বাংলাদেশে সুপেয় পানি হ্রাস এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি নতুন নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। লবণাক্ততা এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, ওই অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের পানযোগ্য পানির অভাব তীব্র হয়ে উঠছে। এমনকি লবণাক্ততার কারণে ফসলী ক্ষেতও বিরান হয়ে পড়ছে। নদীর নাব্য হ্রাস, দূষণ এবং আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। সুপেয় পানি পাওয়ার জন্য মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। সাধারণত এক লিটার পানিতে এক গ্রামের কম লবণ থাকাকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মানুষকে দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকার প্রতি লিটার পানিতে এ পরিমাণের বেশি লবণ পাওয়া যাচ্ছে। বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক জানান, ওই অঞ্চলের প্রতি লিটার পানিতে ৩ থেকে ৯ গ্রাম লবণ রয়েছে। এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সুপেয় পানি সংগ্রহ করার জন্য বাগেরহাটের মানুষকে বৃষ্টির পানি, পুকুর, স্যান্ড ফিল্টার এমনকি নদীর পানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির জন্য প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে ২০ লিটার কন্টেইনারের পানি কিনে পান করতে হয়। এতে তাদের খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তীব্র লবণাক্ততা পরিস্থি’তির বিষয়টি উপলব্ধি করে বুয়েটের চার শিক্ষার্থী পানিকে লবণমুক্ত করার জন্য সোলার পাওয়ারের নতুন এক ডিভাইস আবিষ্কার করেছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে আশা করা হচ্ছে, লবণাক্ততায় আক্রান্ত এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন। ডিভাইসটি তৈরি কার হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল, পলিকার্বন পাত এবং ছোট্ট একটি পাইপের মাধ্যমে। এটি একবারে ১০ লিটার পানি লবণমুক্ত করতে সক্ষম। তবে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। এর খরচ পড়বে ১৫০০ টাকা এবং এটি বাড়ির ছাদে স্থাপন করা যাবে। এর মেয়াদকাল ১০ বছর। ডিভাইসটি আবিষ্কার করেছেন বুয়েটের চার শিক্ষার্থী সায়ন্তী, মোবাশ্বের তাহমিদ, আসিফ হোসেইন তামিম এবং সাব্বির রুদ্র। এই আবিষ্কারের জন্য তারা ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের জন্য এই চার তরুণ শিক্ষার্থীকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
সুপেয় পানিকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা গড়ে উঠে। মানবকূলসহ জীববৈচিত্রের যে বিকাশ তা সুপেয় পানির উপর নির্ভর করেই এগিয়ে চলেছে। যেখানেই পানযোগ্য পানি রয়েছে, সেখানেই মানব বসতি গড়ে উঠেছে। তবে মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকাÐের কারণে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে তা বিশ্বজুড়ে সুপেয় পানির অভাবকে তীব্র করে তুলছে। প্রতি বছর এক ডিগ্রী হারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করে চলেছে। সাগরের লবণাক্ত পানি ভূখÐে প্রবেশ করে লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে। এভাবে যদি চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে সুপেয় পানি হ্রাস এবং এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা সুপেয় পানিকে ‘নেক্সট ওয়েল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ তেলের মতোই দামী হয়ে উঠছে সুপেয় পানি। জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে আভাস দেয়া হয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৩০ ভাগ হ্রাস পাবে। বিশ্লেষকরা এমনও আশঙ্কা করছেন, সুপেয় পানি নিজেদের আয়ত্তে¡ রাখা নিয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে যে ‘ওয়াটার পলিটিক্স বা হাইড্রো পলিটিক্স’ চলছে, তাতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয় তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতোমধ্যে দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তাদের জনগণের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে রিজার্ভ বৃদ্ধি ও ধরে রাখার জন্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। ভূ-অভ্যন্তরের পানির ব্যবহার কমিয়ে বা রিজার্ভ রেখে ভূ-উপরিস্থ পানি বিশুদ্ধকরণের উপর জোর দিয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশ সুপেয় পানির অবারিত ভাÐার হলেও ভারতের হাইড্রো পলিটিক্সের কারণে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। প্রত্যেকেরই জানা, ভারত অভিন্ন নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করে ফেলেছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা ইতোমধ্যে মরুকরণের মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে নদ-নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ব্যাপক এলাকায় ভূভাগে সাগরের পানি প্রবেশ করে লবণাক্ততা সৃষ্টি করছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় উপকূলবর্তী এলাকাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে। ফসলী ক্ষেত লবণাক্ত হয়ে পড়ায়, ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এতে একদিকে ফসলী ভূমি কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বলাবাহুল্য, যে এলাকায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দেয় সেখানে জনবসতি কমে আসে। মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র বসবাস শুরু করে। এতে নতুন আবাসস্থলে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন সংকট দেখা দেয়। উপকূলবর্তী এলাকাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে ঐ অঞ্চলের মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
বুয়েটের যে চার তরুণ শিক্ষার্থী লবণাক্ত পানি পরিশোধনের ডিভাইস আবিষ্কার করেছে, তা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীরা যে উপকূলবর্তী এলাকাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে পানি বিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে, তা অত্যন্ত সাধুবাদযোগ্য। তাদের আবিষ্কৃত ডিভাইসটি যদি ওইসব অঞ্চলে ব্যাপকহারে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়, তবে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হবে এবং লবণাক্ততা থেকে রেহাই পাবে। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকভাবে ডিভাইস আবিষ্কার করে তার কার্যকারিতা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রয়োজন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা মনে করি, এই ডিভাইসের কার্যকারিতা উপলব্ধি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এগিয়ে আসবে। ডিভাইসটিকে কীভাবে আরও উন্নত এবং ব্যাপক ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়, এ ব্যাপারে সহযোগিতা দিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো একটি সমস্যাসংকুল ক্ষেত্রের একটি আবিষ্কার পুরো এলাকার সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে। বুয়েটের চার শিক্ষার্থীর পানি বিশুদ্ধকরণ ডিভাইস আবিষ্কার গোটা উপকূলবর্তী এলাকা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন