আমরা পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্কারাহ ১৮৪ নং আয়াতাংশ- ‘ওয়াল্লাজিনা ইউত্বিক্বনাহু ফিদইয়াতুন ত্বয়ামু মিছকীন’ আয়াতের ব্যাখ্যা সুহৃদয় পাঠক ফোরামের সমীপে পেশ করতে প্রয়াস পাব। আল্লাহ পাকই আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল।
আমাদের বিশ্লেষণকে সহজতর করার লক্ষ্যে পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্কারাহ ১৮৩ এবং ১৮৪ আয়াত দু’টির তরজমা ও তফসীরের সার-সংক্ষেপ প্রথমে তুলে ধরা হচ্ছে।
তরজমা : (১৮৩) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে সক্ষম হও। (১৮৪) সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য, তারপর তোমাদের মাঝে যে রোগক্রান্ত থাকবে কিংবা সফরে থাকবে তার জন্য অন্য সময়ে সে রোজা আদায় করে নিতে হবে এবং এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে ফেদিয়া (খাদ্য) দান করবে। যে ব্যক্তি সানন্দে পুণ্য কর্ম করে তা তার জন্য মঙ্গলকর যদি তা তোমরা বুঝতে পার।’
সার-সংক্ষেপ : পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মতো উম্মতে মোহাম্মদীর ওপরও সার্বিক পরহেজাগারি অর্জনের নিমিত্ত রোজার অপরিহার্যতা আরোপ করা হয়েছে। কেননা রোজা রাখার মাধ্যমে নফসকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্নমুখী প্রবণতার ছোবল হতে রক্ষা করার যে দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোবৃত্তি ও অভ্যাস গড়ে ওঠে তা পরহেজগারির পথকে সুগম করে তোলে। এই অনুশীলনের জন্য মহান রাব্বুল আলামীন সারা বছরের মাঝে মাত্র একটি মাসকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যার ফলশ্রæতিতে গোটা বছরই প্রত্যেক ঈমানদার বান্দাহ পরহেজগারির অমীয় পরশে ধন্য হতে সক্ষম হয়। তবে তাদের মাঝে কেউ যদি অসুস্থ হয় কিংবা রোজা রাখা কঠিন ও ক্ষতিকর হয় অথবা শরীয়ত অনুমোদিত ভ্রমণে থাকে, তাহলে তার জন্য রমজান মাসে রোজা না রাখার অনুমতি আছে। সফরের অবস্থায় যে কয়দিন সে রোজা রাখেনি, তদনুরূপ দিনের রোজা সে রমজান মাস ছাড়া অন্যান্য সময়ে আদায় করতে পারবে।
আর রমজান মাসে রোজা যাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর মনে হয় তারা রোজার পরিবর্তে ফেদিয়া বা বদলা হিসেবে একজন গরীব মিসকিনকে আহার করাবে বা খাদ্য প্রদান করবে। এমতাবস্থায় কেউ যদি সানন্দচিত্তে আরো বেশি ফেদিয়া দেয় তবে তার জন্য অধিক কল্যাণ বয়ে আনবে। তবে যাদের জন্য রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয় তারা যদি কষ্ট করে রোজা রাখে তা হলে তা হবে অধিক কল্যাণকর। (তফসীরে ইবনে জারীর, ইবনে কাসীর, কুরতুবী, কবীর, বানরুল মুহীত ও দুররুল মানসুর)
শানে নুযুল : হযরত সালাম ইবনুল আকওয়া (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন ‘ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু’ আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল যে, যার ইচ্ছা সে রোজা রাখবে এবং যার ইচ্ছা সে রোজার পরিবর্তে ফেদিয়া দিয়ে দেবে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ‘মান শাহিদা মিনকুমুশ্ শাহরা ফালইয়াছুমহু’ শীর্ষক আয়াত নাযিল হয়, তখন রোজা কিংবা ফেদিয়া দেয়ার এখতিয়ার রহিত হয়ে যায় এবং সুস্থ সবল ও সমর্থ লোকদের ওপর শুধু কেবল রোজা রাখাই অপরিহার্য হয়। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিজী, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে আবু দাউদ)
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, ইসলামের প্রথম অবস্থায় সালাতের নির্দেশ সম্বলিত তিনটি স্তর যেমন অতিক্রান্ত হয়েছে তেমনি রোজার ব্যাপারেও অনুরূপ তিনটি স্তর পরপর বিন্যস্ত হয়েছে। যথাÑ (১) রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন মদীনায় তশরীফ আনেন তখন প্রতি মাসে তিনটি এবং আশুরার দিন একটি রোজা রাখতেন, (২) এরপর ‘কুতিবা আলাইকুমুছ্ ছিয়াম’ আয়াত নাজিল হয়। তখন সবারই এখতিয়ার ছিল, যে কেউ রোজাও পালন করতে পারত কিংবা এর পরিবর্তে ফেদিয়াও প্রদান করতে পারত। কিন্তু তখনো রোজা রাখাই উত্তম বলে বিবেচিত হতো। তারপর আল্লাহ পাক ‘ফামান শাহিদা মিনকুমুশ্ শাহরা : আয়াত নাযিল করলেন। এতে সুস্থ-সবল ও সমর্থ লোকদের এখতিয়ার রহিত করে রোজা রাখাই অপরিহার্য করা হয়। তবে অতিবৃদ্ধ লোকদের জন্য সে এখতিয়ার বহাল রাখা হয়। তাই কখনো তারা রোজা না রেখে ফেদিয়া আদায় করতে পারেন, (৩) প্রথম অবস্থায় ইফতার গ্রহণের পর হতে শয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রী সম্ভেÍাগের অনুমতি ছিল। কিন্তু শয্যা গ্রহণ করে নিদ্রাচ্ছন্ন হওয়ার সাথে সাথে পর দিনের রোজা আরম্ভ হয়ে যেত। ফলে ঘুম ভাঙলে রাত থাকা সত্তে¡ও পানাহার এবং স্ত্রী সম্ভোগের এযাজত ছিল না। তারপর আল্লাহ পাক ‘উহিল্লালাকুম লাইলাতাছ ছিয়ামির রাফাছু’ নির্দেশসূচক আয়াত নাযিল করলেন। এতে ইফতারের পর হতে সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগের অনুমতি প্রদান করেছেন। (সুনান আহমদ, ইবনে কাছির, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সুনানে আবু দাউদেও অনুরূপ অনুমতি সম্বলিত বর্ণনা আছে)
উইত্বিকুনাহু-এর অর্থ : স্বাভাবিকভাবে ‘ওয়া আল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু’ শীর্ষক আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, যারা পূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও রোজা রাখতে পারে না, তারা রোজার বদলে ফেদিয়া দিতে পারবে। কিন্তু সাথে সাথেই বলে দেয়া হয়েছে যে, ‘ওয়া আন তাছুমু খাইরুল্লাকুম’ অর্থাৎ রোজা রাখাই হবে তাদের জন্য মঙ্গলকর।
প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত আয়াতের স্বাভাবিক যে অর্থ ধরা হয়, তা সঠিক নয়। সঠিক অর্থ হচ্ছে, ‘রোজা রাখা যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে ফেদিয়া দান করবে।’ এই উভয় অর্থের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, স্বাভাবিক অর্থে কষ্ট হওয়া কোনোই শর্ত নেই। কিন্তু সঠিক অর্থের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হওয়ার শর্ত রয়েছে।
সন্দেহের অবসান : উপরোক্ত আয়াতে কুরআনের ‘ইউত্বিকুনাহু’ ক্রিয়াটির মূল মাছদার ‘ইতাক্কতুন’। তাই কোনো কোনো লোক ভুলবশত এর অর্থ করেছেন সমর্থ হওয়া, সঙ্গতিসম্পন্ন হওয়া এবং শক্তিমান হওয়া। কিন্তু তাদের এই অর্থ গ্রহণ নিতান্তই ভুল। মূলত ‘ইত্বক্কতুন’ হলো আরবী ‘ত্বাক্কাতুন’ শব্দের ‘বাবে ইফআল’-এর মাছদার। এর ছুলাছী মাছদার খুব কম ব্যবহৃত হয়। এমনকি এর ‘ছুলাছী মাছদার’ হতে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয় না। ক্রিয়া গঠন করতে হলে ‘বাবে ইফআলকে’ মূল ধরে নিতে হবে এবং ‘ইত্বাক্কাতুন’-এর উৎস হবে ‘ত্বাক্কাতুন’। এর মূল ধাতু হচ্ছে ‘ত্বাওকুন’। আর ‘ত্বাওকুন’ শব্দের অর্থ আরবী অভিধান লিসানুল আরব ও তাজুল উরুসে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে : ত্বাওকুন-এর অর্থ হচ্ছে তাক্কাত বা শক্তি। অর্থাৎ শক্তির সর্বশেষ সীমা ও পরিমাণ যা কোনো ব্যক্তি অত্যন্ত কষ্টসহকারে অর্জন করতে পারে। ‘ইতা¡ক্কাতুন’ শব্দের অর্থ যে অত্যন্ত কষ্টসহকারে শক্তি অর্জন করা তার সমর্থন আল-কুরআনে নি¤েœাক্ত আয়াতগুলো হতেও পাওয়া যায়।
(ক) আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ওপর ঐ রোজা চাপিয়ে দেবেন না, যার শক্তি আমাদের নেই (সূরা বাকারাহ : রুকু-৪০) এই আয়াতে যার শক্তি আমাদের নেই এর অর্থ হচ্ছে যার সামর্থ্য আমাদের নেই, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, অর্থাৎ যা আমরা করতেই পারি না। বস্তুত আল-কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক এ কথাও সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ পাক বান্দাহদেরকে এমন কোনো হুকুম প্রদান করেন না, যা সে পালন করতে অক্ষম। যেমন আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ পাক কোনো প্রাণীকে হুকুম প্রদান করেন না, কিন্তু ইহার যা তার সাধ্যের আওতাভুক্ত।’ (সূরা বাকারাহ : রুকু-৪০)
সুতরাং এ কথা সুস্পষ্ট যে, এই দোয়ার অর্থ এভাবে করা, ‘হে আল্লাহ! আমাদের ওপর ঐ বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যা আমরা বহনই করতে পারব না’ শুদ্ধ হবে না; বরং এই দোয়াতে শক্তি না থাকার অর্থ হবে, ‘যা আমরা অতিকষ্টে বহন করতে পারি।’
(খ) অনুরূপভাবে তাবুতের সেনাবাহিনীর এই দোয়া, ‘আজ আমাদের মাঝে জালুত এবং তার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার শক্তি নেই।’ (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩৩) এর অর্থ এই নয় যে, আমরা মোকাবেলাই করতে পারব না বরং এর অর্থ হলো, ‘আমরা কষ্টসহকারে মোকাবেলা করতে সক্ষম।’
(গ) অনুরূপ মর্মার্থের সন্ধান আমরা হাদীস হতেও লাভ করতে পারি। ইবনে যুবায়ের (রা:) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন, ‘ঐ সকল লোক যারা কষ্টসহকারে রোজা রাখতে পারে না তারা একজন মিসকিনের খাদ্য ফেদিয়া দেবে, এই অনুমতি বৃদ্ধ পুরুষ এবং বৃদ্ধ মহিলার জন্য। যারা অতিকষ্ট করে রোজা রাখতে পারে। তারা যেন রোজা না রাখে এবং প্রত্যেক রোজার বদলে প্রত্যহ একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করে। (আবু দাউদ) এই হাদীস হতে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ‘ইউত্বিকানিছ ছিয়াম’ শব্দের অর্থ এই হতে পারে না যে, যারা রোজা রাখতে সম্পূর্ণ সক্ষম। কারণ যেখানে সক্ষমতা বিদ্যমান সেখানে ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি আরোপিত হওয়ার কোনোই প্রশ্ন ওঠে না। বরং ‘ইউত্বিক্কানিছ্ ছিয়াম’- এর অর্থ হবে যারা কষ্টসহকারে রোজা রাখতে পারে।
(ঘ) ‘আউনুল মা’বুদ শরহে আবি দাউদ গন্থে’ এই হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যারা খুবই কষ্ট, বেদনা, কঠোরতা ও মুশকিলের সাথে রোজা রাখতে পারে।’
(ঙ) তাছাড়া শায়খুল হাদীস মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ:)-এর অভিভাষণেও অনুরূপ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। (ফয়জুল বারী)।
সুতরাং ‘ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু’-এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, ‘যারা কষ্টসহকারে রোজা রাখতে পারে।’ তবে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, যারা অতিকষ্টে রোজা রাখতে পারে তাদের বেলায় ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি যেমন রয়েছে, তেমনি যারা রোজা রাখতে মোটেই সক্ষম নয়, তাদের জন্যও ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি যেমন রয়েছে, তেমনি যারা রোজা রাখতে মোটেই সক্ষম নয়, তাদের জন্যও ফেদিয়া প্রদানের অনুমতি অবশ্যই রয়েছে।
মূল সমাধান : ‘ওয়া আলাল্লাজিনা উইত্বিকুনাহু ফিদইয়াতুন ত্বায়ামু মিছকীন’ এই আয়াতটির তফসীর বিশ্লেষণে সাহাবীদের আমল হতেই এখতেলাফ চলে আসছে। সুতরাং এ সম্পর্কে সাহাবীদের তিনটি শ্রেণীর সন্ধান পাওয়া যায়।
(১) কোনো কোনো সাহাবীর বর্ণনা হতে জানা যায় যে, প্রথম রমযানের পূর্বে কয়েকটি রোজা ফরজ ছিল। এই রোজাগুলোর সম্পর্কে অনুমতি ছিল, কেউ ইচ্ছা করলে রোজা রাখতে পারে অথবা প্রত্যেক রোজার বদলে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করতে পারে। তারপর রমজান মাসের রোজা ফরজ হবার পর এই হুকুম রহিত (মানছুখ) হয়ে গেছে।
(২) সাহাবীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিমত এই যে, ‘ইউত্বিকুনাহু’ শব্দের ‘হু’ জমীর বা সর্বনামটি সাওম শব্দের প্রতি প্রযোজ্য নয় বরং ইহা ‘তায়াম’ শব্দের প্রতি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে, ‘যে ব্যক্তি ফেদিয়া দানের সামর্থ্য রাখে সে রোজা রাখার সাথে একজন মিসকিনের ফেদিয়াও আদায় করবে’ পরবর্তী সময়ে এই হুকুমও রহিত হয়ে গেছে। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস-ই দেহলভী (রহ:) মিসকিনদের আহার্য ফেদিয়ার দ্বারা ‘ছদকায় ফিতিরকে’ বুঝিয়েছেন। যা রমযানের পর প্রত্যেক সামর্থ্যবান রোজাদার নিজের এবং নিজের নাবালেগ সন্তানাদির পক্ষ হতে আদায় করে থাকেন। (ফাউজুল কাবীর)
(৩) সাহাবীদের তৃতীয় শ্রেণীর মতানুসারে জানা যায় যে, এই হুকুম রহিত করা হয়নি। বরং রোজার ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি তাদের প্রতি প্রযোজ্য যারা মাজুর। যেমনÑ বয়ঃবৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও গর্ভবতী মহিলা।
তবে আসল কথা হচ্ছে এই যে, ‘ইউত্বিকুনা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থের তাহকীক করা হয়নি। ‘এতাকাত’ শব্দটিকে ‘ওয়াছউন’ শব্দের সমার্থ্যবোধক বলে মনে করা হয়েছে। তাই তারা উপরোক্ত আয়াতে কারীমার অর্থ করেছেন, ‘যারা রোজা রাখতে পারে, তারা একজন গরিব-মিসকিনকে আহার করাবে।’ এই অর্থ অনুসারে হয়তো এই আয়াতটির হুকুম রহিত হয়ে গেছে বলে মেনে নিতে হবে, কিংবা বর্তমান যুগের লাগামহীন বুদ্ধিজীবীদের মতো বলতে হবে, যারা রোজা রাখতে সক্ষম তারাও রোজার বদলে ফেদিয়া প্রদান করে রোজার কষ্ট হতে বাঁচতে পারে। অথচ এই অভিমত সম্পূর্ণই ভুল। কারণ তাদের মতানুসারে বলা যায়, যারা গরিব তারাই রোজা রাখবে এবং যারা ধনী তারা ফেদিয়া প্রদান করে রোজার কষ্ট ও যাতনা হতে বিমুক্ত থাকবে। অথচ ইসলামের ফরায়েজগুলোতে এ ধরনের তারতম্য কোথাও রাখা হয়নি। ইসলামের নীতিমালার ধারাবাহিকতারও তা বিপরীত। তাছাড়া এর পরবর্তী আয়াত, ‘যে রমজান মাসে থাকবে, তার উচিত মাসভর রোজা রাখা; এর নির্দেশকেও অমান্য করা হবে।
উপসংহার : পরিশেষে এ কথা স্পষ্টতই বলা যায় যে, ‘ইত্বাক্কাত’-এর অর্থ হচ্ছে, ‘কোনো কাজকে কষ্টসহকারে আদায় করার সামর্থ্য থাকা।’ তাই উপরোল্লিখিত ‘ইউত্বিকুনাহু’ শব্দ সম্বলিত আয়াতের সঠিক অর্থ হবে, ‘যারা অত্যন্ত কষ্টসহকারে রোজা রাখতে সক্ষম, তারা রোজার বদলে একজন মিসকিনের খাদ্য ফেদিয়া প্রদান করবে।’
এই নিরিখে মাজুর লোকদের দু’টি শ্রেণী স্বভাবত নজরে পড়েÑ (এক) ওই ধরনের মাজুর যারা সময়সাপেক্ষে মাজুর হয়েছেন। যেমনÑ রোগাক্রান্ত হওয়া মৃত্যুভয় দেখা দেয়া, অথবা সফরে গমন করা। এমতাবস্থায় তাদের ওপর এই আয়াতের নির্দেশ কার্যকর হবে। তবে তোমাদের মাঝে যারা রোগাক্রান্ত হবে অথবা সফরে থাকবে তারা অন্যান্য দিনে রোজা আদায়ের মাধ্যমে সংখ্যা পূরণ করবে। (সূরা বাক্কারাহ : রুকু-৩৩)
মোটকথা, ওজর পাওয়া গেলে মাজুর ব্যক্তি রোজা রাখবে না। বরং সমপরিমাণ দিনগুলোর রোজা পরবর্তী দিনগুলোতে কাযা আদায় করবে। এই শ্রেণীর গর্ভবতী ও দুধদানকারী মহিলারাও শামিল রয়েছেন। যদি গর্ভবতী মহিলা বা দুধদানকারী মহিলা নিজের অসুস্থতার অথবা বাচ্চার অসুস্থতার ভয় করেন, তাহলে এই ওজর থাকাকালীন সময়ে রোজা না রেখে ওজর দূর হওয়ার পর কাযা আদায় করতে পারেন।
(দুই) তবে ওজর যদি সার্বক্ষণিক হয়, ওজর দূর হওয়ার সম্ভাবনাই না থাকে যেমন চিররুগ্ন হওয়া, খুবই কমজোর হওয়া, মৃত্যুপথযাত্রী, বৃদ্ধ হওয়া, যারা অতিকষ্টে রোজা রাখতে পারেন, তারা রোজা না রেখে প্রত্যেক রোজার বদলে একজন মিসকিনের খাদ্য ফেদিয়া স্বরূপ দিতে পারেন। ‘ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু ফিদইয়াতুন ত্বয়ামু মিছকীন’ অর্থাৎ ‘যারা অতিকষ্টে রোজা রাখতে পারেন তারা ফেদিয়াস্বরূপ একজন মিসকিনের খাদ্য দান করবেন’ নির্দেশটি তাদের ওপরই প্রযোজ্য।
রোজার ওপর আরোপিত আপত্তির জবাব
জ্ঞান এবং স্বভাব-প্রকৃতি অনুসন্ধানকারী কিছু লোক যারা সাধারণ ইবাদত-বন্দেগীগুলোর উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নির্ধারণে বাগি¦তÐার আশ্রয় গ্রহণ করে। অসামাজিক এবং বন্য মানুষদের ধারণা হচ্ছে এই যে, তারা মনে করে আল্লাহ আমাদের কায়িক পরিশ্রমের ফলে সন্তুষ্টি লাভ করেন এবং তারা রোজার হাকীকতকেও শুধু এতটুকুই বুঝে যে, এটা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শারীরিক কষ্ট বরণ করা। এ সকল ভ্রান্ত মতাদর্শ অবলম্বরকারীদের জন্য অন্যান্য ধর্মে যদিও পদস্খলনের অবকাশ রয়েছে তবু এর চূড়ান্ত প্রতিরোধ অবশ্যই দরকার। যেমন হিন্দু যোগী এবং জৈন ধর্মের অনুসারীরা রোজা সম্পর্কিত কষ্ট এবং বেদনাজনক অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহুদীদের ব্যবহারিক আচার-আচরণের মাঝে রোজার জন্য নফসকে কষ্ট দেয়ার প্রচলন জারি আছে। সুতরাং লক্ষ করলে দেখা যায়, তৌরাত কিতাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোজার জন্য কষ্টদায়ক শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। সফরুল আহŸার (১৬-২৯) কাÐে আছে, ‘এই আইন তোমাদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বহাল থাকবে যে, ৭ম মাসের ১০ম তারিখে তোমাদের সকলেই, যে তোমাদের সাথে বসবাস করে নিজের জানকে দুঃখ দিতে হবে।’
তৌরাতেই সফরুল আদদ (২৯-৭) কাÐে আছে, ‘এবং এই সপ্তম মাসের ১০ম তারিখে পবিত্র জামাআত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তোমরা নিজেদের প্রাণকে কষ্ট দেবে। কিন্তু কোনো কাজকর্ম করবে না।’ এই ব্যবহারিক দিকটি তৌরাতের অন্যান্য কাÐেও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কুরআনুল কারীমে রোজার জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো সাওম। ‘সাওম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, মুক্ত থাকা এবং নিশ্চুপ থাকা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামী রোজার হাকীকত কি এবং এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই বা কি? কুরআনুল কারীমে মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে যেখানে রোজার হুকুম দেয়া হয়েছে সেখানে এই নির্দেশও প্রদান করা হয়েছে যে, আল্লাহ তোমাদের সাথে সহজ এবং নমনীয়তা প্রকাশ করতে চান। কিন্তু কষ্ট ও কাঠিন্য কামনা করেন না।’ (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৩) তাছাড়া ইসলামের সাধারণ নিয়ম-নীতি হচ্ছে এই যে, ‘আল্লাহ পাক কোনো মানুষকে শক্তির বহির্ভূত কোনো বোঝা বহন করতে বাধ্য করেন না।’ (সূরা বাকারাহ : রুকু-৪০) কুরআনুল কারীমে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দ্বীন প্রচারের মৌলিক গুণাবলীকে এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তিনি তোমাদেরকে পুণ্য কর্মসমূহ নিষ্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম করেন এবং যে সকল তাউক ও জিঞ্জিরসমূহ তাদের ওপর আরোপিত আছে সেগুলোকে অপসারিত করেন।’ (সূরা আ’রাফ : রুকু-১৯)
এ সকল আয়াতে বর্ণিত নির্দেশাবলীর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, ইসলামী ইবাদত ও আহকামের মাঝে কোনো বস্তু ও উদ্দেশ্য আরোপিত করা হয়নি, যা এর দ্বারা মানুষের মন-প্রাণকে দুঃখ-বেদনায় পরিলিপ্ত করবে। রোজাও এই শ্রেণীর ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এ সকল কারণে ইসলাম রোজার কষ্ট ও বেদনাকে অক্ষম, অপারগ ও দুর্বল লোকদের থেকে অপসারণের ব্যবস্থা রেখেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন