শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ : সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার

প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। সেই ঘোষণাপত্রের মহান আদর্শ বাস্তবায়নে বীর জনগণ আত্মনিয়োগ ও প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই ঘোষিত আদর্শকে অস্বীকার করে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেসব রাষ্ট্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় দর্শনকেই রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং সংবিধানের ভিত্তি করেছে। কেবল বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে অগণিত জনগণের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও রক্তের আস্তরণের ওপর। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের রাজনৈতিক দলিল হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা একটি উজ্জ্বল মহৎ কীর্তি। এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একটি উচ্চতম আদর্শকে ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিছিয়ে দিয়েছিল। এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্যই ৩০ লাখ শহীদের রক্তদানসহ মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে।
বিশ্বের যে কোনো মুক্তিকামী দেশের Proclamation বা Declaration of Independence  এর চেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ছিল আদর্শিক দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্বে প্রধান দুটি কাজ ছিল, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সময় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও এর ভিত্তিতে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। যে কোনো ‘জাতিরাষ্ট্র’ বিনির্মাণে স্বাধীনতার ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত গণপরিষদের ক্ষমতায়নে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা হয়। ওই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি কী হবে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করনার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম”। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’Equality, Human Dignity and Social justice  এই তিনটিই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় দর্শন। একটি মূল চেতনা বা আদর্শকে প্রকাশের জন্য তিনটি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে। পরবর্তীতে সংঘটিত সব বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের চেতনা থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে।  
ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে ‘‘Hendiatris’ ’ অর্থ তিনের মাঝে এক। তিনটি শব্দের সমাহারে আদর্শ প্রকাশের রীতি বেশ পুরনো। ইংরেজ দার্শনিক জন লক উদ্ভাবিত Life, Liberty and Property  অর্থাৎ জীবন, মুক্তি ও সম্পদ-পরবর্তীতে, টমাস জেফারসন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে Life, Liberty and Pursuit of Happiness  এই তিন আদর্শ ঘোষণা করেন। কানাডার সংবিধানে রয়েছে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সুশাসন। রুশ বিপ্লবের ঘোষণায় ছিল ‘‘Peace, Land & Bread’। আধুনিক জার্মানির মূল মন্ত্র হচ্ছে,Unity, Justice & Freedom  ঐক্য, সুবিচার ও মুক্তি। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হচ্ছে Peace, Order & Good Government। আর ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের আদর্শ হচ্ছে Democracy, Justice & Civilisation।
ফ্রান্সের বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল Liberty, Equality and Fraternity  মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। ফ্রান্সের এই ঘোষণাপত্রের আদর্শকে সংবিধানে Preamble  বলা হয়েছে Common ideals of liberty, equality and fraternity. . আর সেই আদর্শকে ফ্রান্সের সংবিধানের আর্টিকেল দুই এ বলা হয়ে ‘The maxim of the Republic shall be “liberty, equality and fraternity”. The Principle of the Republic shall be Government of the people, by the people & for the people.  ফ্রান্স তার ঘোষণাপত্রের আদর্শকে সংবিধানের চৎবধসনষব এ রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে নির্দেশনা দিয়েছে এবং সংবিধানে সেই তিন আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঘোষণাপত্রের ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ এই তিন আদর্শকে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বা সংবিধানের কোথাও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। ঘোষণাপত্রের আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মিত হবে এটাই ছিল শহীদদের রক্তের সাথে আমাদের সম্পাদিত চুক্তি। শহীদগণ সেই আদর্শের ভিত্তিতেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যে চুক্তি জনগণ জানে না তার জন্য রক্তও দিতে পারে না। সুতরাং এই আদর্শ পরিবর্তনযোগ্য নয়, প্রতিস্থাপনযোগ্য নয় এবং উপেক্ষাযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের তিন আদর্শকে ভিত্তি করেই রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের সংবিধানে আদর্শ উল্লেখ না করে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ঘোষণার ফলে এখন আদর্শও নেই আর ঘোষিত নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিতও হচ্ছে না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ না হয়ে রাষ্ট্র ভয়াবহ বিপজ্জনক পথেই ধাবিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী শাসন ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্র এখন লোভী, হিংস্র, রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছে, মানুষের মতো বাঁচার উপায় রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আত্মিক, নৈতিক ও উচ্চতম আদর্শের  রাষ্ট্রচিন্তা নির্বাসিত হয়েছে। আদর্শ পরিবর্তনযোগ্য নয়, সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন উপাদান, সংযোজন-বিয়োজনের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র আদর্শিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ছাড়া স্বাধীনতা হয় না-হয় শুধু ক্ষমতা হস্তাস্তর। ভাগ্য বঞ্চিত নিপীড়িত জাতি অন্তরাত্মার গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিল রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে কোন আদর্শ হবে বাংলাদেশের নৈতিক ভিত্তি। একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের সর্বজনীন দিকদর্শন রয়েছে এ ঘোষণাপত্রে। কিন্তু জাতির মননে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে গ্রথিত করা হয়নি, বিস্তার করা হয়নি, জাতির ইতিহাসে প্রকাশ করা হয়নি, রাষ্ট্র পরিচালনা ভিত্তি করা হয়নি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার জাতি গ্রহণ করেছিল, আকাশছোঁয়া সাধনা নিয়ে জাতি উদিত হয়েছিল, স্বপ্ন পূরণের ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল তা শুরুতেই বিনষ্ট করা হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তিকে উপেক্ষা করে জাতিকে নির্দেশনা দিতে চেয়েছে। যেসব দেশের সংবিধান অনুকরণ করে আমাদের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে, সেসব দেশের সংবিধান কোনো রাজনৈতিক বিপ্লবের ফলাফল নয়।
যেসব রাষ্ট্র বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে সেসব রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রের আদর্শকে সংবিধানের চৎবধসনষব এ রাষ্ট্রের দর্শন হিসেবে নির্দেশনা দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় দর্শনের বাইরে জাতি গঠনের ধারাবাহিক সংগ্রাম, বীরত্ব, ঐতিহাসিক অর্জনসমূহ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছে। যেমন : ভিয়েতনামের সংবিধানের Preamble এ ১৯৩০ সাল পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী নেতা Ho Chi Minh  এর অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪৬, ১৯৫৯ এর ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। আর কিউবার সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৮৬৮, ১৮৯৫ সালে সংঘটিত জনগণের লড়াই, ঐতিহ্য, বীরত্বের উত্তরাধিকারের কথা উল্লেখ আছে, তাদের আদর্শিক নেতা হোসে মার্তির কথা উল্লেখ আছে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নামই উল্লেখ করা হয়নি। আমাদের সংবিধানে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে টুঁশব্দটি নেই। অথচ ভাষা আন্দোলন হচ্ছে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বাতিঘর এবং ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল স্বাধীনতার বীজ বপনের উৎস। একুশের চেতনা মুক্তি সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছে। অথচ সেই ভাষা আন্দোলনের জন্য জাতির বীরত্ব অর্জন নিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় একটি শব্দও নেই। এমনকি ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণগুলো জাতির অস্তিত্বের সাথে জড়িত সেসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঠাঁই পায়নি। এমনকি ’৭১-এর ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যাও প্রস্তাবনায় ঠাঁই পায়নি। এর ফলে আমরা সংবিধানকে লাখ লাখ মানুষের ধমনীর উষ্ণ রক্তের উত্তরাধিকার করতে পারিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই শব্দত্রয়ের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এই প্রতিফলন ৫২, ৬৯ ও ৭০ এর আন্দোলনের ধারাবাহিকতারই চূড়ান্ত রূপ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক রাজনৈতিক দর্শনের অনিবার্যতা উপেক্ষা করেই উপনিবেশিক রাষ্ট্র দর্শনের মডেল দিয়ে সংবিধান প্রণীত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে কোনো দার্শনিক প্রজ্ঞা সংবিধানে প্রতিফলিত হয়নি। রাষ্ট্রের কোনো নির্দেশনায় নেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের উচ্চতম আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রতি। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শটুকু বাদ দিয়ে কথা বলেন।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা না নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চেতনা থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের নৈতিক চেতনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জাতির অস্তিত্বের সাথে ঐক্যবন্ধনের যে মিলন ঘটেছিল তা তৎকালীন রাষ্ট্র বা সরকারের বিবেচনায় স্থান পায়নি। স্থান পায়নি রক্তের আস্তরণের ওপর ভিত্তি কী ধরনের হবে তার পরিকল্পনা। বরং স্থান পেয়েছে পাকিস্তানিদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশিদের ক্ষমতা প্রতিস্থাপন করা। ফলে যে পাকিস্তানি রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়া হলো সে পাকিস্তানি রাষ্ট্র ব্যবস্থাই স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরায় প্রবর্তিত হলো। অবসান হলো না উপনিবেশিক নিপীড়ক রাষ্ট্র ব্যবস্থার। যুদ্ধ হলো, ক্ষতিপূরণ অযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হলো কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো রূপান্তর ঘটল না। জনগণের আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক অবদান উপনিবেশিক শাসনের কাছে বিক্রি হয়ে গেল। জাতির অজ্ঞাতসারেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অপসারিত হয়ে গেছে, আত্মসাৎ হয়ে গেছে। আমরা যে শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংস করার প্রত্যয় নিয়েছিলাম সে প্রত্যয় অস্বীকার করে আবার শোষণ-নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র পুনঃ প্রবর্তন হলো। আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছিলাম যে যুদ্ধে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের পতন হয়েছে কিন্তু স্বপ্ন পূরণের উপযোগী রাষ্ট্র নির্মাণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের তিন আদর্শ-এটা অখ-িত সত্য। এটাকে বিকৃত করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার দেবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যেই সে আদর্শ ভয়ংকরভাবে পরাজিত হয়, আদর্শিক ভিত্তি বিসর্জন দেওয়া হয়। আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর চরম আঘাত হেনেছি। আমরা ক্ষমতার নিরাপত্তা চেয়েছি, আদর্শের নিরাপত্তা উপেক্ষা করেছি এবং পাকিস্তানি অপশক্তির রাজনীতি মেনে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রাষ্ট্রীয় জীবনে পুনঃস্থাপন করা জরুরি। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’-এর দর্শনগত ভিত্তি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক পর্যালোচনা করে  রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
দার্শনিক জন লকের দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে সমান মর্যাদার ভিত্তিতেই সব মানুষের সৃষ্টি। আর সাম্য আছে আইনগত সাম্য, রাজনীতির সাম্য, সামাজিক সাম্য অর্থাৎ সকল মানুষ একই আইন প্রণয়ন ও নেতৃত্ব নির্বাচনে সমান অধিকার এবং জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর প্রতি সমান অধিকার। মানবিক মর্যাদা নিয়ে ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা ছিল সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান। জার্মান সংবিধানে মৌলিক অধিকারের শীর্ষে রয়েছে মানবিক মর্যাদা। এতে বলা হয়েছে, মানবিক মর্যাদা অলংঘনীয়। একে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আর সামাজিক সুবিচার হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যা ব্যক্তি জীবনে পূর্ণতা আনে, সমাজ থেকে তার প্রাপ্য নিশ্চিত করে এবং সমাজে সক্রিয় অবদান রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানব উন্নয়নের লক্ষ্য অভিন্ন। সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার প্রচলন ১৮৪০ সালে Luigi Taparel  নামক ধর্মযাজক এই ধারণার জনক। আইএলও’র মুখবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার।  
আদর্শবিহীন রাষ্ট্রের কারণেই রাষ্ট্র আজ চূড়ান্ত নিপীড়ক। সাম্যের অভাবে রাষ্ট্র আজ প্রভু আর ক্রীতদাসে বিভাজিত। মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ থেকে উত্তরণের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষিত আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা একমাত্র পথ। নতুবা ৩০ লাখ শহীদের আত্মা ক্রমাগত আমাদেরকে অভিসম্পাত দিতে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই হচ্ছে আমাদের একমাত্র আদর্শ। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ হবে সব আইনের উৎস। সুতরাং বিদ্যমান সংবিধান পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র এবং আদর্শ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। আর সেই আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উপযোগী রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি উদ্ভাবন করতে হবে। আসুন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবতর সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রামে রূপান্তর করি।
কিউবার সংবিধানে যেমন বলা হয়েছে হোসে মার্তির অমর বাণী “I want the fundamental law of our republic to be the tribute of Cubans to the full dignity of man”  অর্থাৎ সংবিধান হোক সর্বোচ্চ মানবিক মর্যাদার বেদিতে কিউবার জনগণের নৈবেদ্য, তেমনি বাংলাদেশের সংবিধান হোক ৩০ লাখ শহীদের আত্মার বেদিতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের’ নৈবেদ্য।
লেখক : গীতিকবি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন