মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
স্বাধীনতার এই মাসে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেখে ভেবেছিলাম গণতন্ত্রের বিজয় হবে। এখন দেখছি গণতন্ত্রের ত্রাহি অবস্থা। উৎসবের বাদ্য বাজিয়ে ভোট এসেছিল মানুষের জীবনে সেখানে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সহিংসতা আর খুনাখুনির ভোট উপহার দিয়েছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার পর এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোট ডাকাতির মহোৎসব করছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের ভোটাধিকার আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ভোটের উৎসবের আমেজ পরিণত হয়েছে সংঘাত আর সহিংসতায়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না। দখল, বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দু’ধাপের ইউপি নির্বাচন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ভোট বর্জনের ইতিহাস ফলাও করে প্রচার করেছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! তবে এবারের ইউপি নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদরের আগরদাঁড়ি কামিল মাদ্রাসার কেন্দ্রে ভোটার ১৮৭৬ জন। ওই ভোটার কেন্দ্রে ১টি ভোটও পড়েনি। এছাড়াও সাতক্ষীরার আরো পাঁচটি কেন্দ্রে ১টি ভোটও পড়েনি। জনগণের ভোট কেড়ে নেয়ার ফলে এ রকম পরিস্থিতি বিরাজ হয়েছে। রাজনীতির এমন বাতাবরণে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, স্বাধীনতার লক্ষ্যগুলো পূরণ হচ্ছে না বলেই সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সঙ্কট দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রথম পর্বের ভোট হয়েছিল ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ১১ জনের। দ্বিতীয় পর্বে ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিহত হয়েছে তারও বেশি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এত লাশের ওপর দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে। এই নির্বাচনে তো সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তারপরও সরকার, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবদানে এমন একটি নির্বাচন হলো যা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করলো। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই যে এখন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এমন বক্তব্যের প্রতি মানুষের সমর্থনের হার আরো একধাপ বেড়ে গেল। এই দুই পর্বের নির্বাচন কেমন কলঙ্কজনক হয়েছে তা অনুধাবন করার জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক হওয়ার প্রয়োজন নেই পত্রপত্রিকার শিরোনাম দেখলেই চলবে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একতরফাভাবে সরকারি দলের আধিপত্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তারপরও থেমে নেই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও হতাহতের খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচন গণতন্ত্রের চাবিকাঠি। দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার মাধ্যম হলেও বাস্তবে হয়েছে লুটতরাজ, জবর-দখলের হাতিয়ার। ২২ ও ৩১ মার্চের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিতে তুচ্ছ ব্যাপার। রক্তক্ষয়ী নির্বাচনকে যদি অবাধ ও সুষ্ঠু বলা হয় তাহলে কোন নির্বাচনকে সহিংসের নির্বাচন বলা হবে? ব্যালট ছিনতাই, ভোট ডাকাতি ও গোলাগুলির ঘটনা গণতন্ত্রের নিশানা মুছে দিলেও টনক নড়ছে না নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের। গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঢুকিয়ে গণতন্ত্রের কথা বলা পাপ। কারণ গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যা এক পায়ে দাঁড়ায় না। সংসদীয় গণতন্ত্র হয় শাসক দল ও বিরোধী দল মিলে। বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টি যখন দাবি করেছে যে, সে সেখানে বিরোধী দল হিসেবে আছে, সেখানে তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে- গণতন্ত্র কি এক পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়? এই সহিংসতার নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আর যাই হোক দলীয়করণের কবলে থাকা প্রশাসনের পক্ষে এমপিতন্ত্রের বাইরে গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। সম্ভবত সে কারণেই দেখা যাচ্ছে, যেখানে সরকারদলীয় মনোনীত চেয়ারম্যান পদ প্রার্থীরা জিততে পারেনি, সেখানে জয়ী হয়েছে এমপির অনুগত প্রার্র্থী। বিএনপি এবং অন্যান্য দলের অংশগ্রহণ ও সাফল্যের ভাগ তাই একেবারেই নগণ্য। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনেক জায়গাতেই মেম্বার পদে গোপন ভোটের সুযোগ দেয়া হলেও চেয়ারম্যান পদে ভোটাররা সেই সুযোগ পায়নি। প্রার্থীর লোকজন নিজেরাই বাক্স ভরে নিয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের অতীত ইতিহাস খুব বেশি সুখের নয়। প্রভাব-প্রতিপত্তি, টাকা-পয়সা, হু-াগু-া, হুমকি-ধমকি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ নানা অনিয়ম বার বার নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ওইসব প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষ থেকে যথাযথ সম্মান তো দূরের কথা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে নিজের গায়ে কলঙ্কের দাগ লেপন করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় নির্বাচন থেকে উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের তিন সিটির নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের জয়ী করতে এমন কোনো হীন পন্থা নেই যা তারা করেনি। আর ওইসব ভোট ডাকাতির প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে ইউনিয়ন নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে তার ধারেকাছেও নেই। সে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতিকে তোয়াক্কাই করে না। সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমেই আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। এটা তো সত্য শাসকগোষ্ঠী পেশিশক্তির জোরে মানুষকে জিম্মি করে ইউপি নির্বাচনের বিজয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। ইউপি নির্বাচনের দুই পর্বের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে সত্য বেরিয়ে আসবে তা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ভোট ডাকাতি আর নির্বাচন কমিশনের মুখস্থ বুলি। নির্বাচন কমিশন নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি।
সবচেয়ে নিচের স্তরের স্থানীয় সরকার সংস্থা ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন চলছে তাতে একেবারে নতুন বিষয় হলো শত বছরের প্রাচীন রীতি বদলিয়ে অরাজনৈতিক নির্বাচনের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে ও প্রতীকে চেয়ারম্যান পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ছয় দফার প্রথম ও দ্বিতীয় দফা মাত্র হলো বাকি চার দফা ভোটে সহিংসতা কমবে না বাড়বে, আরও কতজন মারা যাবে এই নিয়ে জনমনে উদ্বেগ আর সংশয় বেড়েই চলছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন এবং কারচুপি প্রতিরোধ করতে শেষ বুলেট থাকা পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তার এই বক্ত্যব কাজির গরু কিতাবে ছিল বাস্তবে ছিল না। প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশে এমন সংঘাতপূর্ন নির্বাচন আর কখনো হয়নি। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ‘দুর্বৃত্ততন্ত্রকে এবার গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তা রিপেয়ার করা আর কোন দিন সম্ভব হবে কিনা জানি না। অনেকের শঙ্কা, ধীরে ধীরে দেশটিকে হয়তো উত্তর কোরিয়ার মতো বানিয়ে নেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে উত্তর কোরিয়া অন্য কোন রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করে না আবার সেখানে কোনো নির্বাচন নেই, গণতন্ত্রের নামগন্ধও নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের এই দুর্দশা যতটা না হতাশার তার চেয়ে বেশি হতাশা সৃষ্টি করবে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে থেকে দূরে থাকলে ক্ষমতাসীনদের সাময়িক সুবিধা বাড়লেও রাষ্ট্র দুর্বল হতে থাকে। তখন চেয়ারম্যান কিংবা এমপির কথাই শেষ হয়ে ওঠে এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নির্বাসিত হয়। সাজানো মাঠে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। মৃত্যুর মিছিলে বাদ যায়নি নারী, শিশু, হকার এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীও। তাই সবার আগে দ্রুত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের ভেবে দেখা দরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন