বহু বছর ধরেই দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে যখন ক্ষমতায় কিংবা বিরোধী দলে থাকে, তখন তাদের নেতাদের মুখ থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কথা আমরা শুনে আসছি। ক্ষমতাসীন দল মনে করে বিরোধী দল তাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে দিনরাত ষড়যন্ত্র করে। আর সরকার তা মোকাবেলা করতে করতে ঠিক মতো শাসন কাজ চালাতে পারে না। এর বিপরীতে বিরোধী দল থেকে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দল তাদের নিঃশেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে, কে যে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বা করছে, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। তারা ষড়যন্ত্রের কথা শোনে, তবে কীভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা জানে না বা জানতে পারে না। ফলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট থেকে যায় এবং তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় না। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের তত্ত¡ পলিটিক্যাল রেটরিক বা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যেসব রাজনীতিক তথ্য-প্রমাণবিহীন ষড়যন্ত্রের কথা বলেন তারা কি বোঝেন না, প্রযুক্তির এই যুগে এ ধরনের কথা সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন? তারা কি জানেন না, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে কোনো ঘটনাই এখন গোপন থাকে না, মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে? এখন সময় বদলেছে, সাধারণ মানুষ রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে অনেক খোঁজ-খবর রাখে। কথার মারপ্যাঁচে তাদের মনভোলানো সহজ নয়। কারণ এখন রাজনৈতিক বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনার নেপথ্যের কাহিনী এবং কে কখন কোন কথা বলেছিলেন তা জানা অত্যন্ত সহজ। উইকিলিস, পানামা পেপারস বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ তা জানতে পারছে। কাজেই রাজনীতিবিদরা যদি বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক না হন, তবে তা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবে। আর ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগ যখন করা হয়, তখন তা বিশ্বাসযোগ্য না হলে সাধারণ মানুষের কাছে খেলো হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা শুনছি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে দেশে-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বলেছেন, কোথায় কোথায় চক্রান্তের বৈঠক চলছে, আমরা জানি। পর্যবেক্ষণ করছি, খোঁজখবর আমাদের কাছে আছে। বলা বাহুল্য, তিনি এ কথা বলেছেন বিএনপিকে উদ্দেশ করে। এর অর্থ হচ্ছে, বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে ষড়যন্ত্র করছে এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। ওবায়দুল কাদেরের এ কথার পাল্টা জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে এবং এই ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে সে চোরাবালিতে আটকে পড়েছে। পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্যের ফলে বিষয়টি পরিণত হয়েছে প্রথাগত রাজনৈতিক রেটরিকে।
দুই.
ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করে বলেছেন, চোরাগলি দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাইছে বিএনপি। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন উপায়ে বা চোরাগলি যেভাবেই হোক না কেন, ক্ষমতায় আসা সম্ভব? এভাবে ক্ষমতায় আসার নজির কি আমাদের দেশে আছে? নেই। বরং ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার অভ্যন্তর থেকেই ক্ষমতা হটানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য নজির রয়েছে। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ উদ দৌলার পরাজয় এবং ক্ষমতাহারা হওয়ার পেছনে ইংরেজদের মদদ এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট সেনাপতি মীর জাফরের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা সকলেরই জানা। ’৭৫-এ স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার ঘটনার পেছনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক জন বড় বড় নেতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করার বিষয়টিও সবাই অবগত। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্টজন খন্দকার মোশতাক আহমদের কথা প্রথমেই স্মরণ করা যায়। তাকে মীর জাফরের সাথে তুলনা করা হয়। তিনি ও তার কিছু সঙ্গীসাথীর বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ড ঘটে এবং পরবর্তীতে তাদের মন্ত্রীসভাও গঠন করতে দেখা যায়। এর নেপথ্যে বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথাও বিভিন্ন পুস্তক ও গবেষণায় উঠে এসেছে। সেই সময় অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে বন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি ক্ষমতাসীন হন। ক্ষমতায় এসে তিনি রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় আসে। ’৮১ সালের ৩০ মে বিপদগামী কিছু সেনা সদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপিই ক্ষমতায় ছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে সরিয়ে মার্শাল ল জারি করে নিজেকে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (সিএমএলএ) ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, বিএনপিকে পরাজিত করে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসেনি। জোর করে, বন্দুকের নলের মুখে এসেছে অরাজনৈতিক শক্তি। তবে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমর্থনসূচক ‘নট আনহ্যাপি’ বা ‘অখুশি’ নই বলে বক্তব্য দেয়া হয়েছিল। তার মানে এই নয়, আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতায় বসে। বহু বছর পরে ২০০৭ সালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপিকে হটিয়ে যখন আর্মি ব্যাকড ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তখনও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল। অর্থাৎ তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো যে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে, তাতে তারা ক্ষমতাসীন হতে না পারলেও একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেয়। তখন যদি বিএনপি এই সময়ের মতো প্রশাসনিক যন্ত্রকে কঠোরভাবে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন চালিয়ে এবং সংবিধনের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের মতো বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতা ও ভোটারবিহীন একটি যেনতেন নির্বাচন করতো, তবে কি তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হতো? হয়তো হতো না। বিএনপি এ কাজটি করেনি বলেই তার পতন হয়েছিল। তবে তাতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়নি। কাজেই আওয়ামী লীগ এখন বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চোরাগলি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার যে অভিযোগ তুলছে, তা কি গ্রহণযোগ্য? কারণ আমাদের দেশে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার যেমন নজির নেই, তেমনি সুযোগও নেই। তবে এটা ঠিক, ক্ষমতাসীন দলকে হটাতে বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের কারণে তৃতীয় শক্তির ক্ষমতায় আসার নজির রয়েছে। এ আন্দোলন ষড়যন্ত্র কিনা বা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ কিনা অথবা আমি ক্ষমতায় যেতে পারব না, তাই তোমাকেও ক্ষমতায় থাকতে দেব না-এমন বিষয় কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাহলে তা কীভাবে সম্ভব? বিএনপিতো কোনো সশস্ত্র বাহিনী নয় যে, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। তার একমাত্র পথ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া এবং জনগণ যদি তাকে বিজয়ী করে, তবে ক্ষমতাসীন হওয়া। এর বাইরে তার আর কি পথ থাকতে পারে? ওবায়দুল কাদের যে বললেন, বিএনপি চোরাগলি দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, সেই চোরাগলিটি কি? তার ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষ চাইতেই পারে। তিনি যদি এটা বুঝিয়ে থাকেন, চোরাগলিটি তৃতীয় কোনো শক্তি, তবে প্রশ্ন আসতে পারে সেই শক্তির কী এমন ঠেকা পড়েছে নিজে ক্ষমতা না নিয়ে বিএনপিকে বসিয়ে দেবে? কাজেই শুধুমাত্র বিরোধী দলকে ঘায়েল করার জন্য সরকারের তরফ থেকে এমন কোনো অবিশ্বাস্য বক্তব্য দেয়া উচিত নয়, যা অযৌক্তিক এবং অবাস্তব। কেবল মেঠো বক্তৃতা দিয়ে ক্ষমতা থেকে হটানোর ষড়যন্ত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পলিটিক্যাল রেটরিক করা সমীচীন নয়।
তিন.
অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে বেশ অনীহা প্রকাশ করে আসছে। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও বিনাভোটের নির্বাচনের পর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাকিদ দিলেও দলটি তা আমলে নেয়নি। উল্টো তাদের বকাবকি ও তিরষ্কার করে তুলোধুনো করেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রসঙ্গটি আনা যায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা নিয়ে মজিনার তৎপরতায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে, দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মজিনাকে বাসার কাজের মেয়ে মর্জিনার সাথে তুলনা করতে ছাড়েননি। তাকে দু’আনার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, মর্জিনারা কি বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। এতে মজিনা রাগ বা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। তবে মেয়াদ শেষে তাকে অনেকটা অসম্মানের সাথেই বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছিল। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ বা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে একটা কথা আছে। এ মাসের শুরুতে তাই যেন দেখা গেল। গত ১ মার্চ ২৫তম ইউএস ট্রেড শো’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে আহ্বান করেছেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে ভূমিকা রাখার জন্য। তোফায়েল আহমদ আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বার্নিকাট এমন একটি ভূমিকা নেবেন, যাতে সব দল সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জবাবে বার্নিকাট কূটনৈতিক ভাষায় বলেছেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্তগুলো কেবল ভোটের দিন নয়, সব সময়ই নিশ্চিত করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারক আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ করানোর জন্য হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন? যে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমতাসীন দল দুই চোখে দেখতে পারে না এবং জিএসপি পাওয়া নিয়ে এই তোফায়েল আহমদই ক্ষুদ্ধ হয়ে একাধিকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি না পেলেও চলবে বা জিএসপির আশা আর করি না, সেই তিনিই যখন আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান, তখন খটকা লাগা স্বাভাবিক। এ কথা তো তিনি সরকারের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্রদেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বলতে পারতেন। কারণ, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ভারতের অযাচিত ও প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকার একটুও দ্বিধা করেনি। ওই নির্বাচন কোনো দিনই হতো না, যদি না তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি ও সরকারের বাইরের অন্যান্য দলকে বাদ দিয়ে এরশাদকে নিয়ে নির্বাচন করার সব ব্যবস্থা না করে দিয়ে যেতেন। এ প্রেক্ষাপটে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভারতের সহায়তা চাওয়াই ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্বাভাবিক। কারণ, সরকার সবসময় দাবী করে আসছে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সর্বকালের সবচেয়ে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সহায়তা করার জন্য ভারতই উপযুক্ত মধ্যস্থতাকারী হতে পারে। তা না করে সরকারের চক্ষুশূল যুক্তরাষ্ট্র এবং যে কিনা ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনকে কখনোই সমর্থন করেনি, তাকে কেন মধ্যস্থতা করার আহবান জানালো? এটা কি সরকারের নতুন কোনো কৌশল? নিশ্চয়ই কৌশল। এ থেকে মনে হতে পারে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সহায়তা করে ভারত যে বিতর্কে জড়িয়েছে, পুনরায় তাকে একই বিতর্কে জড়ানো ঠিক হবে না। কিংবা ভারতও এবার প্রকাশ্যে না এসে নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রাখতে চাইছে। অথবা ভারতই চাইছে, সরকার যেন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার কাজটি করে। যাকে বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। আবার এটাও হতে পারে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, তা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, এ সুবাধে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েই কাজটি করাতে চাইছে ভারত। যেহেতু ভারত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে একবার জড়িয়ে বিতর্কিত হয়েছে, তাই পরবর্তী নির্বাচনে তার এ সময়ের ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখার জন্য সামনে ঠেলে দিতে চাইছে। এর অর্থ হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া মানে ভারতেরই সহায়তা চাওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্ষমতাসীন দলের আচরণ এমন হতে পারে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত সহায়তা করায় যেভাবে তার চাহিদা পূরণ করা হয়েছে, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাও পূরণ করা হবে। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের মনোভাবই হচ্ছে, যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে হবে এবং এতে যা হওয়ার হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার এ প্রস্তাব নিয়ে দেশটি হয়তো গভীরভাবেই চিন্তাভাবনা করবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও এমন একটি দেশ যে কিনা ভারতের মতোই তার স্বার্থের হিসাবটি কড়ায়-গন্ডায় করে। সে যখন দেখবে তার স্বার্থ উদ্ধার হবে, তখন নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াল? যেখানে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সবসময় বিএনপিকে তিরস্কার করে বলেন, বিএনপি একটি নালিশ পার্টি, দলটি কেবল বিদেশিদের কাছে নালিশ করে বেড়ায়, সেখানে যখন তার দলেরই একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক এবং মন্ত্রী আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান, তখন কি এ নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিাযোগ বা তিরস্কার করা সাজে? মধ্যস্থতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান করার আরেকটি বিশ্লেষণ এমন হতে পারে যে, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সরকারের মধ্যে নার্ভাসনেসও তত বাড়ছে। এর কারণ, বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ায় তার ভিত্তি যে দুর্বল, তা এখন অনুভব করছে। এ দুর্বলতার সুযোগে এবং নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত করা না যায়, তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে যদি অসাংবিধানিক কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটে, তাহলে সরকারের পক্ষে তা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এ আশঙ্কা থেকে যাতে মুক্ত থাকা যায়, তাই এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কারণ ওয়ান-ইলেভেন সরকার আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসকে সবচেয়ে ব্যস্ত এবং কার্যকর ভূমিকায় দেখা গেছে। সরকার হয়তো মনে করছে, যদি তৃতীয় কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটে, তবে এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে দেখা যেতে পারে। কাজেই এখন থেকেই যদি যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজ করা যায়, তাহলে হয়তো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের মতো ঘটনা ঘটবে না। বিষয়টি এরকম, শত্রুকে আগেভাগে বগলদাবা করে ফেলা।
চার.
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি কোন উপদেশ খয়রাতের দিকে আওয়ামী লীগ তাকিয়ে নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশি চাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমরা আমাদের বিবেকের চাপ এবং বাংলাদেশের জনগণের চাপকে গুরুত্ব দেই। আমাদের দেশের গণতন্ত্র আমরাই পরিচালিত করব। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার এ কথার বাস্তবায়ন হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতো দেশের জনগণ। তবে তারা দেখেছে, ওবায়দুল কাদেরের এ কথা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সাথে কোনোভাবেই মেলে না। ওই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় সরকার নির্বাচিত হয়েছে এবং সে নির্বাচনটি ভারতের হস্তক্ষেপে হয়েছে। এখানে জনগণের চাপকে আমলে নেয়া হয়নি। বরং প্রতিবেশি দেশের পরামর্শ ও সহায়তায় ভোটারবিহীন নির্বাচন করা হয়েছে। এ বিবেচনায় ওবায়দুল কাদেরের এ কথা জনগণের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। বলা বাহুল্য, গেøাবালাইজেশনের এ যুগে পুরো বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। গ্রামে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে একে অপরের মধ্যে মতৈক্য, পারস্পরিক সহযোগিতা থাকতে হয়। নিজস্ব মর্যাদা সমুন্নত রেখে একজনের কথা আরেকজনকে শুনতে হয়। আবার একচোখা নীতি অবলম্বন করে শুধু একজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাকীদের দূরে ঠেলে দেয়াও ঠিক নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার যেভাবে শুধু ভারতকে কাছে টেনে নিয়ে বাকীদের দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং তাদের কথা উপেক্ষা করেছে, তা যে সঠিক হয়নি, এখন হয়তো উপলব্ধি করছে। ওবায়দুল কাদের যেভাবে বিদেশিদের উপদেশ প্রয়োজন নেই বলেছেন, তা ‘বিশ্বগ্রাম’ পটভূমিতে যথাযথ নয়। আবার শুধু একজনের সাথেই সুসম্পর্ক থাকলে চলবে, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সকলের সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জরুরী। বাংলাদেশের যেসব বন্ধুরাষ্ট্র রয়েছে এবং যাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, তাদের বন্ধুত্বসুলভ পরামর্শ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দোষের কিছু নেই। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন করার ক্ষেত্রে বিদেশিদের উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। এর একাধিক নজির রয়েছে। যেহেতু ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল নিজেরা সংকট সমাধান করতে পারছে না, তাই সবপক্ষের সমান অধিকার নিশ্চিতে সমঝোতার লক্ষ্যে বিদেশি সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো দেশের সহযোগিতা না চেয়ে বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়াই হয়তো যুক্তিযুক্ত হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন