সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

বইয়ের মতো ভালো উপহার নেই

প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
কোনো একটি কাজকে গুরুত্বপূর্ণ করার জন্য বছরের কোনো এক দিন, সপ্তাহ বা পক্ষকে বিশেষভাবে নির্বাচন করার রেওয়াজ স্বীকৃত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কাজকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য উক্ত দিন, সপ্তাহ বা পক্ষকে বেছে নেওয়া হয়, আমরা সেই কাজ না করে প্রচারণায় ব্যস্ত হই। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে ২ এপ্রিল পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশু বই দিবস’। বই পড়ার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্যই এই আয়োজন। বই হচ্ছে শেখবার, জানবার ও জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষা বা জ্ঞান আহরণ ছাড়া কোনো দেশ বা কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। সহজ উপায়ে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়াতে বই অপরিহার্য। তাই আমাদের দেশের আগামী প্রজন্ম ও দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুদের এখন থেকেই প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধানে বই পড়ার প্রতি বিশেষ মনোযোগী করে তুলতে হবে। শিশুকাল হলো মানুষের ভবিষ্যৎ ছাঁচ বা ডিজাইন। এই সময়ে তাকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। পরিণত বয়সেও অনেকে বই পড়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তবে সে ঝোঁকটা যদি শিশুবেলা থেকেই অভ্যাসে গড়ে উঠে তাহলে সেই শিশু ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের ধরাবাধা শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিকতাসম্বলিত বই পড়ায় উৎসাহিত করতে হবে।
কবির ভাষায়Ñ ‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। মানব জীবনের সূচনালগ্নে একজন মানুষকে শিশু বলা হয়। আমরা প্রত্যেকে এক সময় শিশু ছিলাম। শিশু-কিশোর, পথশিশু বলতে আমরা বুঝি বয়সের স্বল্পতার কারণে যাদের দেহ, মন ও মগজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। আজ যারা ছোট, কাল তারা হবে বড়। ভবিষ্যতে তারাই হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। শিশুদের মধ্যেই সুপ্ত আছে ভবিষ্যতের কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ইত্যাদি। কিন্তু আজও আমরা ইতিহাস ও শিক্ষাকে সর্বগ্রহণীয় ও সর্বজনীন করতে পারিনি। আগামী বহু দিনেও আমরা শতকরা শতভাগ শিক্ষিত হতে পারব না, যদি না আমাদের শিশুদের সুশিক্ষিত করতে পারি।
আমাদের সমাজে শিশুদের বড় একটি অংশ এখনও বঞ্চিত মৌলিক অধিকার থেকে। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বই-খাতার পরিবর্তে বেছে নিচ্ছে নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখার তাগিদ বিশ্লেষকদের। ইউনিসেফের জরিপে দেখা গেছে, দেশে ৫ থেকে ১৪ বছরের মোট শিশুর প্রায় ১৫ শতাংশই লেখাপড়ার পরিবর্তে জড়িত বিভিন্ন পেশায়। এ ছাড়া ১৩ লাখ শিশু জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছে নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সুযোগে তাদের দিয়ে সমাজের একটি অপরাধী চক্র নানা ধরনের অপকর্ম করিয়ে নিচ্ছে। বেসরকারি তথ্যমতে, দেশে এখন ১০ লাখেরও বেশি শিশু গৃহহীন। অভাবই যাদের নিত্যসঙ্গী। বিভিন্ন পর্যায়ে ছিন্নমূল শিশুদের সবার জীবনের গল্পটা প্রায় একই ধরনের।
প্রত্যেক শিশুই তার মা-বাবার হৃদয়ের ফুল এবং মানব উদ্যানের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য। তাই অন্তরের সত্যিকার মায়া-মমতা দিয়ে শিশুদের লালন-পালন করা এবং তাদের আদর্শ জীবন গঠন করা সবার কর্তব্য। গোলাপের মতো সুন্দর, হাসনাহেনার মতো সুগন্ধি ছড়ানো নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ আমাদের অতি আদরের হৃদয়ের বাঁধন, নয়নের পুত্তলি সোনামণি তথা শিশু-কিশোরদের অধিকারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক, সংগঠন, সমাজ ও রাষ্ট্রের।
আজকের শিশুই আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে। তারাই তুলে নেবে পৃথিবীর ভার। একটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক ও জাতির কর্ণধার হিসেবে গড়ে তুলতে বড়দের রয়েছে নানাবিধ দায়-দায়িত্ব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না শিশুদেরও অপমানবোধ ও সম্মানবোধ আছে। আমাদের উচিত হবে শিশুদের ভালোবেসে আদর-স্নেহ করা। শিশুদের শিক্ষিত করে তোলা মানে তাদের ওপর একগাদা বই চাপিয়ে দিয়ে সারাক্ষণ পড়ার জন্য চাপ দেওয়া নয়। তাদের সুস্থ বিনোদনসহ খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে। শিশুদের প্রতিটি অধিকার যেন সুনিশ্চিত হয়, প্রতিটি শিশুই যেন স্কুলে যেতে পারে, তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি শিশুও ঝরে পড়বে না, রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না, এটা আমাদেরই দেখতে হবে। শিশুদের খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা দেওয়া সরকারসহ সবারই দায়িত্ব। প্রত্যেকটি শিশুর মাঝে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। এমনকি অবহেলিত পথশিশুদের পরিচর্যা করলে তারাও বনসাঁই থেকে বটবৃক্ষে পরিণত হতে পারে। শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না। জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার জন্য শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। তবে অবশ্যই হতে হবে ইসলামী নৈতিকতা ও আধুনিক আদর্শভিত্তিক শিক্ষা।
বইয়ে মনোনিবেশই মানুষকে সুশিক্ষিত করতে পারে। সেই লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে। শৈশব থেকে পাঠস্পৃহা তৈরি করার কৌশল অবলম্বন করে শিশুদের পাঠকে রূপান্তর করতে হবে। একবার যদি শিশুর বইপড়ার অভ্যাস তৈরি হয়, তাহলে যত বড় হবে, ততই সে নিজে থেকে পড়তে চাইবে। তার চিন্তাশক্তির ব্যাপক পরিবর্তন হবে। যে কোনো খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। ভালো কিছুর সঙ্গে থাকবে। নৈতিকতা শিক্ষাসম্বলিত বই তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। সন্তানের জন্য বাসায় গড়ে তোলা যায় মিনি লাইব্রেরি। বহু আগে শোনা কথা, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’। ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’ ‘শিশু গড়বে সোনার দেশ পায় যদি সে পরিবেশ’। জন্মদিনসহ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে শিশুকে তার পাঠ, পছন্দ ও রুচি উপযোগী বই উপহার দেয়া যায়। বইয়ের মতো ভালো উপহার আর কিছু হতে পারে না।
বিভিন্ন সভা-সেমিনারে শিশুদের অধিকার নিয়ে জোর গলায় বলা হয়, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। যে স্লোগানটি বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বিভিন্ন শহরে অলি-গলি, ঘাট, স্টেশন ঘুরলে শিশুদের অবহেলা আর অনাদরের বাস্তব চিত্র সহজেই চোখে পড়ে। এদের মধ্যে উৎসাহ নিয়ে কোনো কোনো শিশু স্কুলে ভর্তি হলেও জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কদিন পরেই তাদের বেছে নিতে হয় অর্থ উপার্জনের পেশা। কিছুসংখ্যক শিশু মুদি দোকান আর হোটেল-রেস্তোরাঁয় অবিরাম পরিশ্রম করছে। দিন শেষে বা মাস শেষে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পাচ্ছে, তা খুবই সামান্য। এসব শিশুর অধিকাংশই পিতৃমাতৃহীন। অনেকে আবার বাবা কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত অসহায় মায়ের বোঝা। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজেও অনেকে নিয়োজিত। আছে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রের হকার, কুলি-মজুর আর মোটরগাড়ি মেরামত কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। কাজের বিপরীতে খুবই নগণ্য পারিশ্রমিকের পরেও মালিকদের মনের মতো কাজ না হলে এসব শিশু শ্রমিকের ভাগ্যে জোটে নির্যাতন। অথচ যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে তাদের ধরতে হচ্ছে সংসারের হাল। এমনকি ওয়েল্ডিং বা ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ওয়ার্কশপে কাজ করছে তারা। এতে করে তারা শুধু শারীরিক ক্ষতিই হচ্ছে না, মানসিকভাবেও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার, পঙ্গুত্ব, নানা রোগে আক্রান্তসহ প্রাণহানির ঘটনায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের অনেকের জীবন।
সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু শিশুদের অধিকার আর পূরণ হয় না। রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক আর আকাশের নিচে তাদের অনেকের বাস। তারা বড় অসহায়। ঠিকমতো খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না, পরতে পারে না, ভালো কোনো পোশাক পায় না। যারা কারও না কারও সন্তান, ভাই বা আত্মীয়-স্বজন। সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়ার কারণে এসব শিশুরও রয়েছে ন্যায্য অধিকার। স্বাধীন দেশে এ শিশুদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হওয়ার অধিকার আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদের আছে।
সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার। শিশুরা আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহের দান। শিশুর মায়ের গর্ভে থাকা থেকে শুরু করে শৈশব ও কৈশোর পর্যন্ত শিশু অধিকারসমূহ অব্যাহত থাকে। হযরত ওমর (রা.)-এর মতে, শিশু অধিকার শিশু জন্মের পূর্ব থেকেই শুরু হয়ে যায়। নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন। শিশুদের ভালোবাসে না এমন মানুষ কম আছে। তাই তো প্রিয় নবী (সা.) শিশুদের কলিজার টুকরা, জান্নাতের প্রজাপতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।’
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিশু-কিশোরদের অধিকারগুলো বাস্তবায়নের শক্তি, সামর্থ্য ও তওফিক দান করুন।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন