গত শনিবারের (৩১ মার্চের) দৈনিক ইনকিলাব-এর আন্তর্জাতিক পাতা না পড়লে জানতেই পারতাম না যে, বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন মোট পাঁচ ব্যক্তি। এর মধ্যে তিনজন পশ্চিম বর্ধমানে, একজন পুরুলিয়াতে ও একজন উত্তর ২৪ পরগনায়। দাঙ্গায় প্রাণ হারান নিরীহ ব্যক্তিরা, এটাও আমরা জানি। তাই এবারকার পশ্চিম বঙ্গের দাঙ্গায় প্রাণ হারান যে ৫ ব্যক্তি তাদের জন্য শোক প্রকাশ ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকতে পারে না। তবে পশ্চিম বঙ্গের সাম্প্রতিক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার উল্লেখ না করে পারছি না।
পশ্চিম বঙ্গের এই সাম্প্রতিক দাঙ্গায় প্রাণ হারান আসানসোলের এক মসজিদের ইমামের ১৭ বছর বয়সী ছেলে, যার নাম সিবগতুল্লাহ। ১৭ বছর বয়সী সিবগতুল্লাহ মাত্র কয়েকদিন আগেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন। পরীক্ষার্থী ছেলে-সহ গোটা পরিবারের সদস্যরা যখন আশায় দিন গুনছিলেন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে পরিবারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন, সেখানে তাকেই চলে যেতে হল না ফেরার দেশে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার করুণ শিকার হিসাবে।
সিবগতুল্লাহ পিতা আসানসোলের একটি মসজিদের ইমাম মওলানা ইমদাদুল রশিদি। সম্প্রতি হিন্দু ধর্মের রাম নবী উৎসবকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছে, তা থামাতে ব্যর্থ হয় স্থানীয় প্রশাসন। সহিংসতায় ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ছেলের। সে জানাজায় হাজার হাজার মুসল্লী উপস্থিত ছিলেন মৃতের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনায়। জানাজায় উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের অনেকেই সিবগতুল্লাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব ছিলেন, কারণ সিবগতুল্লাহ ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং নিরীহ শান্তিকামী এক তরুণ। এহেন নিরীহ নির্দোষ একজন তরুণের প্রতি নির্মম আচরণ তারা সহ্য করতে পার ছিলেন না।
কিন্তু যা তাদের জন্য সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল তাই শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে হয় মরহুমের পিতার কারণে। ছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ সামনে রেখে তাঁর মিশনে তিনি ছিলেন অটুট, সংকল্পবদ্ধ। সে মিশন ছিল শান্তির মিশন, এক অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আরেক অন্যায়ের আশ্রয় না নেয়ার মিশন। কারণ তাতে অন্যায় বন্ধ হবে না, বিপরীদক্রমে তা ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। মওলানা ইমদাদুর রশিদী ছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ সামনে রেখে ছেলের জানাজা উপলক্ষে সমবেত হাজার হাজার মানুষকে শান্ত থাকতে আহŸান জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন পশ্চিম বঙ্গের আসানসোলে।
এ ঐতিহাস সৃষ্টির শিক্ষা তিনি পেলেন কোথায়? আর পাবেন কোথায়! ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন মওলানা অর্থাৎ ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। আজ মুসলমানদের মধ্যে যতই অধপতন আসুক, তিনি তো একজন আলেম বা মওলানা হিসাবে জানেন ইসলামের মূল আদর্শের স্বর্ণ যুগের কথা, যখন সারা পৃথিবীর বিরাট অংশ ছিল মুসলমানদের শাসনাধীন। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে তার প্রতিশোধ নিতে জনতাকে উত্তেজিত করে এক অন্যায়ের বদলে আরেক অন্যায়ের মাধ্যমে তার প্রতিশোধ নিতে হতো না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যে কোন অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে পারতেন। ইমাম সাহেব ইসলামের শান্তি ও ইনসাফে আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন বলেই এক অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আরেক অন্যায়ের আশ্রয় না নিয়ে ইসলামের শান্তি ও ইনসাফে পথে দৃঢ়সংকল্প থেকে ইসলামের স্বর্ণযুগের আদর্শের মর্মবাণী এ যুগের প্রেক্ষিতে প্রয়োগের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
নিশ্চয় তাঁর স্মরণে এসেছিল ইসলামের স্বর্ণ যুগের কথা, যখন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের (রা.) খিলাফতকালে, মিশরের গভর্নর ছিলেন হযরত আমর ইবনুল আস (রা:) এক সংখ্যালঘু অমুসলমান বালককে অন্যায়ভাবে আঘাত করে ছিল খিলাফতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির পুত্র। এই অন্যায় আঘাতের বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সংখ্যালঘু বালকের পক্ষ থেকে বিচার প্রার্থনা করা হলেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতার কারণে সে বিচার কার্যে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বিচার-কার্যে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার শেষ পর্যন্ত এ অভিযোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে মদীনায় খলিফার দরবার পর্যন্ত পৌঁছায়।
খলিফা উভয় পক্ষের লোকদের তাঁর দরবারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক উভয় পক্ষের লোকজন খলিফার দরবারে যথাসময়ে হাজিরা দেন। খলিফা উভয় পক্ষের বক্তব্য সবিস্তারে শ্রবণের পর মিশরের নির্যাতিত সংখ্যালঘু বালককে নির্দেশ দেন তার উপর অন্যায় নির্যাতনকারী মুসলমান বালক যেরকম কঠোরভাবে আঘাত করেছিল, সেও যেন ঠিক সেরূপ কঠোরভাবে তাকে আঘাত করে। সেই সাথে তিনি (খলিফা) এই অভিযোগের যথাযথ বিচার কার্যে যারা অবহেলা করেছেন, খিলাফতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সকলকে এই বলে কঠোর সমালোচনা করেন “মুনজু কাম তাআব্বাদতুমুন্নাছা ওয়াকাদ ওলাদাতহুম উম্মুহুম আহ্রারান্”, যার অর্থ হলো : “তোমরা মানুষকে কবে থেকে গোলাম ভাবা শুরু করে দিয়েছো, অথচ তাদের মায়েরা তাদেরকে স্বাধীন (মানুষ) হিসাবেই জন্ম দেন”!
ইসলামের সেই স্বর্ণযুগ এখন আর নেই, তা আসানসোলের ইমাম সাহেব জানেন। অতন্ত ভারতে তো নয়ই। কিন্তু ইসলামের এ সম্পর্কিত আদর্শের যে মর্মবাণী, তার মৃত্যু নেই, তা শাশ্বত। আসানসোলের ইমাম সাহেব তা জানেন। আর জানেন বলেই তিনি তাঁর অন্যায়ভাবে নিহত সন্তানের লাশ সামনে রেখেও অন্যায়ভাবে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে অন্যায় পন্থা অবলম্বনের বিরোধিতা করে উপস্থিত সকলকে শান্ত থাকার আহŸান জানিয়ে মহানুভবতা এবং শান্তিকামনার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
ইমাম সাহেবের এ ভূমিকা যে তাঁর সাময়িক শান্তি-কামনা ও ক্ষণিকের আবেগজনিত কোন ব্যাপার ছিলনা তার প্রমাণ আমরা পাই, যখন দেখি, তিনি তার আহŸান মোতাবেক তারা শান্ত না হলে তিনি শুধু এ মসজিদই ত্যাগ করবেন না, আসানসোল এলাকাও ছেড়ে যেতে দৃঢ়সংকল্প বলে জানান। এই ঘটনা আরও প্রমাণিত হয় আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে কোন কিছুই তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এ ধরনের ইমামরা যতদিন প্রচুর সংখ্যায় ভারতে থাকবেন, ততদিন ভারত থেকে ইসলামের মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্ব সম্পূর্ণ উৎখাত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।
উপসংহার টানার আগে আরেকটি কথা বলে রাখার প্রয়োজন অনুভব করছি। আজ মুসলমানরা যে পৃথিবীতে অনেক দুর্বল তার মূলেও রয়েছে মুসলমানদের ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে উদাসীনতা। মুসলমানদের অর্ধপতনের মূলে রয়েছে এক শ্রেণীর মুসলমানরাই, অমুসলমানরা নয়। মুসলমানরা যখন ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ ও মহানুভবতার নীতি ভুলে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্র স্বার্থে অসাম্য, হিংসা, ভোগ-লালসার লক্ষ্য হাছিলের জন্য উন্মদ হয়ে ওঠে, অধপতন তখন তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে মুসলমানরা যখন সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে এবং সমস্ত ক্ষুদ্রতার ঊর্ধে ওঠে ইসলামের নীতি ও আদর্শকে তাদের ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়সংকল্প থাকে, তাদের অগ্রগতি কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন