রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা

প্রকাশের সময় : ১৬ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৯:১৬ পিএম, ১৫ মে, ২০১৮

ইসরাইলীদের হাতে এক দশক ধরে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আবারো গণহত্যা চালিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সোমবার গাজায় ইসরাইল সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ সমাবেশের উপর ¯œাইপার হামলা চালিয়ে অন্তত ৬০ জনকে হত্যা এবং প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে আহত করেছে ইসরাইলীরা। এর আগে গত মার্চ মাসের শেষদিকে জুম্মার দিনে ফিলিস্তিনী ভূমি দিবস উপলক্ষ্যে গাজার ইসরাইল সীমান্তের কাছে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে ¯œাইপার হামলা চালিয়ে অন্তত ৩০ ফিলিস্তিনীকে হত্যা এবং শত শত নিরস্ত্র মানুষকে আহত করেছিল ইসরাইলী সেনারা। চার বছর আগে ২০১৪ সালে ইসরাইলের গাজা হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনী বাড়িঘর ধ্বংস ও বেসামারিক মানুষ হত্যার পর এটিই ছিল সবচে প্রাণঘাতি ইসরাইলী হামলা। সে হামলার প্রতিবাদে জাতিসংঘ এবং আন্তজার্তিক সম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করতেও ব্যর্থ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে। গতকাল ছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এবং ফিলিস্তিনীদের নাকবা বা বিপর্যয় দিবস। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারিখে জায়নবাদি মিলিশিয়ারা ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনীকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করে। সে হামলায় হাজার হাজার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী হতাহত হয়েছিল। ইসরাইলের গণহত্যা ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরনীয় করে রাখতে ৭০ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার ঘোষনা দেয়। জাতিসংঘের রেজুলেশন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতি অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনীরা গাজায় সমাবেশ করেছিল। আরেকটি ঘৃন্য গণহত্যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও নাকবা দিবসকে নিরস্ত্র মানুষের রক্তে কলঙ্কিত করল।
গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতা মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের ভূ-খন্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীদের উপর আগ্রাসন, গণহত্যা ও ভূমি জবরদখল চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের এহেন ঔদ্ধত্বের পেছনে রয়েছে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিদের নির্লজ্জ প্রশ্রয় ও সমর্থন। ফিলিস্তিনীদের ভূমির অধিকার, জীবনের অধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমারা নিরব। উপরন্তু বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষের উপর ইসরাইলের প্রতিটি রক্তাক্ত আগ্রাসনের পর বিশ্বসম্প্রদায়ের নিন্দা প্রস্তাব, তদন্ত ও বিচারের স্বাভাবিক মানবিক প্রস্তাবগুলো প্রধানত: মার্কিনীদের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনীদের উপর নির্বিচার গণহত্যা চালানোর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইসরাইলকে জবাবদিহিতার বাইরে রেখে প্রকারান্তরে গণহত্যার লাইসেন্স দিয়েছে মার্কিন শাসকরা। এতকিছুর পরও মার্কিনীরা এত বছর ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যে একটি শান্তি আলোচনা, শান্তিচুক্তি এবং দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের নিস্ফল মধ্যস্থতাকারীর ভান করছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিনীদের ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য নীতি উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনের নাকবা দিবসে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করার ঘোষনা দেয়ার মধ্য দিয়ে এবং গাজায় প্রতিবাদ সমাবেশে ন্যক্কারজনক বন্দুক হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষকে হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত করার পর বিশ্বসম্প্রদায় যখন নিন্দা জানাচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনায় অভিনন্দন জানিয়েছে।
আল আকসা মসজিদসহ জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অন্যতম কেবলা ও পবিত্র স্থান। ঐতিহাসিকভাবেই জেরুজালেম নগরীর উপর ফিলিস্তিনী আরবদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। সাতষট্টি সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম অধিকার করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ কখনো জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের অধিকার মেনে নেয়নি। সম্প্রতি ইউনেস্কোও জেরুজালেমের উপর ইসরাইল ও ইহুদিদের কথিত অধিকারের দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। ভূমি দিবস উপলক্ষে ফিলিস্তিনীদের চলমান আন্দোলনে গত দুই মাসে দুইবারের রক্তাক্ত ¯œাইপার হামলয়ই প্রায় একশ মানুষকে হত্যা ও তিন হাজারের বেশী মানুষকে আহত করেছে ইসরাইলী সেনারা। বিশ্বের অন্য যে কোন স্থানে কোন রাষ্ট্রশক্তির এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায়ও বিশ্বগণমাধ্যমকে যে ধরনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী গণহত্যার বেলায় প্রতিক্রিয়া অনেকটাই মৃদু ও দায়সারা গোছের। এমনকি আরব প্রতিবেশীদের মধ্যেও তেমন জোরালো প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না। সোমবারের গাজা প্রতিবাদ সমাবেশে ইসরাইলী গণহত্যার বিরুদ্ধে রাশিয়াসহ বেশ কিছু পশ্চিমা এবং আরব দেশ জোরালো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আরবলীগ জরুরী সম্মেলনের ডাক দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে ওআইসিসহ আরব দেশগুলোর কাছে আরো জোরালো ও সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে বিশ্ব সম্প্রদায়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগান স্পষ্টভাষায় বলেছেন জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা ত্যাগ করেছে। তারা এখন ফিলিস্তিন সমস্যার অংশ। মার্কিনীদের পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়বে বলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে। ওআইসি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস প্রত্যাখ্্যান করেছে। আল কায়েদার একটি অংশের নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছেন। হামাস নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেমের উপর এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আরেকটি ইন্তিফাদার ডাক দিতে পারে হামাস ও হিজবুল্লাহ। জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনা এবং ফিলিস্তিন সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া এই সমস্যার আর কোন বিকল্প সমাধান নেই। এই দাবী আদায়ে ওআইসি, আরবলীগসহ বিশ্বসম্প্রদায়কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন