গত রবিবার ৮ এপ্রিল দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম, ‘প্রয়োজনে সুচিকিৎসায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হবে/ওবায়দুল কাদের’। খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানো হবে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে জেল কোড অনুযায়ী ওনাকে বিদেশ পাঠানো হবে।
শনিবার দুপুরে মন্ত্রী গ্রামের বাড়ী নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে তার মা’এর চেহলাম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী জেল কোড মেনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। অসুস্থতার ধরন দেখে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এতে সরকারের কোন হাত নেই। তার সুচিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে। আদালত তার সাজা দিয়েছে, নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়া জেলে বসে গৃহপরিচারিকা পেয়েছেন, ব্যক্তিগত চিকিৎসক পেয়েছেন, এটি বিরল সুযোগ। তিনি আরো বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে টেনে আনার কিছু নেই, এটা তাদের অধিকার। নির্বাচনে আসবে কি আসবে না এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। কোন শর্ত মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। সংবিধানে সবকিছু উল্লেখ আছে। সংবিধানই পথ দেখাবে নির্বাচন কীভাবে হবে।
যারা অভিজ্ঞ সাংবাদিক, তারা বলেন, খবরের আড়ালেও খবর থাকে। রাজনীতিতে যারা খুব অভিজ্ঞ, রাজনীতির পরিভাষা যারা বোঝেন, সেই ধরনের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অথবা রাজনৈতিক বিশ্লেষক অথবা ঝানু সাংবাদিক ও কলামিস্ট ভালভাবেই জানেন যে, খবরের আড়ালে যে খবর থাকে সেটি সাদা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু যারা বোঝার , তারা ঠিকই বুঝে নেন। কথায় বলে, আকল মন্দ কে লিয়ে ইশারাহি কাফি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মূল সমস্যাটি এড়িয়ে গেছেন। চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হবে কি হবে না সেই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার মালিক আসলে কে? মালিক কি ওবায়দুল কাদের? নাকি আওয়ামী লীগ? নাকি আওয়ামী সরকার? একথাটি তো একজন সাধারণ মানুষও জানে যে, বেগম জিয়ার চিকিৎসা দেশে হবে না বিদেশে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবেন স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া। অথবা বেগম জিয়া এবং তার ছেলে ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়স্বজন। তিনি যদি ভালো মনে করেন তাহলে এই বিষয়ে তিনি তার পার্টির অন্যান্য নেতার সাথে আলোচনা করতে পারেন। তিনিই ঠিক করবেন, এই ব্যাপারে তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকবৃন্দের সাথে আলোচনা করবেন কি না? মোদ্দা কথা, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিকমুক্তার হলেন বেগম জিয়া স্বয়ং। তাহলে ওবায়দুল কাদেররা আগ বাড়িয়ে তাকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলেন কেন? আসলে উত্তরবঙ্গের গ্রামগঞ্জে একটি কথা আছে। সেটি হলো, যার মনে যা, লাফ্ দিয়ে ওঠে তা।
বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান অসুস্থতা নিয়ে সরকার, জেল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের অধীন মেডিকেল কলেজ বা পিজি একটি রহস্যময় ধূ¤্রজাল সৃষ্টি করেছে। কোদাল কে কোদাল বলা খুব সহজ। এবং সেটাই উচিৎ। কিন্তু যখন কথার জাল বুনে ইনিয়ে বিনিয়ে কোদালকে কোদাল না বলে সেটিকেই যখন অন্য কোন নামে ডাকার চেষ্টা করা হয় তখনই যতো রহস্য ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এবং তখন বুঝতে কষ্ট হয়না যে, এই রহস্য এবং সন্দেহ সৃষ্টি করে সরকারী কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ ফায়দা হাসিল করতে চায়। এক্ষেত্রেও সেটি মনে হচ্ছে। সরকারের মতলব সম্পর্কে ইতোমধ্যেই ঢাকার রাজনৈতিক মহল এবং সব শ্রেণীর সাংবাদিকের মধ্যে একটি বিশেষ কথা অনেকের মুখেই শোনা যাচ্ছে। আমরা এই মুহুর্তে সেই কথাটি বলা থেকে বিরত থাকছি। তবে দেখছি, সরকার ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সেই দিকেই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আসুন বিষয়টি আর একটু খোলাসা করে বলি।
\দুই\
বেগম খালেদা জিয়া যে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সেই খবরটি তো অন্য কারো জানা ছিল না। খবরটি তো প্রকাশ করলো পুলিশ। বকশি বাজারে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানি ছিল। অন্য দুই অভিযুক্তকে বেলা ১০ টার আগেই এজলাসে আনা হয়েছিল। বিচারক আক্তারুজ্জামান বেলা সাড়ে ১০ টায় এজলাশে বসেন। কিন্তু দেখা গেল প্রধান অভিযুক্ত বেগম জিয়াই অনুপস্থিত। বিচারক কারণ জানতে চান। তখন পুলিশ জেল কর্তৃপক্ষের একটি চিরকুট দেখায়। সেখানে বলা ছিল যে, বেগম জিয়া ‘আনফিট’ বা অসুস্থ। এই কারণে শুনানি মূলতবী হয়ে যায় এবং নতুন তারিখ ধার্য হয় ৫ এপ্রিল। ৫ এপ্রিলেও বেগম জিয়াকে কোর্টে আনা হয়নি। কারণটি একই। এই অবস্থায় বিচারক নতুন তারিখ ধার্য করেন ২২ এপ্রিল। এবং এই মামলায় বেগম জিয়ার জামিন ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, জেল কর্তৃপক্ষই বলেছেন যে তিনি অসুস্থ। সেদিনও বলা হয়নি, এবং আজও অফিসিয়ালি বলা হয়নি যে, বেগম জিয়ার অসুখটির নাম কি এবং তিনি কতখানি অসুস্থ? তার অসুস্থতার খবর শুনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেলখানায় তার সাথে দেখা করতে যান। জেল কর্তৃপক্ষ এজন্য তাকে সাক্ষাতের অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু জেল গেটে পৌঁছার পর জেল কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দেন যে, বেগম জিয়া অসুস্থ থাকায় মির্জা ফখরুলের সাক্ষাতের প্রোগ্রাম জেল কর্তৃপক্ষ বাতিল করেছে। এদিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকসহ দেশের বিভিন্ন মহল বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। তার পরেও সরকার খুলে বলেনি যে বেগম জিয়ার কি হয়েছে।
এখানে একটি অবাক করা বিষয় হলো এই যে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবালকে কয়েকদিন আগে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং সামরিক বাহিনীর গণসংযোগ বিভাগ অর্থাৎ আইএসপিআর কর্র্তৃক তার স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রচার করা হয়। অথচ, দেশের ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিটি নির্বাচনের ৫ টি আসন থেকে জয়লাভকারী বেগম খালেদা জিয়া, যাকে দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসে, তার মতো ব্যক্তির ক্ষেত্রে সরকার বা জেল কর্র্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত একটি স্বাস্থ্য বুলেটিনও প্রচার করার সৌজন্যবোধ প্রদর্শন করেনি। এর মধ্যে জেলখানার ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা করেছেন এবং কিছু ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু এই সব ওষুধে কোন কাজ হয়নি। জেলখানায় থেকে বেগম জিয়া নিজে দাবি করছেন এবং তার পরিবার এবং দলের তরফ থেকে সর্বক্ষণ দাবি করা হচ্ছে যে, বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক টিমকে কারাগারে প্রবেশ এবং তাকে পরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়া হোক। কিন্তু সরকার আজ পর্যন্ত এই অনুরোধ শোনেনি।
এর মধ্যে ওবায়দুল কাদের একাধিক বার বলেছেন যে, প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হবে। দেশবাসী জানে যে, বেগম জিয়ার কয়েকটি ক্রণিক অসুখ রয়েছে। এসব অসুখের জন্য তিনি ইংল্যান্ড, সৌদি আরব এবং সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া বেগম জিয়ার চিকিৎসকবৃন্দ নিয়মিত তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন এবং বিদেশী ডাক্তারদের চিকিৎসার ফলো আপ করছেন। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসকবৃন্দকে বেগম জিয়াকে পরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারেও ইতোপূর্বে মহাসচিব মির্জা ফখরুল এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বেগম জিয়া দেশে না বিদেশে চিকিৎসা করাবেন সেই সিদ্ধান্ত সরকার করতে পারে না এবং কারাগারে বসেও এসম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আগেই বলা হয়েছে যে, এ সম্পর্কে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন বেগম খালেদা জিয়া নিজে। সেই সিদ্ধান্ত তিনি জেল খানায় বসে নেবেন না। নেবেন জেলের বাইরে এসে। আর তিনি যে জেলের বাইরে আসবেন সেটিও প্যারোলে নয়। তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। মুক্ত মানব হিসেবে তিনি বাইরে আসবেন এবং চিকিৎসা করাবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল গত ৬ এবং ৭ তারিখ সংবাদ সন্মেলনে এবং বরিশালের জনসভায় দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, এখন আর সরকারের সাথে কোনো বিষয়ে কোনো সংলাপ বা আলাপ আলোচনা হবেনা। বরং বিএনপিই সরকারকে একটি শর্ত দিচ্ছে। সেটিই হলো একমাত্র শর্ত। সেই শর্ত হলো,বেগম জিয়াকে কারাগার থেকে শর্তহীনভাবে মুক্তি দিতে হবে। একথা তিনি বলেছেন গত ৬ এপ্রিল কারাগারে বেগম জিয়ার সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসার পর।
\তিন\
সুতরাং বুঝতে কষ্ট হয়না যে, এই একমাত্র শর্তটি দিয়েছেন বেগম জিয়া স্বয়ং এবং মির্জা ফখরুল বেগম জিয়ার সেই শর্তেরই প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। রবিবার বিকেলে এই কলাম লেখার সময় অন লাইন পত্রিকায় যে খবর দেখলাম সেই খবর দেখার পর আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে যে, কোনো যুক্তিতেই সরকার বেগম জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দেবে না। এব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল স্পষ্ট বলেছেন যে, আদালত বেগম জিয়াকে সাজা দিয়েছে, তাই বেগম জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্য দিকে মির্জা ফখরুল বলেছেন, তাদের একটি মাত্রই শর্ত। আর সেটি হলো বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সরকার এবং বেগম জিয়া পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যাচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে তাকে জেল কোড অনুযায়ী বিদেশে পাঠানো হবে। তিনি আরো বলেন, মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী জেল কোড মেনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। অর্থাৎ সরকারী ডাক্তার ছাড়া বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত ডাক্তারদের চিকিৎসা সেবার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
ওবায়দুল কাদেরের কথার আরেকটি অর্থ হলো এই যে, জেল কোড অনুযায়ী বেগম জিয়াকে যদি বিদেশে পাঠাতে হয় তাহলে তাকে প্যারোলে পাঠানো হবে। আমার বিশ্বাস, শুধু বিএনপি নয়, বাংলাদেশের মানুষ তার প্যারোলে বিদেশে যাত্রা সমর্থন করবেন না। ১৯৬৯ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে যখন শেখ মুজিব আগরতলা মামলায় বন্দী ছিলেন তখন জেনারেল আইয়ূব খান রাওয়ালপিন্ডিতে সব দলের একটি গোল টেবিল বৈঠক ডাকেন। ঐ বৈঠকে শেখ মুজিবকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বলা হয় যে, তাকে প্যারোলে রাওয়ালপিন্ডি আসতে হবে। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় বলেছেন যে, তার পিতার প্যারোলে যাওয়ার প্রস্তাবটি সমর্থন করেছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদ। শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী তার মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্যারোলে যাওয়ার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। আরো বিরোধিতা করেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। অবশেষে শেখ মুজিবও প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আমার বিশ্বাস, প্যারোলে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রস্তাব বেগম খালেদা জিয়াও প্রত্যাখ্যান করবেন।
এই অবস্থায় বিএনপির বর্তমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যে কতদিন শান্তিপূর্ণ থাকবে সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের বিরাট সংশয় রয়েছে।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন