এক কালের বার্মা তথা আধুনিককালের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, এটাই জানতাম এতদিন। মিয়ানমার থেকে নিপীড়নের শিকার হয়ে মাঝে মাঝেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে যারা বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছে তারা মিয়ানমারের প্রাচীনতম অধিবাসীদের অন্যতম হলেও বিতাড়নকারীদের মতে তারা নাকি বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশ থেকে গিয়ে মিয়ানমারে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। এ কারণ দেখিয়ে মিয়ানমারের বর্তমান সরকার তাদের নাগরিকত্ব অবৈধ ঘোষণা করেছে।
রোহিঙ্গারা বাঙালী এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে বলে মুখে অভিযোগ করা হলেও মিয়ানমারের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের আসল অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, আর মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস ইসলামের মূল জন্মস্থান যেমন মিয়ানমার নয়, তেমনি মিয়ানমারের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধধর্মের জন্মস্থান মিয়ানমার নয়, ভারতবর্ষ। আরবে জন্ম গ্রহণকারী হযরত মুহম্মদ (সা:)-এর মাধ্যমে যেভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে বিশ্বে, তেমনি বৌদ্ধধর্মের আদি প্রচারক মহামতি গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে। পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে এমন কট্টর বৌদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় যার মূল শ্লোগানই ছিল কোন বৌদ্ধকে দেখামাত্র তাকে হত্যা করতে হবে। তা না করলে নরকে আজীবন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই অপপ্রচারে বিশ্বাসী হয়ে বৌদ্ধ ধর্মের জন্মভূমি ভারতবর্ষে যে প্রবল বৌদ্ধ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে প্রাণে বাঁচতে বৌদ্ধরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করে উত্তরে তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশ, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা এবং পূর্বে বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপান প্রভৃতি দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের এ গণহত্যা অভিযান এত কঠোরভাবে পরিচালিত হয় যে, বৌদ্ধধর্মের আদি জন্মস্থান ভারতবর্ষে আজ আর কেউ নিজেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিতে সাহস পায় না। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের এ বিরোধের মূলে ছিল হিন্দুদের জাতপাতের বৈষম্যজনিত জাতিভেদ প্রথা। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধই প্রথম ভারতবর্ষে জাতপাতের এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে যখন কট্টর ব্রাহ্মণবাদীদের বুদ্ধ বিরোধী গণহত্যা অভিযান প্রবল হয়ে ওঠে, অনেকটা সে সময়েই সমুদ্র-পথে আসা আরব বনিকদের মাধ্যমে সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শ ইসলামের সঙ্গে উপমহাদেশের জনগণের পরিচয় ঘটে।
উপমহাদেশে ইসলামের আগমন যদি শুধু আরব ইরান আফগানিস্তানের স্থলপথ দিয়ে হতো, তাহলে আজ আমরা বাংলাদেশ নামের মুসলিম প্রধান দেশটিকে এভাবে দেখতে পেতাম না। মরক্কো থেকে শুরু করে আফগানিস্থান হয়ে বর্তমান পাকিস্তানের পূর্ব সীমা পর্যন্ত যে একটানা মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছে, তার মূলে স্থলপথে আসা মুসলিম-প্রচারকদের প্রচারের ফসল হলেও পাকিস্তান থেকে বহু দূরে পূর্বে অবস্থিত যে বিশাল মুসলিম জনপদ বাংলাদেশ নামে পরিচিতি লাভ করেছে, তার মূলে ছিল সমুদ্রপথে আরব বনিকদের সাথে আসা ইসলাম প্রচারকদের প্রভাব। এ কারণে দেখা যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমুদ্র-সন্নিহিত অঞ্চলে মুসলিম বসতির ঘনত্ব। শুধু তাই নয়, একই কারণে বার্মা তথা মিয়ানমারের সমুদ্র সন্নিহিত আরাকান প্রভৃতি অঞ্চলেও একদা এমন এক বিশাল বাংলাভাষী জনপদ গড়ে ওঠে, যারা ধর্মবিশ্বাসে ছিল মুসলমান। বিখ্যাত গবেষক ড. মুহম্মদ এনামুল হক আরাকান রাজসভায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে ব্যাপক চর্চা হতো তার প্রমাণ উদ্ধার করেনে তার বিখ্যাত “আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে। ‘আরাকান রাজসভায় মধ্য যুগের যেসব কবির সন্ধান আমরা পাই, তাদের মধ্যে সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুরদের নাম বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
না, আজ আমরা এখানে আরাকান রাজসভা বা যে জনসভায় বাংলা সাহিত্যকদের সম্বন্ধে লিখতে বসিনি। এমন কি সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কেও লিখতে বসিনি। প্রতিদিনই এ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। মিয়ানমার কর্তৃক সৃষ্ট এ রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘ সরেজমিনে দেখতে মিয়ানমারে বিশেষ মিশন পাঠিয়েছিল। তারা সকলেই এ অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছে এবং যেহেতু এ পরিস্থিতির সৃষ্টির দায় তাদের, তাদেরকেই এ সমস্যা সমাধানের মূল দায়িত্ব ও নিতে হবে বলে রায় দিয়েছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ তথা বর্হিবিশ্ব শুধু খেয়াল রাখবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কিনা।
কিন্তু এখানেও একটি প্রশ্ন উঠেছে অনিবার্যভাবে। বার্মা তথা মিয়ানমারে তো বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূলে রয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অতীতে যখন মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো। আজ তাদের একাংশকে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালী বলে অপবাদ দিয়ে শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে না, বার্মার মূল বাসিন্দা হিসাবেও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। অথচ অতীতে যখন দেশে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল তখন সকলে মিলেমিশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শরীক হিসাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তখন বার্মা বসবাসকারী সকলে একত্রে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতেন।
বার্মার ইতিহাস সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন তারা সকলেই জানেন, বার্মা আমাদের দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের মত এককালে সাম্প্রাজ্যবাদী ইংরেজদের শাসনাধীন ছিল। সাম্রাজ্যবাদের চিরাচরিত ‘ভাগ কারো ও শাসন করো’ (ডিভাইড এন্ড রুল) এ নীতির মাধ্যমে ইংরেজরাই বার্মায় বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভেদের বীজ ঢুকিয়ে দেয় এই বলে যে বার্মা একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ, এখানে অন্য কোন ধর্র্ম বিশেষ করে মুসলমানদের কোন অধিকার থাকা উচিৎ নয়। বার্মার জনগণ ইংরেজদের পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে এসব অপপ্রচারকে পাত্তা না দিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে বার্মাকে স্বাধীন করে।
স্বাধীনতা লাভের পর যতদিন বার্মার গণতন্ত্র বজায় ছিল, ততদিন এসব নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। দেশে বসবাসকারী সকল ধর্মের লোকরা মিলে মিশে বার্মার শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। সমস্যা হলো তখনই যখন এক পর্যায়ে বার্মার সেনাবাহিনী সামরিক ক্যুর মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারে উৎখাত করে রাষ্টীয় ক্ষমতা দখল করে বসে বসল। তাদের ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য তারা জনগণের একটি অংশকে (রোহিঙ্গা) বাঙালী এবং বহিরাগত প্রমাণ করে তাদের উৎখাত করার চেষ্টা চালিয়ে তাদের ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা শুরু করে।
বার্মার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে শুধু জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভেদবৈষম্য সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, দেশে সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডও বন্ধ করে দেয়। এমনকি গণতন্ত্রের দাবী করার অপরাধে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অংসান সূচিকেও দীর্ঘদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে শান্তির নেত্রী সূচি একবার রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা ভ্রমনে বের হওয়ায় অনেকের মধ্যে আশার সঞ্চার হয় সূচি সম্ভবত এবার রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হবেন।
এর মধ্যে একদিকে মানবাধিকার প্রশ্নে বার্মার সামরিক বাহিনীর উপর বর্হিবিশ্বের চাপ বাড়ে। অন্যদিকে বাড়ে শান্তিকামী জনগণের গণতন্ত্রের জন্য প্রতীক্ষার পালা। এক পর্যায়ে দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংসান সূিচর দলের জয় হয়। ঐতিহাসিক এই বিজয়ের পর সূচির সঙ্গে সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর আশা এবার চরমে। নিশ্চয়ই বার্মা এবার ফিরবে শান্তির পথে, গণতন্ত্রের পথে।
কিন্তু না। সূচির সাথে সেনাবাহিনীর যোগাযোগের পর সেনা বাহিনী নয়, বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সূচির মধ্যেই। আগের সূচি আর বেঁচে নেই তাঁর মধ্যে। সূচি যেন এখন সেনাবাহিনীর কথার বাইরে যাওয়ার সব সাহস হারিয়ে ফেলেছেন কোন রহস্যজনক কারণে। এবার তাই হাওয়া ঘুরে গেল শান্তিতে নোবেল জয়ী সূচির। এবার শুরু হলো অংসান সূচির উদ্দেশ্যে বিশ্বজনমতের নানামুখী গালমন্দ বর্ষণের পালা।
একদা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার যেসব খেতাব জুটেছিল তাঁর ভাগ্যে একে একে সেসব প্রত্যাহার করে নেয়ার পালা শুরু হল। নায়িকা থেকে মুহূর্তে খলনায়িকায় রূপান্তরিত হয়ে গেলেন সে দিনের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সূচি।
যে বিষয় নিয়ে আজকের এলেখা শুরু করে ছিলাম তার উপসংহার টানার পালা। এককালের বার্মা তথা আধুনিক কালের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এটাই জানতাম এতদিন। এবার জানলাম যে সংবাদ তার শিরোনাম ছিল : প্রলোভন পড়ে মিয়ানমারে পাড়ি দিচ্ছে অনেক পাহাড়ি পরিবার দৈনিক ইনকিলাব-এর গত সোমবারের শেষ পৃষ্ঠার শেষাংশে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: পুনর্বাসনের প্রলোভনে বান্দরবানের দুর্গম এলাকা থেকে অনেক পাহাড়ি পরিবার মিয়ানমারে পাড়ি দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারে যে এলাকায় তারা বড় আশায় বুক বেঁধে পাড়ি জমাচ্ছেন সেখানে নিশ্চয়ই তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনপদের সন্ধান পেয়েছেন যা তারা এখানে পাননি। পৃথিবীর অনেক দেশে তো জনসংখ্যা বিনিময়ের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। তার আলোকে তাদের আশানুযায়ী কল্পিত যাত্রা যদি বাস্তবে সাফল্যমন্ডিত হয়, তার দ্বারা এমন এক জটিল আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে, যা অনেক গণ্যমান্য কূটনীতিকদের বহু চেষ্টায়ও সম্ভব হয়নি। সুতরাং মন্দ কি!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন