শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

শিক্ষা-স্বাস্থ্যকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. এনামুল হক খান
আমরা দেশের উন্নয়ন চাই, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। এই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দেশের মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য প্রথমে যে বিষয়টা আসে তা হল শিক্ষা। শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমানভাবে এগিয়ে যাওয়া দরকার। শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করতে অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের একাগ্রতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। আমরা জানি, সচেতনতার অভাবে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়, আর শিক্ষার অভাবে হয় মূর্খ। তাই শিক্ষা ও সচেতনতার মতো মৌলিক বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। দেশের মানুষকে সচেতন করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক। এর জন্য নিতে হবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, নিতে হবে মানুষ গড়ার কৌশল। অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের অবকাঠামো নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে বিপুল সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিক। তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত এবং কারিগরি জ্ঞানহীন। তারা কাজ করতে যেয়ে দেখে দেখে শিখেছে। তারাই গড়ে তুলছে সুউচ্চ ইমারত, ব্রিজ-কালভার্ট, রেলপথ-রাজপথ, কলকারখানাসহ আরো অনেক কিছু। আর যারা কলকারখানায় উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত তাদেরও একই অবস্থা। কৃষিসহ অন্যান্য সেক্টরের অবস্থাও অনুরূপ। যোগ্য মানুষ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ আজ পৌঁছে গেছে সমৃদ্ধির শিখরে। আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার পাশাপাশি উন্নত দেশকে অনুস্মরণ করতে হবে, নিতে হবে বাস্তব পদক্ষেপ।
একটি দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে যতো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সে দেশ ততো এগুবে। শিক্ষার পর প্রথমে আসে মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করা, পরিবেশের উন্নয়ন করা। কারণ, সুস্থ মানুষই আয় করতে পারে, অসুস্থরা পারে না। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে বাস করতে হলে সমাজ সচেতন হওয়া জরুরি। একটু বাস্তব দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, যেখানে সেখানে কফ, থুথু ফেলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাঁচি, কাশিতে রোগ ছড়ায় এ কথা জেনেও আমরা সাবধানতা অবলম্বন করি না। উন্নত দেশগুলোতে একটি কাগজের টুকরা রাস্তায় ফেলা দ-নীয় অপরাধ। প্রতিদিন আমরা কতো কিছু রাস্তায় ছুড়ে ফেলি, ডাবের খোসা, ফলের খোসা, চকলেটের খোসা, পলিথিন আরো কতো কি। আমরা শুধুকি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। প্রস্রাব, মলত্যাগের মতো গর্হিত কাজও যত্রতত্র করি। কি শহর, কি গ্রাম সবখানে একই অবস্থা। শহরের রাস্তার পাশে, ফুটপাথে, রেল-বাসস্টেশনে এসব বিষয় নজরে আসে। আর গ্রামের পুকুর পাড়, বাঁশ ঝাড়, ডোবায় এমন চিত্র আজো দেখা যায়। অনেক স্থানে ঘের দেয়া লেট্রিন থাকলেও মলমূত্র থাকে উন্মুক্ত। এর জন্য শতভাগ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত কারা চাই। তাছাড়া সারা দেশে বিপুল সংখ্যক ইটভাটার কারণে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। গাড়ির কালো ধোঁয়ার ফলে বাড়ছে দূষণ, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এত কিছু অঘটন প্রতিনিয়ত ঘটছে, সবাই সবকিছু দেখছে, পদক্ষেপ নেয়ার কিছুই হচ্ছে না। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের বার্ষিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ১৮৮টি দেশের মধ্যে বসবাস উপযোগিতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম হয়েছে, আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। শিক্ষার হার বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব না দিলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য গত একদশকে শিক্ষার অগ্রগতি আশার সঞ্চার করেছে। শিক্ষার হার বাড়ায় নারী-পুরুষের সম্মিলিত আয় সংসারে যোগ হচ্ছে কিন্তু এ হার নগন্য। প্রতিটি পরিবারের আয় আরো বাড়ানো ছাড়া দেশ এগুবে না। সবার মধ্যে সচেতনতা না বাড়লে দেশকে বাস উপযোগিতার দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
আমাদের জাতির যে কোন সমস্যায় সংঘবদ্ধ হওয়ার নজির আছে। প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা অনেক ভালো কিছু করতে পারি। পরিচ্ছন্নতা অভিযান, পরিবেশের উন্নয়ন, সামাজিক কার্যক্রম আরো অনেক কিছু, যা হবে এলাকার জন্য কল্যাণকর। পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিলে সমাজ উপকৃত হয় এর জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। দেশের মানুষের শিক্ষার হার, সচেতনতা বৃদ্ধি শত ভাগ নিশ্চিত করা দরকার। আর স্বাস্থ্যসচেতনতা পুরোপুরি নিশ্চিত হলে গড় আয়ূ আরো বাড়বে। মানুষকে সচেতন করতে প্রথমে প্রয়োজন শিক্ষা। এই শিক্ষা অবশ্যই হতে হবে সুশিক্ষা। অশিক্ষা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমাজ গঠনে আমাদের এগুতে হবে। রোদ, বৃষ্টি, শীত, গ্রীষ্ম সব কিছুতেই প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা। এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে খাদ্যাভাস, পুষ্টি-অপুষ্টির বিষয়টি। আরো যে বিষয়টি মানুষের জন্য অপরিহার্য তা হলো নিয়মিত শরীরের বিশ্রাম ও কুঅভ্যাস পরিত্যাগ করা। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। শিক্ষিত মানুষের পক্ষেই সবকিছু মেনে চলা সম্ভব, বাস্তবায়ন সম্ভব। তাদের দ্বারাই সমাজে পরিবর্তন সম্ভব।
কলকারখানা, কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে প্রত্যেককে আমরা যদি সচেতন করতে পারি, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠি অবশ্যই এগিয়ে যাবে, সমস্ত দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দেশের মানুষ খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে অধিকাংশই অসচেতন। তিনবেলা আহার গ্রহণ করলেও কতটুকু পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলো সে বিষয়ে অজ্ঞ। পরিবারের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে পুষ্টিকর খাবার দরকার। মাছ, গোশত ডিম, দুধ, শাক-সবজিসহ অন্যান্য খাবার থাকা চাই। অসচ্ছল পরিবার শিক্ষা ও সামর্থ্যরে অভাবে তা গ্রহণ করতে পারে না, ফলে অপুষ্টিতে ভোগে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অপুষ্টির কারণে প্রতিদিন দেশে অনুর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। এটা একটা ভয়াবহ দিক। এ সমস্যার অতিশীঘ্র নিরসন দরকার। শুধু উদরপূর্তি যথেষ্ট হতে পারে না। এদেশে এখনো অনেকে অর্ধাহার-অনাহারে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন ধারণ করে। খাবার গ্রহণে যদিও আর্থিক সঙ্গতির দিকটি জড়িত তবে শিক্ষা থাকলে স্বল্প আয়ের লোকও পরিমিত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। চীন দেশে একটা প্রবাদ আছে-তুমি যদি এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাকো, তাহলে শস্যদানা বহন করো তুমি যদি দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাকো, তাহলে বৃক্ষ রোপণ করো তুমি যদি হাজার বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাকো, মানুষ তৈরি করো। যতোদিন মানুষকে প্রকৃত মানুষ এবং দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা না যাবে ততোদিন দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি কোন কিছুতেই আশানুরূপ প্রাপ্তি সম্ভব নয়, শতভাগ সুস্থ মানুষ আশা করাও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য মানুষ সৃষ্টি। আমরা জানি, একজন ঘুমন্ত মানুষকে অন্য একজন ঘুমন্ত মানুষ জাগিয়ে তুলতে পারে না। তেমনি একজন মূর্খ কখনো অন্য একজন মূর্খকে জ্ঞান দান করতে পারে না। একজন শিক্ষিত, জ্ঞানী মানুষ সাধারণ অশিক্ষিত মানুষকে সচেতন ও জ্ঞানী মানুষে পরিণত করতে পারে। মানুষকে প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে অসাধারণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
দেশে আজ কতো সংখ্যক লোক দেহের প্রতি যতœশীল তা ভাবার বিষয়। অনেকের শরীরের দিকে খেয়ালই নেই। শিক্ষার পর মানুষকে খাদ্যাভ্যাসে সচেতন, সামাজিকভাবে সচেতন করা হবে অন্যতম কাজ। গড়ে তুলতে হবে ধূমপান বিরোধী সমাজ। ধূমপান দেহে নিকোটিনের পরিমাণ বাড়ায় ফলে মানুষের আয়ূ কমে। তাছাড়া ফুসফুসে ক্যান্সার, ক্রনিক ব্রংকাইটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি ধূমপানজনিত কারণেই বেশি হয়। এসব জেনেও ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে না। শিক্ষার মাধ্যমে সিগারেটের কুঅভ্যাস থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে হবে। সিগারেট শুধু পুরুষই নয়, নারী, শিশুরাও গ্রহণ করছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। আর দরকার প্রচার মাধ্যমগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ। এক শ্রেণির লোক এখনো মদ ও এলকোহল জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করছে। অন্যকেও এসব গ্রহণে উৎসাহিত করছে। সবকিছু বিচার করলে পাওয়া যায় এর জন্য দায়ী অসচেতনতা বা অজ্ঞতা। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সারাদেশে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ অব্যাহত রাখা দরকার। প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রচারণা দরকার। এর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে প্রবন্ধ-নিবন্ধ সন্নিবেশ করা যায়। তবেই দেশের বিপুল শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ সুস্থ, সবলভাবে বেড়ে উঠবে, গড় আয়ূ বাড়বে, পরিবেশ দূষণ কমবে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগুবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন