এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ হানিমুন আইল্যান্ড হিসেবে পরিচিত মালদ্বীপ তার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামীন তার প্রতিপক্ষ প্রায় সব রাজনীতিককে জেল দিয়েছেন এবং দেশটিতে জরুরী অবস্থা জারী করেছেন। এ নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গণে বেশ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই সংকটময় মুহূর্তে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশীদ ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। তবে মালদ্বীপের পররাষ্ট্র দপ্তর তার আভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে ভারতকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা নাক না গলাতে সতর্ক করে দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, আশা করি, ভারতসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন কোনো হস্তক্ষেপ বা অযাচিত উদ্যোগ নেবে না যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকট সে নিজেই সমাধানে সক্ষম এবং এ ব্যাপারে ভারত বা অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই, ভারতকে সতর্ক বা ধমক দেয়ার মধ্য দিয়ে সে তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতের প্রতি মালদ্বীপের এই মনোভাবকে আমরা স্বাগত জানাই। অন্যদিকে গত বুধবার দিল্লীতে এক আলোচনা সভায় ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, চীনের সহায়তায় পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশী মুসলমানদের ঠেলে পাঠাচ্ছে। তার বিতর্কিত এ বক্তব্য নিয়ে দেশের বিশ্লেষকরা তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতের বর্তমান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের বক্তব্য কাক্সিক্ষত নয়। এ বক্তব্য নিয়ে যখন বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ নীরবতা নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
মালদ্বীপের মতো একটি ছোট্ট দেশ যার আয়তন ঢাকার সমান নয়, মাত্র ১১৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ জন, এই দেশ যখন তার আভ্যন্তরীন ব্যাপারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করতে ভারতকে সতর্ক করে, তখন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধানের স্পর্শকাতর মন্তব্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিশ্চুপ থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষ করে সরকার যেখানে ভারতের সাথে সম্পর্ককে ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তম সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের জনগণ আশা করেছিল, এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জোরালো প্রতিবাদ আসবে। নিদেনপক্ষে বলবে, ভারতের সেনা প্রধানের এ বক্তব্য ভিত্তিহীন ও অসত্য। দুঃখের বিষয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ মন্তব্যটুকু না করে নিশ্চুপ রয়েছে। এই নিশ্চুপ থাকার অর্থ হচ্ছে, ভারতের সেনা প্রধানের বক্তব্য মেনে নেয়ার শামিল। অথচ তার বক্তব্য খোদ ভারতেই তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন নীরবতা পালন করছে, তা জনগণের বোধগম্য নয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ আচরণ মেরুদÐহীনতার পরিচায়ক। তারা বলছেন, মালদ্বীপ একটি ক্ষুদ্র দেশ হয়েও যেভাবে ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, সে তুলনায় অনেক শক্তিশালী বাংলাদেশকে ভারতীয় সেনাপ্রধানের বিতর্কিত বক্তব্যের প্রতিবাদে কেন চুপ থাকতে হবে! এ ধরনের আচরণ কেবল গোলামী মনোবৃত্তি ও অনুগত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সম্ভব। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, নেপাল ও ভুটান ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ দুটি ভারত বলয় থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ভারত দেশ দুটির ওপর থেকে তার দীর্ঘদিনের আধিপত্য হারাচ্ছে। শুধু নেপাল ও ভুটানই নয়, ভারতের প্রতিবেশি বৃহৎ দুই দেশ চীন ও পাকিস্তানের সাথে তার দীর্ঘদিন ধরে টানাপড়েনের সম্পর্ক চলছে। সর্বশেষ মালদ্বীপও তার খবরদারির ব্যাপারে হুশিয়ার করে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া ভারত তার প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, একঘরে হওয়ার দিকে দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এর জন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে তার আধিপত্যবাদী ও দাদাগিরিসুলভ মনোভাবই দায়ী। প্রতিবেশি দেশগুলোর সরকার ও জনগণ ভারতের এই আচরণকে আর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে। ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত স্পর্শকাতর মন্তব্য এবং বিরূপ আচরণ করলেও আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এর যথাযথ জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যাচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতির এই দুর্বলতার সুযোগে ভারতের মন্ত্রী থেকে শুরু করে পদস্থ কর্মকর্তারা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবর্হিভূত মন্তব্য করেছেন এবং করছেন। দেখা যাচ্ছে, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেনার পর থেকেই ভারতের সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। ভারতের এই আচরণ থেকেই বোঝা যায়, সে চায় না ভারত ছাড়া বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পর্ক জোরদার করুক।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বহুমুখী এবং কারো সাথে শত্রæতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। আমরা দেখছি, ভারতের ক্ষেত্রে এ নীতির ব্যত্যয় ঘটছে। দেশটি আমাদের সাথে বিরূপ আচরণ ও মন্তব্য করলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনোরূপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা বাদ-প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে। দেশের মানুষ ক্ষুদ্ধ হলেও তার কোনো বিকার হয় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নীরবতা এবং বিচলনহীন আচরণ আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মালদ্বীপের মতো দেশ যেখানে ভারতকে ধমক দিয়ে কথা বলে, সেখানে আমরা আমাদের ন্যায্য কথাটুকু পর্যন্ত উচ্চারণ করছি না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কথাটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে যে, বন্ধুত্ব মানে নতজানু হয়ে থাকা নয়, পারস্পরিক সমঅধিকার নিয়ে থাকা। আমরা মনে করি, ভারতের যে কোনো অন্যায্য আচরণ এবং বক্তব্য কূটনৈতিকভাবে জবাব দেয়া অপরিহার্য। কোনোভাবেই তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। আমাদের আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন