শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য

| প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুর্শিদা খানম: নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে সমাজ-পরিবার যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা পুষিয়ে নেয়া রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন হয়। সহিংসতা নারীকে কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধা দেয়, মেয়ে শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধাগ্রস্থ করে। পোশাক শিল্পে নারী কর্মী, বিদেশে কর্মরত গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র ঋণে সৃষ্ট নারী উদ্যোক্তাদের শ্রম অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা এসব অগ্রগতিকে রুদ্ধ করছে। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী বিবাহিত জীবনে কমপক্ষে এক বা একাধিক বার নির্যাতনের শিকার হয়। (ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইম্যান সার্ভে ২০১৫)। এই জরিপে বেরিয়ে এসেছে, পরিবারে নারী স্বামী কর্তৃক শুধু শারীরিক নয়, মানসিক, আর্থিক, আচরণগত নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। সহিংসতার শিকার এসব নারীর খুব কম সংখ্যকই প্রতিকারের জন্য অভিযোগ দাখিল করে থাকে। কারণ, তাদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে অসেচতনতা, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দুর্নামের ভয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক অসহযোগিতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে, রাস্তাঘাটে চলাফেরার ভয়, গৃহে ও কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হবার ভয় নারীদের আত্মস্বাবলম্বিতা অর্জনে সুযোগ-সুবিধা সীমিত করে দেয়। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংতার কারণে ক্ষতি হয় মোট দেশজ উৎপাদনের আনুমানিক ২ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ এই নারী পারিবারিক এবং অর্থনেতিক উন্নয়নে পুরুষের সহযোদ্ধা।
নারীরা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হওয়ার পরও যদি অর্থনীতিতে অবদান রাখতে না পারে তাহলে অর্থনৈতিক মুক্তি, সমৃদ্ধ সমাজ আর মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার স্বপ্নযাত্রা সফল হবে কি? একজন নারী সবসময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশী, তারা সবসময় নিজ পরিবারে দারিদ্র্য দূর করতে চায়। এ লক্ষ্যে নিজ পরিবার পরিচালনা করে। প্রয়োজন, অর্থনীতিতে নারীর সম-অংশীদার, সম-মূল্যায়ন। ব্যাংক এবং দাতা গোষ্ঠীদের উচিত নারীদের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা। অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে নারীকে বিশেষ সুযোগ দিয়ে কর্ম উপযোগী সামর্থ্যসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ব্যক্তিকে রাষ্ট্র কোন কিছু দিলেই সেটা দেওয়া হবে না। সেটি গ্রহণ করার মতো ব্যক্তির সামর্থ্য থাকতে হবে। অর্থাৎ তিনি ব্যক্তির সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন, ‘সক্ষমতার শিক্ষার’ কথা বলেছেন। শিক্ষা সমৃদ্ধ অহিংস সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য মূল লক্ষ্য হতে হবে কোন প্রকার নিগ্রহ আর সহিংসতার ভয় ছাড়াই নারীর সমাজে বেঁচে থাকার সক্ষমতা অর্জন করা।
রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন-ক্ষমতায়নে স্বাধীনতার ৪৬ বছরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রী, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পুলিশ, শিক্ষক, সেনাসদস্য, চিকিৎসক, সচিব, বৈমানিক, আইনজীবী, বিচারক, উদ্যোক্তা, ক্রিকেটার, পর্বতশৃঙ্গ বিজয়ীসহ নারীর পদাচরণা সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। দুর্গম পথ পেরিয়ে নারীর এগিয়ে চলার পাশাপাশি, পারিবারিক-সামাজিক নির্যাতন, যৌতুক, যৌন-নিপীড়ন, হত্যাসহ নতুন নতুন অত্যাচারের শিকার নারী সমাজ। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩) অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য করবে না। কিন্তু প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে সমঅধিকার তো দূরের কথা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারীরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাজনীতিতে নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষদের সমান বা কিছুটা বেশি। জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৬টি। এর মধ্যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত চাকুরের সংখ্যা ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৯ জন। নারী চাকুরজীবী হলেন ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৪ জন। শতাংশের হিসেবে দাঁড়ায় ২৪.১৮ শতাংশ চাকুরে নারী।
এছাড়াও সমাজে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বঞ্চনার দিক লক্ষ্যণীয়। রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ এখনও মনোনয়নের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী থাকা সত্তে¡ও অল্প সংখ্যক ছাড়া বেশির ভাগ নারী কালো টাকা ও পেশি শক্তির প্রভাবে জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি মনোনয়ন পাচ্ছে না। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনই নারীর জন্য অন্যতম বিকল্প হিসেবে থেকে গেছে। সংসদে কোরাম পূরণ, হ্যাঁ-না ভোটে আইন প্রণয়নে ভ‚মিকা ছাড়া সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মানা হলেও বিগত ১০ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ। অন্যদিকে, ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ বিয়ের বয়সসীমা শিথিল করে যে ‘বাল্য বিবাহ আইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে, এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে ব্যাহত হবে সামষ্টিক অর্থনীতি।
লেখক: রাজনীতি ও শিক্ষাবিষয়ক পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন