জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ বিচারিক আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ৫ বছর সাজার রায় ঘোষিত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত একটি ঘন কালো অন্ধকার পথে যাত্রা করেছে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। গত ৮ তারিখ রায় ঘোষনার আগে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি তৎপরতা, ঢাকা শহরকে কার্যত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, শত শত মানুষ ধরপাকড়, বিজিবি মোতায়েনের পাশপাশি র্যাব ও পুলিশের রণপ্রস্তুতির মধ্যেও অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের সাথে থাকা হাজার হাজার তরুণ নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। মামলার রায় কি হতে যাচ্ছে তা যেন মামলার পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ে যার যার মত আন্দাজ করে নিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে সরকারীদলের নেতাকর্মী ছাড়াও এরশাদসহ সরকারের শরিক জোটের নেতাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের জনগনের পাল্স বুঝতে পারা যে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতার অন্যতম মানদন্ড। আর রাজনৈতিক দলের জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তার মানদন্ড নির্ধারিত হয় অবাধ নিরপেক্ষ ভোটের মধ্য দিয়ে। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত প্রায় তিন দশক ধরে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী। যেহেতু তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং অন্তত ৫বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সে কারনে রাজনৈতিক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অতীত, বর্তমান বিভিন্ন কর্মকান্ডের ভুলত্রæটি খুঁজে বের করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের দেশে যে কোন নির্বাচনের সময় প্রতিপক্ষ প্রার্থীর অতীতের যে কোন বিতর্কিত কর্মকান্ড ভুলত্রæটি তুলে ধরার চেষ্টা করে ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। কর্পোরেট মিডিয়া এবং ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ‘ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন’ (চরিত্র হনন) রিজিম অথবা সা¤্রাজ্যবাদি রাজনৈতিক প্রবণতা হিসেবে গণ্য। রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী-এমপি হিসেবে আমাদের দেশে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিরোধিদলের নেতাদের ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশনের প্রয়াস বেশ প্রবলভাবেই চলছে। একশ্রেনির রাজনৈতিক নেতা ও গণমাধ্যম সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেলে মনের মাধুরী মিশিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে এমন সব কথাবার্তা ও তথ্য প্রচার করছেন তা’ ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যায়। গণতন্ত্র যখন কর্পোরেট স্বার্থের শিকার হচ্ছে, তখন বিশ্বের সর্বত্রই কর্পোরেট মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশনের আশ্রয় নিচ্ছে। আমাদের দেশে ব্যতিক্রমী প্রবণতা হচ্ছে সরকারের প্রতিপক্ষ প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটকে জাতীয় নির্বাচনের বাইরে রাখার সর্বাত্মক অপপ্রয়াস। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গত এক দশকের বেশী সময় ধরে দেশে তেমন কোন বিনিয়োগ হচ্ছেনা। পক্ষান্তরে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বৈদেশিক মূদ্রায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। প্রভাবশালী মহলের জালিয়াতির কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ হয়ে হয়ে সরকারী ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় এসব ব্যাংকের পরিকাঠামো ও জনবল টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা করা হলেও হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের কাঠগড়ায় দাড় করানোর সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা। শেয়ার বাজার থেকে লক্ষকোটি টাকা তুলে নিয়ে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিকে সর্বস্বান্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গত ৭ বছরেও মামলা হয়নি। কারসাজি করে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত ও মূলধন সরিয়ে নেয়ার সাথে জড়িতরা এখনো দিব্যি বুক ফুৃলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পক্ষান্তরে অনুদানের মাত্র ২ কোটি টাকায় গঠিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কথিত দুর্নীতির মামলা নিয়ে দুদক ও সরকারী মহলের অতি তৎপরতা, সত্তরোর্ধ বয়েসী বিরোধিদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কারাদন্ডের রায় নিয়ে উল্লাস দেশের মানুষকে উদ্বিঘœ করে তুলেছে।
কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। বিশেষত সরকার ও বিরোধি দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নানা অপকর্মের নিরপেক্ষ বিচার না হওয়ায় দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছে। সরকার যদি রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে এ ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে বের করে আনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিত নি:সন্দেহে তা দেশের কোটি কোটি মানুষের সমর্থন লাভ করত। খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের করা দুর্নীতির মামলাগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল একটি নিয়ন্ত্রিত আদালতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে দুর্নীর্তির দায়ে সাজা দিয়ে তাদের নির্বাচন ও রাজনীতির বাইরে রেখে কথিত মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়ন করা। উল্লেখ নিস্প্রয়োজন, দেশের মানুষ সেনা সমর্থিত সরকারের সেই মাইনাস টু ফর্মূলা সমর্থন করেনি। এদেশের মানুষ একটি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছে। একই সাথে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনা দেশের দুই প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এবং তাদের দল বিএনপি-আওয়ামীলীগকে গণতন্ত্রের স্বার্থে পরস্পরের পরিপুরক হিসেবে বিবেচনা করেছে। এ কারণেই সেনাসমর্থিত তত্ত¦াবধায়ক সরকারের সময় বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে শেখ হাসিনাকে বাধা দেয়ার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে সোচ্চার ও প্রতিবাদি ভ’মিকা পালন করতে দেখা গেছে। সে সময় যদি শেখ হাসিনার পাশপাশি খালেদা জিয়াকেও বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব হতো এবং দুইজনেরই দেশে ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়ার মধ্য দিয়েই হয়তো মাইনাস টু ফর্মূলার বাস্তবায়ন ঘটতো। সে সময় সরকারের সাথে শেখ হাসিনার কি বোঝাপড়া হয়েছিল সে সব আলোচনায় না গিয়ে মোটাদাগে এটুকু বলা যায়, খালেদা জিয়ার সাহসী ও আপসহীন ভ’মিকার কারণেই সম্ভবত সে সময় শেখ হাসিনাকে দেশে আসার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফলের জন্য ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর এবং আওয়ামীলীগের সাথে ক্ষমতাসীন বিশেষ সরকারের গোপন সমঝোতা ও পক্ষপাত ছিল। পরবর্তিতে নানাভাবে তা প্রকাশিতও হয়েছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, দেশে ফেরার পর আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই জনসমক্ষে বলেছিলেন, এই সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল এবং ক্ষমতায় গেলে তাদের সব কর্মকান্ডের তিনি বৈধতা দেবেন। সরকারে থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ভুলভ্রান্তির ঝুঁকি থাকবেই। শেখ হাসিনার বক্তব্যে সেনাশাসিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কুশীলবদের জন্য ক্ষমতা ছাড়ার পর নিরাপদ ও নির্বিঘেœ দেশ ছাড়ার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকায় তারা শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহনের পক্ষে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। সরকার ও বিরোধিদলের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়া না থাকায় দেশে বার বার তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটেছে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়েছে। প্রতিটা প্রবল গণআন্দোলনের পর ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আমলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয় আরো বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এরশাদ সরকারের আমলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাধিকবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও। একানব্বই সালে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গত ২৭ বছরেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচিত সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিস্প্রভ, নিস্পৃহ ভ’মিকা হতাশাজনক। রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যা, মানবিক বিপর্যয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকট, অথবা গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী বিমান হামলায় নিরস্ত্র মানুষ হত্যা বা সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরবতা দেশের জনগনের আকাঙ্খা ও স্পিরিটের সাথে বেমানান।
দেশের সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক শক্তি যখন জনগনের পাল্স ও স্পিরিট বুঝতে ব্যর্থ হয়, তখনই রাষ্ট্র কার্যত ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন অর্থনীতিবিদ, নিউইয়র্ক টাইমসের এক কলামে পল ক্রুগম্যান দেখিয়েছেন, কিভাবে একটি রিপাবলিকের অপমৃত্যু ঘটে। তিরিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে বসেছিল সে সময় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি আমেরিকাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। দলমতের উর্ধ্বে থেকে একশ্রেনীর সিনেটর ও রাজনৈতিক নেতা দেশের কথা, গণতন্ত্রের কথা ভেবে শক্ত দলনিরপেক্ষ ভ’মিকা পালন করে দেশকে রক্ষা করেছে। তাদের কথা ছিল, ‘উই মাস্ট স্টপ পার্টিজান পলিটিক্স অ্যট দ্য ওয়াটার এজ’। রাষ্ট্র ও সমাজ যখন ডুবন্ত অবস্থায় তখন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উঠার আহŸান জানিয়েছেন অনেক প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর। এ কারণেই ডেনাল্ড ট্রাম্পের চরম ফ্যাসিবাদি রাজনৈতিক অবস্থান সত্তে¡ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরো বেশ কিছু বছর ধরে টিকে থাকবে। কর্পোরেট আধিপত্যের কাছে রাজনৈতিক অর্থনীতির বন্দিত্ব গ্রহনের পরও মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখনো সেখানকার জনগনের মূল স্পিরিট হিসেবে টিকে থাকার অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিগত মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকান ট্রাম্পের বিজয়ের নেপথ্যে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের অভিযোগকে খোদ রিপাবলিকান সিনেটররাও অগ্রাহ্য করতে রাজি নন। তবে জনগনের ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশে পদচ্যুত করার মত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে রিপাবলিক অকার্যকর বা পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে গণ্য করেন নোবেল বিজীয় মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। সেই সাথে বর্ণবাদি চিন্তাধারা ও কিছু মাইনরিটি গ্রæপকে ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টাকেও গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত হিসেবে গন্য করেছেন ক্রুগম্যান। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উদার মাল্টিকালচারাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বেতাঙ্গ ওর্য়াকিং ক্লাসের ভোটাররা কেন একটি আত্মঘাতি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিচ্ছে এ প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অবিচ্ছেদ্য মার্কিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে যায়না, তা’ ক্রমে ধ্বংসের দিকে যাত্রা করার যে ধারাবাহিক কার্যক্রম সেখানে চলছে তাকে দ্বি পাক্ষিক বিষয় বলতে নারাজ ক্রুগম্যান। মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রিপাবলিকের ধ্বংসের ঝুঁকি শুধুমাত্র রিপাবলিকানদের দ্বারাই সাধিত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর শাসকরা গণতন্ত্রের একটি অস্থিতিশীল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জনগনের উপর চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রকেই ভঙ্গুর করে তুলছেন। এখানে সামরিক স্বৈরাচারের হস্তক্ষেপে গণতন্ত্রের কুঁড়ি বার বার অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। তারচেয়েও বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, জনগনকে গণতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজপথে স্বৈরাচারী শক্তিকে পরাজিত করে যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরী করলেও, জনগনের প্রত্যাশিত সে সম্ভাবনা তাদের ক্ষমতালিপ্সার কাছে বার বার পদদলিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
ক্ষমতাসীনরা এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলো নিজেদের সুবিধামত ইতিহাসকে যেভাবেই বিবৃত করুক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে দেশের জনগন এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের অজানা কিছুই নেই। বিশেষত: নব্বইয়ের শুরুতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা এবং পরবর্তি প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কার কি ভ’মিকা ও অবস্থান তা একটি চলমান রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিষয়। এরশাদ বিরোধি আন্দোলনের শেষ ধাপে এসে তিন জোটের রূপরেখার আওতায় নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার উপর জনগণ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের আস্থা ও গ্রহনযোগ্যতা তৈরী হয়। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা পুন:নির্বাচিত হতে না পারায় এই ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচিত হওয়ার পরও বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের মত নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অভিপ্রায় প্রমান করেছে। সংবিধানকে নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। পরিহাস এই যে, যাদের আন্দোলনের কারণে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তারাই এক সময় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারাই সেই ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। সরকারের ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, সংসদ বহাল রেখে ক্ষমতাসীনদের অনুগত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, গণমাধ্যমের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে রাখার রাখার এই ব্যবস্থা বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট মেনে নিচ্ছেনা। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন হবে এই প্রশ্নেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাসহ আরো যে সব মামলা দেয়া হয়েছে তা আইনের শাসনের অনুসঙ্গ নাকি বিরোধি দলের র্শীষ নেত্রীকে নির্বাচনের বাইরে রেখে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জনগণের রায় এড়িয়ে আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকার পথ পরিস্কার করা তার হিসাব নিকাশ করা খুব কঠিন কাজ নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ ও একপাক্ষিক নির্বাচন সরকারও হয়তো চায়না। তবে তারা হয়তো ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায়। এ লক্ষ্যেই খালেদা জিয়ার মামলা ও সাজার রায়গুলোকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে। একদিকে বিএনপি’র নিবন্ধন বাতিল হওয়ার জুজু, অন্যদিকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার রায়, জামিন-আপীল ইত্যাদি তৎপরতা ঘিরে বিরোধি মহলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকার কি আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়ার একটি রাজনৈতিক সমঝোতা করতে বিএনপিকে বাধ্য করতে চাইছে? পাশাপাশি বিএনপি ভাঙ্গার নানামুখী তৎপরতাও হয়তো শুরু হবে। ইতিমধ্যে সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা এবং বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে দলভাঙ্গার চেষ্টার অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। গণতন্ত্র ও জনগনের স্বার্থে দেশে শক্তিশালী বিরোধিদল প্রয়োজন। আর শক্তিশালী বিরোধিদল মানে সরকারের জন্য নির্বাচনী বৈতরণী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা। দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে এবং অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে দেশে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবী করার সংগত যুক্তি সরকারী দলের হাতে রয়েছে। সেই সাথে সহিংস আন্দোলনসহ বিরোধিদল হিসেবে বিএনপি’র ব্যর্থতার খতিয়ানও ক্ষমতাসীনরা বেশ জোরে শোরেই প্রচার করছেন। এহেন বাস্তবতায় আগামীতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে গণরায় মেনে নেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে আওয়ামীলীগের মত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিকদলের এতটা ভীত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। যে কোন মূল্যে বিজয় সুনিশ্চিত করতে চাওয়াই দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার মূল কারণ। বিরোধিদলকে কোনঠাসা করে, ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার নাম গণতন্ত্র নয়। দেশের অর্থনীতি, গণতন্ত্র এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এখন চরম অস্থিরতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চেপে বসেছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রকেই অত্যন্ত দুর্বল করে তুলেছে। বলাবাহুল্য, আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের ধকল সামলানোর মত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সামর্থ বাংলাদেশের এখন নেই। দেশের স্বার্থেই একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন