ধারণ, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, উপযুক্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যবইয়ের সংস্কার, ছুটি কমিয়ে কার্যদিবস বাড়ানো- এসব বিষয়ে আমাদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। সাথে বিদ্যালয়ের শিক্ষদের ছাত্র/ছাত্রীদের লেখা-পড়ার প্রতি আর দায়িত্বশীল হতে হবে। ছাত্রী/ছাত্রীরা যাতে নোট বা গাইড বই না কেনে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় ছাত্রী/ছাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। আর যারা নোট বা গাইড বই বিক্রি করে তাদের এসব বই বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন