মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী
২ মার্চ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৩৭ সালের এই দিন মাদরাসা শিক্ষকদের এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রাণপুরুষ এবং দীর্ঘ তিন দশকের লাগাতার সভাপতি, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আলহাজ¦ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) এর ইন্তেকালের পর তার সুযোগ্য পুত্র ইনকিলাবের সম্পাদক আলহাজ¦ এ এম এম বাহাউদ্দীন এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের সভাপতি হিসেবে বিগত এক যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
জমিয়াত ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠালগ্নে থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দশ বছর ব্রিটিশ পরাধীন আমল প্রত্যক্ষ করেছে। অতঃপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত ২৪ বছর পাকিস্তান দেখেছে। এরপর ১৯৭৬ সাল হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে জমিয়াতের এক শানদার যুগ কেটেছে। অতঃপর আলহাজ¦ এ এম এম বাহাউদ্দীনের যুগ চলছে।
মাওলানা মরহুমের পরবর্তী যুগের আলোচনার শুরুতে বলে রাখতে চাই যে, নব নির্বাচিত সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের কেন্দ্রীয় নেতৃ বৃন্দসহ অরাজনৈতিক ও ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের এক বিরাট প্রতিনিধিদল নির্দিষ্ট তারিখে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করেন। উচ্চ পর্যায়ের এ প্রতিনিধিদল বিশেষ করে অ্যাফিলিয়েটিং ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ইসলামী আরবী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও এর যৌক্তিকতা, ফাজিল ও কামিলের মান অর্থাৎ ফাজিলকে ব্যাচেলর ও কামিলকে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের সংযুক্ত এবতেদায়ী মাদরাসার অনুরূপ, নিয়মিত স্কেলভুক্তকরণ ও নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারিকরণ ও নতুন জাতীয় বেতনে বেসরকারি আওতাভুক্তকরণের বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়। সবার দস্তখত সম্বলিত স্মারকলিপি শিক্ষামন্ত্রীর হাতে প্রদান করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী সকল দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং সরকার এগুলো বিবেচনা করবে বলে আশ^াস প্রদান করেন। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের বিষয় আসে। তারও তারিখ ধার্য হয়। নির্ধারিত তারিখে এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াতের প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন। প্রধানমন্ত্রী সব দাবি দাওয়ার কথা শোনেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোন কোন দাবি পূরণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান ও সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস প্রদান করেন। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম জমিয়াতের পক্ষ হতে দাবি করা হয়েছিল জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার। কেবল এ দাবিটি পূরণের ঘোষণা সরকারিভাবে জারি করা হয় এবং বাকি দাবিগুলো পূরণের আশায় থাকতে হয় জমিয়াতকে।
এক বিবরণ হতে জানা যায় যে, এ এম এম বাহাউদ্দীন তার মহান পিতার অসুস্থ অবস্থায় জমিয়াতের সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যে দাবিটি পূরণে সরকারের পক্ষ হতে সক্ষম হন তা হচ্ছে, জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু অন্যান্য দাবি প্রতিশ্রæতি ও বিবেচনার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় কেবল আশার আলো দেখে নীরব থাকা সমীচীন মনে না করে, এ এম এম বাহউদ্দীন তার পিতার পদাংক অনুসরণ করে গণসংযোগের পথে অগ্রসর হন এবং জমিয়াতকে সঙ্গে নিয়ে নানা স্থানে সভা, সমাবেশ, সম্মেলন অনুষ্ঠানের পন্থা অবলম্বন করেন। এ পর্যায়ে প্রথম সম্মেলনটির আয়োজন করা হয় দেশের সর্ব দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের সৈকত শহর কক্সবাজারে। কক্সবাজার শহরে ভরে যায় মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীর সমাগমে। উপস্থিত জনতার পক্ষ হতে জমিয়াত কর্মকর্তাদের জ্ঞাপন করা হয় বিপুল অভিনন্দন। উপস্থিত জনতার মধ্যে হতে নানা শ্রেণীপেশার বক্তারা তাদের বক্তব্য রাখেন এবং জমিয়াতের দাবিগুলোর প্রতি সমর্থন জানান। এভাবে শুরু হয় জমিয়াত প্রধানের নেতৃত্বে দেশময় গণসংযোগের অব্যাহত ধারা। অতঃপর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ জেলা শহর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী এবং উত্তর বঙ্গের অন্যান্য শহর-বন্দরে অনুষ্ঠিত হতে থাকে অনুরূপ গণসংযোগ-সম্মেলন এবং সর্বত্রই জমিয়াতের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা, আনুগত্য ও দাবি দাওয়ার প্রতি সমর্থন-স্বীকৃতি প্রকাশ পেতে থাকে এবং তার কন্ঠেও বের হয়ে আসতে থাকে মাদরাসা শিক্ষকদের মনের কথা, তাদের দাবি-দাওয়ার কথা, সংকট-সমস্যার কথা। একই সঙ্গে তার পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবে তা সবিস্তারে প্রকাশিত হতে থাকে। অচিরে তার সুনাম, খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। জমিয়াতের নামও ব্যাপকভাবে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। জমিয়াত প্রধান এ এম এম বাহউদ্দীন বিভিন্ন সম্মেলনে যেসব বক্তব্য রাখেন তার সংক্ষিপ্ত সার এই:
যারা এ শিক্ষাকে মিটিয়ে দিতে চায়, এর ভূমিকাকে অবমূল্যায়ণ করে, তাদের হীন উদ্দেশ্য কোন দিন সফল হবে না। মাদরাসা শিক্ষা কুরআন-সুন্নাহর মূল শিক্ষা। মক্কা মোয়াজ্জমা দারে আরকাম ও মদীনা মুনাওয়ারার পবিত্র মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে বিশ্ব নবী (স.) এই শিক্ষা প্রবর্তন করেন। সেই থেকে এই পর্যন্ত এ শিক্ষা চলে এসেছে। কোন প্রতিবন্ধকতা এর অগ্রগতি প্রতিহত করতে পারেনি। কিয়ামত পর্যন্ত এ শিক্ষা জারি থাকবে। যারা একে ধ্বংস করতে চাইবে, ধ্বংস হবে তারাই। যারা একে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ শিক্ষায় শিক্ষিতগণই যুগে যুগে মানব সভ্যতা বিকাশে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় অশেষ অবদান রেখেছেন। আমাদের ওলামা-মাশায়েখগণ এ উপমাহাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। এরই বদৌলতে আমাদের জনগণ ইসলামী ভাবধারা ও চেতনায় সম্মৃদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আলিয়া নেসাবের মাদরাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষা দেওয়া হয়। আর কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ইত্যাদি ইসলামী মূল বিষয়গুলোও আবশ্যিকভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। ইসলামের মূল বিষয়সমূহ এবং আধুনিক বিষয়াবলীর সুসমন্বিত রূপ হচ্ছে এই শিক্ষা। কিন্তু এর যথার্থ মূল্যায়ণ হচ্ছে না। প্রাপ্য স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। এ জন্যই আমাদের দাবি হচ্ছে, ফাজিলকে ব্যাচেলর এবং কামিলকে মাস্টার্স ডিগ্রি দিতে হবে যাতে এ শিক্ষা দ্বারা ডিগ্রি ধারীরাও বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। জাতীয় মেধার অপচয় রোধের জন্য এটা অপরিহার্য।
জমিয়াতের গণসংযোগের অব্যাহত ধারা এবং নবাগত সভাপতির তৎপরতার ফলে সংগঠনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়, বেগমান ও শক্তিশালী হয়ে উঠে জমিয়াত। জমিয়াতের ক্রমবর্ধমান এ উন্নয়ন তৎপরতা এক পর্যায়ে জমিয়াতবিদ্বেষীদের চক্ষুশূল হয়ে দেখা দেয়। তাদের ধারণা ছিল, জমিয়াতের প্রাণ পুরুষ এম এ মান্নান (রহ) এর অবর্তমানে তার এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠন মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হলো ভিন্ন। জমিয়াত আরো তীব্র গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে এবং গতিশীল নেতৃত্বে জমিয়াত তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ওরা মনে করেছিলো, একে প্রতিহত বা নস্যাত করতে হলে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এটি ছিল সরাসরি জমিয়াতবিরোধী ষড়যন্ত্র। জমিয়াতবিরোধী বিদ্বেষী চক্রটি এ সংগঠনকে বিভক্ত করে মাদরাসা শিক্ষকদের বৃহত্তর ঐক্যে ফাটল ধরানোর নীল নকশা প্রস্তুত করে এবং তারই অংশ হিসেবে একটি পাল্টা জমিয়াত গড়ে তোলে এবং বিভক্ত সংগঠন হিসেবে আলাদা সভাপতি ও অপরাপর কর্মকর্তা সদস্যদের আলাদা নাম ঘোষণা করা হয়। ফলে জনমনে তৈরি হতে থাকে জমিয়াত সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তি। এ ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে জমিয়াত সমর্থক ইসলামী নেতৃবৃন্দ, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি নানা পেশা ও শ্রেণীর মানুষ। জমিয়াত বিদ্বেষী এ মহলের প্রতিবাদে মাঠে নেমে আসেন ফুলতলীর পীর ছাহেব কেবলাসহ দেশের খ্যাতনামা আরো বহু পীর-মাশায়েখ, ওলামা এবং সংগঠন প্রভৃতি। আলহাজ¦ এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে পরিচালিত জমিয়াতের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের ফলে অচিরেই নিভে যায় জমিয়াত বিদ্বেষীদের জ¦ালানো আগুন এবং ভাঙ্গনের হাত হতে রক্ষা পায় বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন।
(অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন