ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুনাশক ওষুধের ঢালাও ব্যবহার মানুষের জীবনের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ১৯২৭ সালে অণুবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন। মানুষের রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে এর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ প্রয়োগ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সহজাত ক্ষমতাকে কেড়ে নিচ্ছে। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া দুনিয়ার কোথাও ওষুধ বিক্রির নিয়ম নেই। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এক বড় অংশ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নন।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ওষুধ কেনেন নিজেদের মর্জিমাফিক। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সাত-আটটি গুরুত্বপূর্ণ জেনেরিকের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। দেশের মানুষের পুষ্টির জোগান দিতে মাছ-মুরগি উৎপাদনের উদ্যোগ বেড়েই চলেছে। মাছ-মুরগি রোগমুক্ত রাখতে কিংবা মড়ক ঠেকাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগকৃত এসব ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে রান্নার তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে ওই অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে ঢুকে বয়ে আনে মারাত্মক ক্ষতি। বিশেষ করে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করার বড় কারণ হিসেবে মাছ-মাংসের অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিককে দায়ী করা হয়। গবাদি পশুর পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। সারা দুনিয়াজুড়ে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৫০ শতাংশই ব্যবহার হয় কৃষি খাতে। এসব কৃষি পণ্য ব্যবহার করার পরিণতিতে জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ২০৫০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ১ কোটি মানুষ মারা যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে রাজধানীর ৫৫.৭০ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর অর্থ হচ্ছে ঢাকা মহানগরে যেসব রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। এ তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে রাজধানীর বাইরের বাস্তবতারও মিল থাকার কথা। কারণ গবাদিপশু ও মুরগি শুধু নয় মৎস্য খামারগুলোতেও ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ ঘটছে। বাংলাদেশের মৎস্য খামারগুলোতে ১০ ধরনের ও ৫০ শ্রেণীর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যবহৃত এসব অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এ বিপদ ঠেকাতে সরকারকে অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রিতেও জারি করা দরকার নিষেধাজ্ঞা।
রোগজীবাণু গড়ে তুলছে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা। ফলে এসব রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও কোনো কাজ হবে না। শুধু তা-ই নয়, মানবশরীরে অপরিমিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশের ফলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিংবা কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে মানুষ বেশি করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে আর শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অ্যান্টিবায়োটিকের এই যথেচ্ছ ব্যবহার বা অপব্যবহার ইতিমধ্যেই জনস্বাস্থ্যে ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। সে কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
জানা যায়, ২০ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক এখন চারশর বেশি নাম দিয়ে বাজারে ছেড়েছে বিভিন্ন ওষুধ কম্পানি। পাড়া-মহলার দোকানেও দেখা যাবে অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুনাশী ওষুধের ব্যাপক ছড়াছড়ি। এসব ওষুধ কিনতে চিকিৎসকের কোনো ব্যবস্থাপত্রেরও প্রয়োজন হয় না। কারো সর্দিকাশি বা সামান্য শারীরিক সমস্যা হলেই কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল কিনে খেয়ে নেয়। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট কোর্স সম্পন্ন না করলে জীবাণু ধ্বংস না হয়ে উল্টো সেই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। তখন পুরো কোর্স ওষুধ খেলেও সেই জীবাণু ধ্বংস হয় না। আবার অনেক চিকিৎসকও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেন না। রোগী গেলেই এক কোর্স অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। এতে কাজ না হলে তখন এটি বদলে অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেন। অথচ উন্নত সব দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কেউ সে নীতিমালা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংগঠনগুলো মিলে এ ব্যাপারে জাতীয় করণীয় নির্ধারণ করবে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন