শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

দুর্নীতি ও আত্মসাতের উৎসব

প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
লুটপাট, দখলবাজি ও অনিয়ম কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। মনে হয়, এদেশে অপরাধপ্রবণতা ও অপরাধীরা একেবারে অপ্রতিরোধ্যই হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়েই খাই খাই পার্টির সরব পদচারণা। দেশটাকে বোধহয় দুগ্ধবতী ছাগী আর জনগণকে ছাগল ছানা মনে করছে আত্মপুঁজারীর দল। যতই তারা দোহন করছে, ততই তাদের দোহন করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনভাবেই তাদের খাই মিটছে না। আর এখানে ছাগল ছানার মত আমজনতার প্রাপ্তির খাতাটা একেবারে শূন্যই বলা চলে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্র রহস্যজনক কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বলেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে। ভাবটা একেবারে দায়সারা গোছের। তাই রাক্ষসপুরীর এসব ষ-াপা-াদের কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। লুটপাটের একটা ঘটনা প্রকাশের সাথে সাথে আরও একটি ঘটনা পিছু নিচ্ছে। এর শুরু আছে, যেন শেষ নেই। রাষ্ট্র যদি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে তার প্রতিকার করা খুবই সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র এখানে নীরব কেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই অষ্টপ্রহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লুটেরার দল। রাষ্ট্রের সকল সেক্টরেই এসব চোর-ডাকাত-বাটপারদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। রক্ষক পরিণত হয়েছে রীতিমত ভক্ষকে। তাই তো এবার রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের দিলকুশার লোকাল অফিসের এক কর্মকর্তা এফডিআরের অর্থ তুলে নিয়েছেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা টের পেয়ে তার কাছ থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করেছে বলে দাবি করলে তা এখনও রীতিমত রহস্যাবৃত্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় দেশে যখন তোলপাড় চলছে ঠিক তখনই ঘটল এ ঘটনা। এফডিআর তছরুপের ঘটনায় ওই ব্যাংকের গ্রাহকরাও আতঙ্কে রয়েছেন। তবে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, গ্রাহকদের কোনো ক্ষতি হবে না। আবার এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এনবিআর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মারাত্মক কেলেঙ্কারির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফলে জনগণ এখন সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজীব হাসান দীর্ঘদিন ধরে ওই শাখার এফডিআর অনুবিভাগে কাজ করে আসছেন। সেখানে অনেক আগে থেকেই ভাউচার দিয়ে টাকা তুলছিলেন তিনি। এতদিন বিষয়টি কেউ বুঝতে না পারলেও গত ২০ মার্চ ভাউচারে গরমিল দেখতে পান অন্য কর্মকর্তারা। আর তা মিলিয়ে দেখতেই বেরিয়ে আসে এফডিআরের নামে ভাউচার দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয়ার কাহিনী। এরপর গত ২১ মার্চ রাজীব হাসানের ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধার করেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সেখানে টাকা পাওয়া যায় ৭৮ লাখ। আর ওই কর্মকর্তা যে ডেস্কে বসতেন সেখানকার ড্রয়ারে পাওয়া গেছে আরো ১৫ লাখ টাকা। এছাড়াও তার অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা ও উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওয়া গেছে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অবশ্য আরো কোনো ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট আছে কিনা সে বিষয়ে জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এফডিআরের জমার বিপরীতে গ্রাহককে প্রদেয় মুনাফার কিছু অংশ নিজের হিসাবে নিয়েছেন রাজীব হাসান। এছাড়া গ্রাহককে যে পরিমাণ মুনাফা প্রদান করার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ টাকার ভাউচার করে অতিরিক্ত অংশ নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। গ্রাহকের জমাকৃত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তিনি। আর তা নির্বিঘেœ চলেছে দিনের পর দিন। জানা গেছে, ব্যাংকের এক কোটি নব্বই লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি এমডি’স ভিজিল্যান্স ডিপার্টমেন্টের নজরে আসে। টাকা আত্মসাতের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব¡ দিয়ে গত ২২ মার্চ ওই কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার কাছ থেকে এ পর্যন্ত নগদ ও এফডিআর (নগদায়ন যোগ্য) মোট এক কোটি আটান্ন লাখ নব্বই হাজার টাকা উদ্ধার করেছে। অবশিষ্ট টাকা উদ্ধারের লক্ষ্যে অভিযুক্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে একটি অগ্রিম চেকসহ তার স্ত্রীর নামে রায়েরবাজারে অবস্থিত ফ্ল্যাটের মূল দলিল ব্যাংকের জিম্মায় নিয়েছে। সার্বিক বিষয়ের ওপর তার কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারনামাও নিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ সতর্কতাসহ দাফতরিক কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রাজীব হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার পরও পুলিশে না দেওয়ায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর টাকার ভাগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক। এ অবস্থায় ঘটনা আড়াল করতে তাকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন ওই শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা। জানা গেছে, চুরির ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ তাকে ধরতে ব্যাংকে আসে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করতে দেওয়া হয়নি। কৌশলে তার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে তাকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন চুরির টাকার ভাগ নেওয়া কর্মকর্তারা। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাজীব একা নন বরং ব্যাংকে টাকা চুরির একটি সিন্ডিকেট সরব রয়েছে।
লোকাল শাখায় কেবল রাজীব হাসানই নন, আরও অনেকেই ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা চুরি করছেন প্রতিদিন। জানা গেছে, কয়েক মাস আগে আরেকজন কর্মকর্তা লোকাল শাখা থেকে ৯৬ লাখ টাকা চুরি করার পর ধরা পড়েন। কিন্তু তাকে শাস্তি না দিয়ে সিলেটে বদলি করা হয়। টাকা চুরির অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, উচ্চমান সহকারী পদে লিখিত পরীক্ষায় ২৭ নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে ৭০ দিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকতে হবে। আর এজন্য পুরো খাতা আবার নতুন করে লিখতে হবে। এটা হবে এক ধরনের জালিয়াতি। কাস্টমস কমিশনারের এমন আপত্তিতে নজিবুর রহমানের কড়া নির্দেশ ‘নম্বর বাড়াও। এটা করতেই হবে। উই আর আন্ডার ইন্সট্রাকশন...।’ কমিশনারের সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যানের কথোপকথনের ভয়েস রেকর্ডে এর সত্যতা রয়েছে বলে দাবি করেছে দৈনিকটি। তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, তিনি তার পদ ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রীতিমতো চূড়ান্ত হওয়া নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তনে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তার পছন্দের প্রার্থীরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও তাদের চাকরিই নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকে নানাভাবে হয়রানি হওয়ার আশঙ্কায় চেয়ারম্যানের এমন অন্যায় তদবির মেনে নিলেও কেউ কেউ মেনে নিতে পারছেন না। এজন্য তাদের খেসারত দিতে হচ্ছে পদে পদে। ডাম্পিং পোস্টিং ছাড়াও তাদের নানাভাবে হয়রানি হতে হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক রাজস্ব আদায়ে।
অঘটন বোধ হয় আমাদের কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি নতুন ঘটনার অবতারণা হচ্ছে। কিন্তু তা আমাদের আহাজারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আমরা এসবের কোন প্রতিকার করছে পারছি না। প্রতিকার করার দায়িত্ব যাদের তারাও রহস্যজনকভাবে নীরব। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। অপরাধীরা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে ফ্রি স্টাইলে। মূলত এভাবে কোন সভ্য সমাজ চলতে পারে না। আমরা যদি অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করে অপরাধপ্রবণতার লাগাম টেনে ধরে অপরাধীদের শাস্তি বিধান করতে না পারি তাহলে অচিরেই গভীর সংকটে পড়ে যাব, যা কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন