ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিজেপি নেতা শিলাদিত্য দেব বলেছেন, একাত্তরে স্বাধীনতার পরই বাংলাদেশকে ভারতের দখলে নেয়া উচিত ছিল। তিনি সম্প্রতি স্থানীয় একটি নিউজ চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন। ভারতীয় একশ্রেণির রাজনীতিকের বাংলাদেশবিরোধী কথাবার্তা এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক নেতারাও অনবরত বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তাদের এসব অনভিপ্রেত বক্তব্যে এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যতই ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের যতই অবমাননা হোক, তাতে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের যেন কিছুই যায় আসে না। শিলাদিত্য দেবের এই আস্ফালন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের বাংলাদেশ সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের সর্বশেষ উদাহরণ। ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে অযাচিত, অনভিপ্রেত মন্তব্য করে হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। ভারতীয় নেতাদের এসব বক্তব্যকে এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মনে করার কোনো কারণ নেই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের বদলে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর নানা কর্মকান্ডে একটি আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বুঝা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি, তার জনগণের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। এ ধরনের অনভিপ্রেত বক্তব্যের আমরা নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা আমাদের বিজয় তরান্বিত করেছিল। এ কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। বর্তমান সরকার ভারতীয় যোদ্ধাদের বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে এবং বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও অংশগ্রহণের পেছনে যতই ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থই জড়িত থাক না কেন, এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অবদানকে কখনো ভুলে যায়নি, অস্বীকার করেনি। তবে বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানীদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ভারতীয় দখলদারিত্ব মেনে নেয়ার জন্য নয়। যারা ভারতে বসে বাংলাদেশ দখলের স্বপ্ন দেখে তাদের উচিত কাশ্মীর বা দোকলাম পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া। ভারতীয় একশ্রেণীর রাজনীতিক সমকালীন আঞ্চলিক ও বিশ্ববাস্তবতা ভুলে প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর যে খবরদারি ও আধিপত্যবাদী নীতি অনুসরণের কথা বলছেন তাতে আঞ্চলিকভাবে ভারত একঘরে হয়ে পড়ছে এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বাংলাদেশকে ভারতীয় কর্তৃত্বের অধীনে রাখতে তথাকথিত নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে ভারতীয় নেতাদের জোর তৎপরতা বাংলাদেশের মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ২০১৬ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আপত্তিজনক মন্তব্য ও তড়িঘড়ি বাংলাদেশ সফরে আসার পর তা দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় বিশেষ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার, এদেশের একশ্রেণির রাজনীতিবিদ, তথাকথিত সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবী যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলেন তাদের কখনো ভারতীয়দের বাংলাদেশবিরোধী মন্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না।
শতকোটি মানুষের দেশ ভারতে মুসলমানরা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী শাসনে ভারতের মুসলমানদের উপেক্ষিত ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। ভারত বা অন্যকোন প্রতিবেশী দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো হস্তক্ষেপ বা সীমালঙ্ঘন করে না। এমন কোনো নজির নেই। তবে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক মহলের নীরবতা দুর্ভাগ্যজনক। তারা যখন পরোক্ষে বাংলাদেশ দখলের হুমকি দিচ্ছেন তখন আমরা নীরব। তারা যখন আসামের দেড় কোটির মতো মুসলমানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছেন তখনো আমাদের সরকার ও কথাকথিত চেতনার সওদাগররা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা ভারতে গিয়ে যখন ভারতের সাথে বাংলাদেশের অটুট বন্ধুত্বের ফিরিস্তি দিচ্ছেন, তখন ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো নদনদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করে চলেছেন। এমনকি বাংলাদেশেও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রেতাত্মা রাজনীতিকদের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায়, দেশি-বিদেশি কুশীলবদের বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সব দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন