মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ : তার বর্ণাঢ্য জীবন

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আতিক হেলাল
প্রথিতযথা আইনজ্ঞ, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ বিচারপতি সৈয়দ মাহবুবুর মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আবদুস সালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। এক সময় তিনি বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা আফজালুননেছা মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভগ্নি।
সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে জনাব মোরশেদের পূর্বপুরুষ বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ওয়ার্ন হেস্টিংসের শাসনামলে মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ নামে তার একজন পূর্বপুরুষ সদর দেওয়ানী আদালতের সভাপতি ছিলেন। মাতা আফজালুননেছা ইসলামি ইতিহাস খ্যাত ও সিরিয়ার শাসক তথা আরব বিশ্বের উজ্জ্বল নক্ষত্র বীর যোদ্ধা খালিদ বিন ওয়ালিদের বংশ পরম্পরায় আগা বাকের খান যিনি বাংলায় মোগল শাসনামলে গভর্নর ছিলেন যার নামানুসারে ঐ সময় বাকেরগঞ্জ জিলার নামকরণ হয়, তদ্বীয় বংশধর। জনাব মোরশেদ ১৯২৬ সালে রাজশাহী বিভাগে সকল প্রার্থীর মধ্যে প্রথম বিভাগে বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে অর্থনীতি শাস্ত্রে কৃতিত্বের সাথে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৩০ সালে পর্যায়ক্রমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ এবং এলএলবি উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ সালে তিনি ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। তিনিই একমাত্র তদানীন্তন ভারতীয় ছাত্র ছিলেন এবং অনার্সসহ বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রেসিডেন্সি কলেজ সংকলনের প্রথম মুসলমান সম্পাদক ছিলেন তিনি। কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত লন্ডনস্থ পাকিস্তান সোসাইটির সদস্য ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অন্য সদস্যদের মনোবৃত্তিতে অসন্তুষ্ট হয়ে সোসাইটি থেকে দূরে সরে পড়েন।
১৯৩৮ সালে তৎকালীন কোলকাতার মেয়র, প্রগাঢ় মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এ কে এম জাকারিয়া সাহেবের কন্যা লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং সংসার জীবন শুরু করেন।
ইতিমধ্যে তিনি স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবে সর্বত্র পরিচিত অর্জন করেন। বিখ্যাত ‘গার্ডেন’ পত্রিকায় কিছু লেখা প্রকাশিত হবার পর প্যালেস্টাইন এবং আরব বিশ্বে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ১৯৪২ সালে ‘স্টেটম্যান’ পত্রিকায় ‘কায়েদ আজম’ সম্পর্কে সমালোচনা তৎকালে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৪৩ সালে মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে ‘আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে জনগণের খেদমতে এগিয়ে আসেন এবং ১৯৪৭ সালে বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টে তিনি বিচারক হিসেবে শপথ নেন এবং তখন থেকে বিভিন্নভাবে তিনি বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৪৭ থেকে ’৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্য নির্বাহী পরিষদের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ আহূত প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ১৯৬২ সালে তিনি বলেছিলেন ঃ বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই হবে স্বাধীন আশার ও চিন্তাধারার প্রতীক। তার বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বিচারকার্যসমূহের মধ্যে মন্ত্রী সংঘটিত মামলা, সমাবর্তন মামলা ও মাহমুদ মামলা ইতিহাসখ্যাত মামলা বলে বিবেচিত। মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার এ ব্যাপারে মন্তব্য রেখেছিলেন যে, তিনিই একমাত্র বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারক ও পাকিস্তানে নির্ভরশীল উদার ও উচ্চমানের বিচারক।
১৯৬২-৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তদর্থক বিচারক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি আইয়ুব শাসনামলে আইনের শাসন প্রণয়নের যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল। প্রখ্যাত প্রবীণ হিন্দু আইনবিদ মিঃ বিরেন সরকার তার সম্পর্কে মন্তব্য রেখেছিলেন যে, ‘তিনিই একমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য দাবি আদায়ের ব্যাপারে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।’
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সকল বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনকালে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
১৯৬৯ সালের ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে এবং ১১-দফা কর্মসূচি প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চির স্মরণীয়। আইয়ুব খানে গোলটেবিল কনফারেন্স তার বক্তব্য তৎকালে সমগ্র পাকিস্তানে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
১৯৭১ সালের সামরিক আইন ও বিশৃঙ্খলার সময়ে পাকিস্তান সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাদের পক্ষে যোগ না দিয়ে বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন এবং শত প্রতিকূল ও চাপের মুখেও তিনি তথাকথিত শান্তি কমিটিতে যোগদান করেননি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ব্যাপারে তিনি দু’দুবার শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক বিচারকম-লীর তিনি ছিলেন সক্রিয় সদস্য। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আহূত আইন ও বিচার সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ এ প্রেক্ষিতে পরিভ্রমণ করেন। বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন একজন সমাজসেবকও। তিনি বাফা, রোটারী ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, পাক-চীন মৈত্রী সমিতি, বাংলা-চীন মৈত্রী সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমির তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। ১৯৫৬ সালে রেডক্রস সোসাইটির তিনি ছিলেন সভাপতি।
১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ৪-৫০ মিনিটে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তার গুলশানস্থ বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়। তার প্রতিভা ও বিচারের মাধ্যমে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তা দেশ ও জাতির চলার পথের পাথেয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন