শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

স্ত্রীর পরকীয়ার কারণেই খুন হন এ্যাডভোকেট রথীশচন্দ্র ভৌমিক

দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্ত্রীর পরকীয়া এবং তার পরিকল্পনাতেই খুন হয়েছেন রংপুরের অতিরিক্ত জজ আদালতের পিপি এবং চাঞ্চল্যকর জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও ও মাজারের খাদেম রহমত হত্যা মামলার সরকার পক্ষের আইনজীবী রথিশ চন্দ্র ভৌমিক (বাবু সোনা)। পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে নিজ বাড়ির নিকটস্থ তাজহাট মোল্লা পাড়ার একটি নির্মাণাধীন বাসা থেকে অর্ধ গলিত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
স্ত্রীর পরকীয়া এবং তার পরিকল্পনাতেই তিনি খুন হয়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত নিহত এ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দিপা (দীপা ভৌমিক), তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম জাফরী এবং সহযোগি আরও ২ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৩০ মার্চ নিখোঁজের পর স্ত্রী দীপা জানিয়েছিলেন, গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টায় বাসা থেকে বের হন নিহত আইনজীবী রথিশ চন্দ্র ভৌমিক (বাবু সোনা)। এর পর আর বাসায় ফেরেননি। সকাল ১০টার পর থেকে তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ ছিল। কিন্তু পুলিশের ধারণা বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। কারণ তার মোবাইলের কললিষ্ট অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত দশটা ২২ মিনিটে সর্বশেষ তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তখন তার অবস্থান ছিল স্টেশন এলাকায়। সেই থেকে তার ফোন বন্ধ ছিল। কিন্তু রথিশের স্ত্রী পুলিশ-র‌্যাবকে জানিয়েছিলেন শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে একটি মোটর সাইকেলে উঠে চলে যান তার স্বামী। আসলে রথিশ চন্দ্র নিখোঁজ ছিলেন বৃহস্পতিবার রাত থেকেই। তাকে ওই রাতেই হত্যা করে একটি বাড়ির মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।
ক্লুবিহীন এই হত্যাকাÐ নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ৪ দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি-জামায়াত সম্পৃক্ততা, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, ব্যক্তিগত এবং হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। ৪ দিনেও উদ্ধার না হওয়ায় নানা কর্মসূচিতে উত্তাল হয়ে উঠে রংপুর।
দফায় দফায় পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ্যাডভোকেট রথিশের বাড়িতে যান। সেখানে রথিশের স্ত্রীর সাথে কথা বললে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ হয়। জানা গেছে, পুলিশ কয়েক দফায় রথিশের স্ত্রী সন্তানের সঙ্গে কথার বলার সময় তারা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিলেন। নিখোঁজের বিষয়টিতে তারা খুব একটা আমলে নেননি। স্ত্রীর দাবি অনুযায়ী শুক্রবার সকাল থেকে তিনি নিখোঁজ। অথচ মোবাইল কল লিস্টে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রাত দশটায় সর্বশেষ কথা বলেন তিনি। এরপর তার ফোনে আর কল যায়নি বা আসেনি। ওই কল লিস্ট অনুযায়ী দেখা যায় কামরুল ও দীপা ভৌমিক প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৩ বার কথা বলতেন। পরে এ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপা ভৌমিকের সহকর্মী ও তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল ইসলামকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়।
দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে কামরুল ইসলাম পরকীয়া এবং খুনের বিষয়টি স্বীকার করলে র‌্যাব দীপা ভৌমিককে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ি থেকে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে আসে। তার তথ্যের ভিত্তিতেই র‌্যাব-পুলিশ যৌথভাবে দীপা ভৌমিক প্রেমিক কামরুল ইসলামের ভাই খাদেমুল ইসলাম জাফরির বাড়ি থেকে অর্ধ গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিকসহ স্বজনরা এ্যাডঃ রথিশের লাশ শনাক্ত করেন।
যেভাবে হত্যা করা হয়
মুলতঃ স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম এবং পারিবারিক কলহের কারণেই খুন হয়েছেন এডভোকেট রথিশ চন্দ্র ভৌমিক (বাবু সোনা)। তাকে দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে তার লাশ একটি আলমারিতে ভরে আলমারি পরিবর্তনের নাম করে নিয়ে যাওয়া হয় মোল্লাপাড়ার সেই বাড়িতে। সেখানে পূর্বেই করে রাখা গর্তে তার লাশ পুতে রাখা হয়।
গতকাল বুধবার রংপুর র‌্যাব-১৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ দুই মাস ধরে হত্যা পরিকল্পনা করেন এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দিপা ও তার প্রেমিক কামরুল মাস্টার। তারা উভয়েই তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রের সহযোগীতায় ২৬ মার্চ বুধবার একটি নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরের মেঝের বালু সরিয়ে গর্ত করে রাখে তারা। পরে ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ভাত ও দুধের সাথে ১০ টি ঘুমের বড়ি খাওয়ানো হয়। এরপর গলায় ওড়না পেচিয়ে শাসরোধ করে স্নিগ্ধা ও কামরুল বাবু সোনাকে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ বাড়ির আলমারিতে ঢুকিয়ে কৌশলে আলমারি পরিবর্তনের কথা বলে তা নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির অদুরে তাজহাট মোল্লাপাড়ার সেই নির্মাণাধীন ভবনে। পরে সেই গর্তেই লাশ পুতে ফেলে তারা।
স্ত্রী দীপার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, হত্যাকাÐ সংঘটিত হওয়ার পর শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে বাবু সোনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কামরুল। সকাল ৯টার দিকে তিনি একটি ভ্যান নিয়ে আসেন। লাশ গুমের উদ্দেশ্যে নিহতের স্ত্রী দীপা আলমারি পরিবর্তনের কথা বলে কামরুলের সহায়তায় বাবু সোনার লাশ আলমারিতে ভরেন। পরে তিন ব্যক্তির সহায়তায় ওই লাশ ভ্যানে তুলে তাজহাট মোল্লাপাড়ার নির্মাণাধীন ওই বাড়িতে পুঁতে রাখা হয়। ভ্যানে তোলার কাজে সহায়তাকারী তিন ব্যক্তিকে কামরুল মাস্টার তার সঙ্গে নিয়ে আসেন।
পরে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মোল্লাপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে সবুজ ইসলাম (১৭) ও রফিকুল ইসলামের ছেলে রোকনুজ্জামান (১৭) গর্তের মাটি ভরাটে সহায়তা করেন।
ওই দুই শিক্ষার্থীর স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক আরও জানান, ২৬ মার্চ শিক্ষক কামরুল ইসলামের নির্দেশে ৩’শ টাকার বিনিময়ে তারা গর্ত খুঁড়ে রাখেন। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বালু দিয়ে গর্ত ঢেকে রাখেন। কামরুল তাদের শিক্ষক হওয়ায় তার আদেশ পালন করেছেন তারা। এঘটনার সাথে সম্পৃক্ত স্নিগ্ধা ও দুই কিশোর সবুজ ও রোকনুজ্জামান কে গ্রেফতার করা হয়েছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক আরও জানান, আমরা তার স্ত্রী এবং দুই ছাত্রকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছি। কি ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে তা মেডিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে পরে জানা যাবে।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন সংগঠন তার খোঁজ দাবিতে আন্দোলনে নামে। পরে র‌্যাব- ১৩ এর সাথে ঢাকা থেকে একটি বিশেষজ্ঞ টিম আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক নিখোজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। র‌্যাবের গোয়েন্দা টিম তথ্য পেয়ে গত মঙ্গলবার বাবু সোনার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক দিপাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এতে তিনি পারিবারিক কলহ, সন্দেহ ও পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হয়ে তার কথিত প্রেমিক কামরুল মাস্টারসহ সে তার স্বামীকে হত্যা করেছে জানিয়ে লাশের অবস্থানের কথা জানায়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে মোল্লা পাড়ার সেই নির্মাণাধীন বাড়ির ভিতর গর্তের ভিতর থেকে এ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের লাশ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
নিহত আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক রংপুরের আলোচিত জাপানী নাগরিক হোসি কোনিও এবং মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের পিপি ছিলেন। তিনি রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, জেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি, রংপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সম্মিলিক সাংস্কৃতিক জোট, সুজনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া তিনি জামায়াত ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সাক্ষী ছিলেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (11)
Helal Masud ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১৩ এএম says : 0
very very bad
Total Reply(0)
nannu chowhan ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৩৭ এএম says : 0
If our teacher's morality & character is like this what we can expact from our student? when teacher's get the job in exchange of money or favour by the by the politician or big official's.Very sorry & hopeless for our childrens future..
Total Reply(0)
আজিজুর রহমান ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১৭ পিএম says : 0
মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কীভাবে ?
Total Reply(0)
ইসহাক হাদী ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১৭ পিএম says : 0
হায়রে পরকীয়া !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
Total Reply(0)
কে.আই সরকার ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১৮ পিএম says : 0
পরকীয়া এখন একটা মারাত্নক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে।
Total Reply(0)
মারুফ ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৩১ পিএম says : 0
এদের দুই জনের ফাঁসি হওয়া দরকার।
Total Reply(0)
তানিয়া ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৪২ পিএম says : 0
সত্য ঘটনা বের করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাধুবাদ জানাই
Total Reply(0)
কামরুল ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৪৩ পিএম says : 0
এরা ২জন শিক্ষক নামের কলঙ্ক
Total Reply(0)
সুলতান আহমেদ ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৪৫ পিএম says : 0
দিন দিন দেশ থেকে মনুষত্ব - মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে
Total Reply(0)
পারভেজ ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৪৫ পিএম says : 0
এরা কী মানুষ না অন্য কিছু ??????????
Total Reply(0)
Nita ৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৪১ এএম says : 0
The death left a message for us that no one is safe in the world. Not even with loving one. So many of them wild animals every where.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন