রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

গঙ্গা ব্যারাজ এবং ভারতের আপত্তি

প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবি সিদ্দিক
গঙ্গার পানি চুক্তি অনুযায়ী যখন বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে যখন ভারতের অনীহা, তিস্তা সেচ প্রকল্প যখন কার্যত অচল তখন গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের প্রয়োজনটা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে। কিন্তু ভারত আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এটা তাদের সা¤্রাজ্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ করে উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ  ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উত্তরও পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা ও তার অনেক শাখা নদীই শুকিয়ে গেছে। সেচ সংকটসহ নৌপরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে। তারা প্রত্যেকটি অভিন্ন নদীতে বাঁধ, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, রিজার্ভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানি আটকে রেখেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পরিমাণ মতো পানির থাকছে না। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিতে বন্যায় ভাসছে দেশের মানুষ।
ভারত শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো বহু ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। কৃষি সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবেশÑ সবই নদীনির্ভর। অর্থাৎ নদীকে বাদ দিয়ে এ দেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন কল্পনাই করা যায় না। সংখ্যার দিক থেকে মতপার্থক্য থাকলেও কমপক্ষে চারশত নদ-নদী জালের মতো বিস্তার করে আছে পুরো দেশে। বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, কখনো যদি ৮ রিখটার স্কেলে কোনো ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয় তাহলে প্রধান প্রধান নদীগুলোর প্রবাহপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এ চারটি নদীর ওপর আঘাত এলেই এর অন্তর্গত শাখা ও উপনদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শুকিয়ে যাবে। মূল নদী ও উপনদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বহু পানির উৎস চিরতরে হারিয়ে যাবে। পানির অভাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে। তাই সর্বপ্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। পানি সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবেও সমাধান করা যাবে না। গঙ্গার পানি বণ্টনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন করা যেতে পারে। পানি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ বিনির্মাণে এখনই সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এদিকে গঙ্গা ব্যারাজের নির্মাণের উদ্যোগ নিতেই ভারত আপত্তি জানায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত মূল ব্যারাজটি বাংলাদেশÑভারত সীমান্তের ৮২ কিলোমিটার ভাটিতে এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে ৫২ কিলোমিটার ভাটিতে অবস্থিত। বাংলাদেশে গঙ্গার পানিনির্ভর এলাকা ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার  বলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বলা হয়েছে। গঙ্গা ব্যারাজ ২৯০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণযোগ্য একটি বিশাল জলাধার সৃষ্টি করবে। জলাধারটি পাংশা থেকে পাংখা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। গঙ্গানির্ভর এলাকায় ১২৩টি আঞ্চলিক নদীতে পানি পৌঁছে দেয়া হবে। জলাধারের পানি প্রকল্প এলাকায় সারা বছর সেচ, মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন, পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন (১১৩ মেগাওয়াট) নৌ-পরিবহন, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, পানি সমস্যা সমাধান হচ্ছে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রকল্পের সমীক্ষার আলোকে ব্যারাজ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ডিটেইলড নকশা তৈরির কাজ শেষ করা হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ প্রাপ্তির জন্য প্রকল্পের প্রিলিমিনারি ডিপিপি ইআরডিতে আর প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন আছে।
ভারত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সহায়তার অনুপস্থিতিতে এ প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নেয়া কঠিন হবে। দিল্লি ২০১৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। এতে বলা হয়, ভারতের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা ঢাকার প্রেরিত নথিপত্র মূল্যায়ন করেছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বাঁধের কারণে উল্টো ¯্রােতে ভারতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ভারত চিঠিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে, নদীর পানির মাত্রা সামান্য একটু বৃদ্ধি পেলেই ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে ব্যাপক পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। দিল্লি ঢাকার কাছে বৈজ্ঞানিক মডেলসহ পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নথি চায়, যাতে করে সে নিশ্চিত হতে পারে যে, এ বাঁধের ফলে ভারতীয় এলাকায় পানির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে না। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, ভারত যেসব নথিপত্র চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে ইতোমধ্যে তার সবই পাঠানো হয়েছে। তবে দিল্লি এখনো সাড়া দেয়নি। জাতিসংঘের পানি ও পরিবেশ বিষয়ক সাবেক মহাপরিচালক ড. এস আই খান মনে করেন, ভারত নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রকল্পকে আটকিয়ে রাখতে পারে। অথচ বিদ্যমান বাস্তবতায় এ প্রকল্পের আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন