ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
১৬ মাস আগে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ দূষণের শিকার হয় বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন। জাতিসংঘ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে যে অনন্য সুন্দর বাদাবনকে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠার আশঙ্কা সৃষ্টি করে এ দূষণ প্রক্রিয়া। সুন্দরবন এবং সংলগ্ন নদীনালার জীব বৈচিত্র্যের জন্যও তা বিসংবাদ সৃষ্টি করে। এতদিন সে দূষণ অনেকখানি সামাল দেয়া গেলেও ক্ষয়ক্ষতির রেশ যে এখনো রয়ে গেছে তা স্পষ্ট। শ্যালা নদীর দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট নদ-নদীতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি ওঠে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নৌ চলাচলের বিকল্প চ্যানেল চালু করে শ্যালা নদীতে যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ করা হবে। সেই বিকল্প নৌপথ চালু হয়নি। শ্যালা নদীতে ইতিমধ্যে সার বোঝাই জাহাজ ডুবি ঘটেছে।
সর্বশেষ ডুবেছে সাড়ে ১২শ’ মেট্রিক টন কয়লাবাহী একটি কার্গো জাহাজ। ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত সুন্দরবনের এ অংশে নতুনভাবে জাহাজ ডুবিতে নদী দূষণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগের ভয়াবহ দূষণে গাছপালার পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ডলফিন, কুমির, শামুকসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণীর জন্য তা বিপদ ডেকে আনে। জোয়ার-ভাটার কারণে দূষণ প্রাকৃতিকভাবে অনেকটা কাটিয়ে ওঠা গেলেও তার জের এখনো অব্যাহত। শ্যালা নদীতে কয়লাবাহী জাহাজ ডুবি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই অনিন্দ্য সুন্দর বাদাবনের সুরক্ষায় আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কোনো দায় আছে কিনা সে প্রশ্নই নতুনভাবে সামনে এসেছে। সুন্দরবন সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা এখনো পর্যন্ত খাতা-কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবায়নের যেন কেউ নেই। দেশের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত এই বনভূমিকে টিকিয়ে রাখতে দায়িত্বহীন মনোভাবের অবসান ঘটাতে হবে। বন্ধ করতে হবে সুন্দরবনে যান্ত্রিক নৌ চলাচল। সুন্দরবনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সব কার্যক্রম থেকেও দূরে থাকতে হবে।
এক সময় ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট এবং দক্ষিণাঞ্চলের সাথে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ঘষিয়াখালী চ্যানেল। কিন্তু গত তিন বছর ধরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে পথ হিসেবে ব্যবহার করছে বিআইডব্লিউটিএ। শুরুতে বনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০টি বড় পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কার চললেও এক বছর ধরে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২৫০টি জাহাজ চলাচল করছে। এ চ্যানেলে নিয়মিত পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করায় উপকূলীয় জীব বৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়েছে।
শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির পর সুন্দরবনের পরিবেশে বিপর্যয় ঘটেছে। আগের মতো পশুর নদীর মোহনায় এখন আর ইরাবতী ডলফিনের দেখা মিলছে না। এমনকি ভাটার সময় কাঁকড়া ও যেসব জলজপ্রাণী খালপাড়ে দেখা যেত, তাও চোখে পড়ছে না। সুন্দরবনের শ্বাসমূলে লেপ্টে আছে তেলের আস্তর। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক যান চালনার ঝুঁকিপূর্ণ নির্দেশনাটি যে আত্মঘাতী হয়েছে সেটা এখন প্রমাণিত।
বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই তেলের জন্য সুন্দরবনের গাছপালা, মাছ ও পশু-পাখির জীবন বিপন্ন হবে। জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসেরও আশঙ্কা করছেন তারা। দুটো বিষয় স্মরণযোগ্য। এক, ১৯৯৪ সালে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নদীতে তেলবাহী বিদেশী জাহাজ ডুবে ১৯৩ টন তেল ছড়িয়ে পড়লেও ওই সময় ভাটা থাকায় তেলের বিরাট অংশই ভেসে নেমে যায় বঙ্গোপসাগরে। এবার তেমনটি ঘটেনি। দ্বিতীয়ত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচলের জন্য মাত্র তিন মাসের অনুমতি দেয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। অথচ বিগত চার বছর ধরেই নৌ পথটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
আমরা মনে করি, সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন নয়। পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত আমলে নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক নৌ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করা উচিত। যে কোন মূল্যে সুন্দরবন বাঁচাতে হবে।
এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে আগামী দু’দশক নাগাদ সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছ বিলীন হয়ে যেতে পারে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই তেলবাহী জাহাজ ডুবির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কমিয়ে আনাসহ ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হলে সুন্দরবনকে ভালোবাসতে হবে। সুন্দরবন শুধু প্রকৃতিই নয়, আমাদের জীবন জীবিকাও রক্ষা করছে। সুন্দরবন না থাকলে সিডরের সময় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।
লেখক : এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন