আমেনা, যাতো গরুটা নিয়ে আয়।
হ্যাঁ মা যাচ্ছি।
মা, দেখো।
আমেনা তাদের উঠোনে দাঁড়ায়ে মাকে বলছে।
মা উত্তর করল:
কি হয়েছে?
মা, দেখো একটা শালিক পাখি।
মা একটু বিরক্তির স্বরে বললো:
হ্যাঁ! একটা শালিক পাখি তো কি হয়েছে? আমেনা বললো:
না মা, এটা একপা ওয়ালা শালিক পাখি।
আমেনার মা বেলা দৌড়িয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালো। আর তার দৃষ্টিতে পড়ল একটা শালিক। যেটি এক পায়ের উপর ভর করে খাদ্য কুড়িয়ে খাচ্ছে। তার সাথে অন্যান্য শালিক গুলো কি দূর্দমে দু’পায়ের উপর ভর করে মাটি সরিয়ে নখ চালিয়ে খাদ্য খাচ্ছে। আর সেখানে এই শালিকটা বেশ কষ্ট করে এক পায়ের উপর দিয়ে না পারছে মাটি হাঁচড়াতে না পাড়ছে নখ চালিয়ে পোকা মাকড় খেতে। অন্যান্য শালিকগুলো কি হৃষ্ট পুষ্ট! আর এটি বেশ শীর্ণ হয়ে গেছে। শালিকটিকে দেখে ভাবতে ভাবতে বেলা তার মেমোরিকে রিকল করে চলে যায় দু’বছর পূর্বে এক ভর দুপুরে। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে চতুর্দিক যেন ঝলসে যাচ্ছে। চালা গ্রামের সবাই একটা পরিচিত আঁতংকে দিন কাঁটাচ্ছে। সবার চোখে মুখে আঁ তংকের ছাপ। কোন দিক থেকে খবর আসলে সবাই ছোট্ট বাচ্চাদের কোলে নিয়ে দৌড়িয়ে পালায়। লুকায় বাঁশ ঝাড়ের মাঝে। কেউবা লুকায় ধানক্ষেতে। অনেকে ঘরে ধানের ডোলে। কে যেন ওয়াবদা থেকে খবর দিল আসতেছে। আর অমনি বেলা তার ছোট্ট ভাইকে সাথে নিয়ে একমাত্র মেয়ে আমেনাকে কোলে নিয়ে দৌড় গাঁড়ামাসির ধানক্ষেতে।
ধানক্ষেতে বসে নিঃশব্দ। নিশ্চুপ। ধানক্ষেতে এমনিতে গরম। আবার চরম রোদ। রোদ আর গরম মিলে এক ঘর্মাক্ত ও শ্বাসরোধক অবস্থা। হ্যাঁ এদিক দিয়েই যাচ্ছে পাকিস্থানি বাহিনী। মনে মনে বড় দোয়া পড়ে। আর দু’হাত দিয়ে ছোট্ট ভাই ও মেয়ের মুখ চেপে ধরে আছে যাতে ছোট্ট মানুষ ভুল করে কোন শব্দ না করে। বেলা ভাবছে জান বুঝি এবার যায় চলে পাক বাহিনীর হাতে।
দুম দুম শব্দে দুটি গুলির আওয়াজ বেলা শুনতে পেয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গুলির শব্দে বেলার কলিজায় যেন ঢেকির পার শুরু হয়েছিল।
স্বশব্দে পাক বাহিনীর সাঁজোয়া যান গুলো ধানক্ষেতের পাশ বয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে চলে গেল। সন্তর্পণে কান পেতে শুনলো বেলা। কিছুক্ষণ পর ধান ক্ষেতের সীমানার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলো। না ওরা চলে গেছো। ছোট্ট ভাই ও মেয়েকে নিয়ে দ্রæত চলে আসে বাড়িতে।
বাড়িতে এসে দেখে যে অন্যরা হাঁপাতে হাঁপাতে আসল। একি জামেলা এরকম মরা কান্না কাঁদছে কেন? কাছে গিয়ে জামেলারে জিগায়:
এভাবে কাঁদছিস কেন?
কি হয়েছে?
জামেলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠে বলা শুরু করলো:
ও বুবু গো তোর ভাই আর নাই গো বুবু। ওরা এসে তোর ভাইরে ধরে নিয়ে গেল। যেই মাত্র সংবাদ পেলাম যে পাক বাহিনী আসতেছে, অমনি তোর ভাইরে কইলাম পালাও। সে আর আমার কথা শুনলোনা। ঘরের মধ্যে রয়ে গেল। আমি উঠে পড়লাম ধানের ডোলে। দু›টো গাড়ি করে উঠোনে এসে দাঁড়ালো পাক বাহিনীর সৈন্যরা। সাথে ছিল ওদের দোষর রাজাকার মন্টু। মন্টুই পথ চিনে ও বাড়ি দেখায়ে দিয়েছিল। বন্দুক দিয়ে দুটি ফাকা ফায়ার করে বললো:
‘ওসমান কাহাপে? ওহ লারকা মুক্তিফৌজকো খবর পৌঁহছাতা হ্যাঁয়। উছকো এনাম জরুর মিলেগা।’
ঘরের ভিতর ঢুকে তোর ভাইকে টেনে হেচড়ে নিয়ে গেল রে বুবু। আলায় জানে এবার বুঝি আমি আমি বিধবা হয়ে যাই গো বুবু। কতবার অনুরোধ করে বললাম আমরা সাধারণ মানুষ এভাবেই ভাল আছি। মুক্তিফৌজদের খবর পৌছানো তোমার লাগবেনা। অনেকেই তো আছে। সে কি আর আমার কথা শুনে। এখন আমার কি হবে গো বুবু বলে আবার মরা কান্না শুরু।
বেলা জামেলাকে স্বান্ত্বনা দেয় আর বলে:
কাঁদিসনে আল্লায় ফেরৎ দিবো।
বেলা তার ঘরে ঢুকতে গিয়ে আঙ্গিনার এক কোণে দেখে একটা শালিক পাখি আস্তে আস্তে নড়ার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে দেখে যে পাখিটার ডান পা নেই। আর ওইখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। বেলার বুঝে উঠতে দেরি হলোনা যে পাক বাহিনীর গুলিতে শালিকটার পা টা উড়ে গেছে । সে শালিক টাকে ঘরে এনে কাঁটা অংশে হলুদ আর ষরিসার তেল লাগিয়ে দিলো। একটু চাউল ও পানি খাওয়ালো। রাতে বেলা ভাবছে শালিক তুইতো আহত হয়েও সেবা পাচ্ছিস। না জানি ওসমানের কি অবস্থা?
এভাবে তিনদিন পর শালিকটা উড়ে গেলো। কিন্তু পাখিটার মত আহত হয়েও ওসমান ফিরলোনা ঘরে। আজ ১৯৭৩ সালের ১০ই মে। বেলা সেই ৭১ এর একই দিনের ঘটে যাওয়া কাল বৈশাখি ঝড়ের মতো ঘটনার কথা মনে করলো।
সে আফসোস করে বললো:
ওরে শালিক দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে রে। তুইতো সাক্ষী হয়ে আছিস জামেলার বিধবা হওয়ার। তুই বেঁচে থাকলি কিন্তু ওসমান আর ফিরলোনা রে। এভাবে কত জামেলা আজো তার স্বামীর পথ পানে চেয়ে আছে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন