শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পরিবর্তনশীল মুসলিম বিশ্বে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আগামীতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেবে-এমন সম্ভাবনার কথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইসলাম বিশারদ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের মুখে জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তাদের এই আশাবাদ অমূলক নয়। ভৌগলিক অবস্থান ও ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে, মুসলমানদের মধ্যকার সুদৃঢ় বন্ধন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুকুল পরিবেশের কারণেই বাংলাদেশকে আদর্শ মুসলমানের দেশ হিসেবে চি‎হ্নিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অন্তর্গত বিষয় এবং বিশ্বাসের ভিত্তি এবং এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, এ বাস্তবতার আলোকেই এ কথা বলছেন। অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হিন্দু প্রধান দেশ হিসেবে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করাই স্বাভাবিক। তেমনি বৌদ্ধ প্রধান দেশ হিসেবে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভূটান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়াও বৌদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্ম প্রধান দেশও খ্রিস্টানদের দেশ হিসেবে পরিচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই একটি দেশের মূল পরিচয় ফুটে উঠে। স্ব স্ব দেশের সরকারকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যেখানে ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান, সেখানে তাদের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে একটি গোষ্ঠী সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এর শাব্দিক অর্থই হচ্ছে, ধর্মহীনতা। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে তাদের চিরায়ত ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার এক ধরনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেক্যুলারিজমের ধোঁয়া তুলে ধর্মকে দূরে ঠেলে দিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। অথচ যেখানে ভারত বরাবরই তাকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করে আসছে, সেখানেই এখন হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে হিন্দুত্ববাদের এমনই জিকির তুলেছেন যে, তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি মোদি ভারতকে ‘হিন্দুস্থান’ হিসেবে জোরেসোরে বলা শুরু করেছেন। বিশ্বের আর কোনো দেশ এভাবে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশকে ডাকে কিনা, জানা নেই। অথচ আমাদের দেশে একটি শ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মূলত বর্তমান সরকারের আমলেই তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে অতীতে কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়নি। এটি মুসলমান রাষ্ট্র এবং এখানে শুধু মুসলমানরাই থাকবে-এমন কথাও কখনো উচ্চারিত হয়নি ও দেশের মানুষের মনেও এ ধারণা জন্ম নেয়নি। হঠাৎ করেই যেন বিগত এক দশক ধরে ধর্মনিরপেক্ষবাদের ধোয়া তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অবজ্ঞা করার একটি প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি কি? এ নিয়ে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে আলাপ হয়। আমি তাকে বললাম, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র অর্থ হচ্ছে ‘ধর্মহীনতা’। সাংবাদিক বন্ধুটি প্রতিবাদ করে বলল, আপনার এ কথাটি সঠিক নয়। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, বেঠিক কি? আপনি ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ বলতে কী বোঝেন? ‘নিরপেক্ষ’ মানে কি এই নয়, ‘আমি কোনো কিছু বা কারো পক্ষে নই’? তার মানে, আমি কোনো ধর্মের পক্ষে নই। অর্থাৎ আমার ধর্ম নাই। সাংবাদিক বন্ধুটি বেশ জোর গলায় বলতে লাগল, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি ঠিক এ অর্থে বোঝায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কোন অর্থে বোঝায়? এ শব্দটি বলা হচ্ছে কেন? আপনি যদি ‘নিরপেক্ষ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে আপনাকে তো মানতেই হবে ধর্ম হোক বা অন্য কোনো বিষয়ে হোক আপনি কোনোটিরই পক্ষে নন। এটাতো হতে পারে না। নিশ্চয়ই আপনার একটা পক্ষ আছে। এমনকি যে ব্যক্তি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ কথা বলছে, তারও তো একটা ধর্ম আছে (নাস্তিক হলেও সেটা তার একটা নীতি বা একটা পক্ষ)। তিনি বললেন, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা অর্থে বোঝায় না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিন। তিনি এর জবাব দিতে পারেননি। আমি তাকে বললাম, আপনারা যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তারা একটা হুজুগের মধ্যে আছেন। একটা সময় ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি বেশ হুজুগ সৃষ্টি করেছিল। কয়েক দশক ধরে কিছু মানুষ তাতে মেতে ছিল। তাদের ঘুম ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। এক সময় দেখল সেক্যুলারিজমের ওপর ভিত্তি করে যেসব দেশ ও সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা খানখান হয়ে গেছে। মানুষ যার যার ধর্মের দিকে ফিরে গেছে। তারা বুঝতে পারছে ধর্মছাড়া কিছুকাল যেমন খুশি তেমন চলা যায়। আদতে তা জীবনবিধান হতে পারে না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা না বলে বলুন, যার যার ধর্ম সে সে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পালন করুক। এ কথা আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। আপনারা যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে ধর্মহীনতা না বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে শব্দটি বদলে ফেলুন। অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করুণ। সাংবাদিক বন্ধুটি আর কথা বলতে পারলেন না। বসা থেকে উঠে চলে গেলেন। আসলে আমাদের দেশের কিছু লোক ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অতি প্রগতিশীল বা আধুনিক হতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। হুজুগের মধ্যে পড়ে অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কথা, এমনকি নিজের পরিবারের ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা ভুলে ধর্মের বাইরে চলতে চাইছে। ধর্মের কথা বললেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে। এর কারণ হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বা প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বা একে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাশ কাটানো যায় এবং বেলেল্লাপানাসহ অশ্লীল যত কাজ আছে তা করা যায়। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সূক্ষ্ণভাবে ধর্মহীনতার বিষয়টি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে, দুঃখের বিষয় তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন, তারা কি বুঝতে পারছেন না, বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমানকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না? পৃথিবীর কোনো দেশই তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না। এটাই সত্য এবং বাস্তব। আমরা কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কথা বলব? যে দেশের ধর্মভীরু মানুষ কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে সেখানে নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা তাদের চিরায়ত বিশ্বাসে আঘাত করা। তাদের বিশ্বাসে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। অথচ বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করা। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্তেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি রাষ্ট্র আলাদা কোন শরিয়া ভিত্তিক আদালত গঠন করেনি। অথচ মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম এবং তাদের আলাদা শরিয়া ভিত্তিক আদালত রয়েছে। এ থেকেই তথাকথিত সেক্যুলারিস্টদের বোঝা উচিত, অন্য যে কোন মুসলিম দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা চিন্তা-চেতনা ও সহনশীলতায় অনেক এগিয়ে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়া তুলে লাভ নেই।
দুই.
অনেকে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার অনুচিত বলে মনে করেন। তাদের এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, যিনি রাজনীতি করেন, মন্ত্রীত্ব করেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, তিনি যদি প্রকৃতই ধর্মে বিশ্বাসী হন (যে ধর্মেরই হোক), তবে তার কর্মকান্ডে ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণের প্রভাব ও প্রতিফলন থাকবেই। এক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রয়োজন পড়ে না। বরং তার ধর্ম বিশ্বাসই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে পরিচালিত করে। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়াতে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিকসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইসলামের চেতনাবোধ রয়েছে। যে কোন শুভ কাজ শুরুর আগে মুসলমানরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করে। আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে শেষ করে। এটা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থেকেই করেন। অর্থাৎ হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরাত্মায় ইসলামী মূল্যবোধের চেতনা প্রোথিত হয়ে আছে। এটাই বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বিশ্বে ওয়ান অ্যান্ড ওনলি সুপার পাওয়ার আমেরিকা। এই আমেরিকা কি ধর্মকে উপেক্ষা করতে পারছে বা করছে? মোটেই না। বরং তারা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরুই করেন ধর্মের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন সাধারণত তিনি বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উঁচিয়ে ধরেন। শপথের শেষ বাক্যে বলেন, ‘সো হেল্প মি গড’। তারা যে কোন সভা-সমাবেশ এই বলে শেষ করেন, ‘গড ব্লেস আমেরিকা’। এমনকি তাদের যে ডলার, সেখানেও তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা এবং ব্যবহার রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ধর্মের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা তা মেনে চলেন। এ নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে কোন হইচই হতে দেখা যায় না। এমনকি সেখানে যারা ধর্ম বিদ্বেষী বা ধর্মের নাম শুনলেই রেগে যান, তারাও ধর্মের কথা লেখা ডলারই ব্যবহার করছেন। অথচ আমাদের দেশের কিছু লোক, যারা নিজেদের অতি প্রগতিবাদী মনে করেন, কেউ ধর্মের কথা বললেই মনে করেন তিনি মৌলবাদী-তারা এ কথা বুঝতে চান না, বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মের প্রাধান্য থাকাই স্বাভাবিক এবং এই বাস্তবতা উপেক্ষার সুযোগ নেই। বরং তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ধোয়া তোলার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও মতলববাজি রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফায়দা লুটতে চায়। পার্শ্ববর্তী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা হলেও, সেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে জীবনচর্চা হয় না, রাজনীতিও হচ্ছে না। ধর্ম নিয়ে ভারতে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি তারা ধর্ম দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বিশ্বে তারা বিভিন্নভাবে তাদের ধর্মাচার তুলে ধরছে। মুম্বাইয়ের সিনেমাগুলোর ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আধুনিকতার মাঝেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করছেন। ঘরে আলাদা করে পুজোর জন্য দেব-দেবীর মূর্তি রেখে দিচ্ছে। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করছে। এমনকি বাংলাদেশে জনপ্রিয় কলকাতার বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালগুলোতেও তাদের ধর্মচর্চা ব্যাপক হারে দেখানো হচ্ছে। হলিউডের সিনেমায়ও গির্জায় গিয়ে এবং খাওয়ার আগে প্রার্থনার দৃশ্য অহরহ দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও আমাদের দেশে এ সময়ের সিনেমা বা মেগা সিরিয়ালে ধর্ম চর্চার ব্যবহার দেখানো হয় না বললেই চলে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়েও একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক ইসলামী রাষ্ট্রের নিদর্শন রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ধর্ম নিয়ে কখনোই উগ্রতা প্রদর্শন বা বাড়াবাড়ি হয় না, হওয়ার আশঙ্কাও নেই। কিছু লোক যারা, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে ধর্মহীনতা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তারা প্রকারন্তরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছেন। তাদের এ উপেক্ষা করা বোকার স্বর্গে বসবাস ছাড়া কিছুই নয়।
তিন.
ধর্মের প্রতি মানুষের উদাসীনতা আত্মিক বন্ধন শিথিল করে। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধকে দূরে ঠেলে দেয়। বিশ্বাসী মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ থেকে দূরে থাকলেও, যে কোন বিপদে-আপদে বা অসুখ-বিসুখে ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি ধর্মীয় কোন উপলক্ষ্য বা সমাবেশে তাদের সুপ্ত বিশ্বাস জাগ্রত হয়। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে রমজানে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আচরণ ও অনুশাসনের চর্চা বেশি দেখা যায়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবেও এ ধারা লক্ষ্যণীয়। ধর্মের প্রতি তাদের মনে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি এবং এর প্রতিফলন তাদের জীবনাচরে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। অর্থাৎ মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ধর্মই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে যে সংঘাত-সহিংসতা চলেছে, তার পেছনে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবই নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। ব্রিটেনে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মাদকাশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ এবং নীতি-নৈতিকতার সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক সময় মুসলমানদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ক্ষয়ীষ্ণু ব্রিটিশ সংস্কৃতির উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষায় মুসলমানরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি ব্রিটিশদের জীবনধারা অন্য কোন দেশের ধারায় নয়, এশিয়ানদের মতো হওয়া উচিত। এতে ব্রিটিশদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার এ উপলদ্ধি থেকে বোঝা যায়, ব্রিটেনে যে সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় চলছে, তার মূলে মূল্যবোধের সংকটের বিষয়টিই প্রধান কারণ হয়ে রয়েছে। এ সংকটের পেছনে ধর্মীয় চেতনাবোধের অভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্যামেরন মনে করেছেন, মুসলমান রীতি-নীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এশিয়ানদের সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনযাপনের ধারাই পারে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে। বিষয়টি উপলব্ধি করে কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ সরকারের আংশিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত বানিজ্যিক চ্যানেল ‘ফোর’ পবিত্র রমজান উপলক্ষে রমজানের প্রতিদিন তিন মিনিট ফজরের আজান প্রচার করে। ফজরের আজান প্রচার করা ছাড়াও অপর চার ওয়াক্ত নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্র প্রচার করে। পাশাপাশি তাদের ওয়েব সাইটেও তা সম্প্রচার করে। ইউরোপের কোন মূলধারার টিভি চ্যানেলে আজান প্রচারের নজির সেটিই প্রথম। এই আজান প্রচার করা নিয়ে সে সময় চ্যানেল ফোর-এর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান র‌্যালফ লি বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যে যে কয়টি ধর্মের প্রসার ঘটছে, তার মধ্যে ইসলাম অন্যতম। তিনি বলেন, যারা ইসলামকে সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন, তাদের ভুল ভাঙ্গানোর জন্যই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বেও ইসলামের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে এখন স্বীকার করা হচ্ছে। ইসলাম যে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ অটুট রাখার বর্ম এবং শান্তির ধর্ম, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে। ধর্মের প্রতি আকর্ষণ এবং সংবেদনশীলতা আমেরিকানদের মধ্যেও প্রবল। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ধর্ম নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। তিনি মুসলমান নাকি খ্রিস্টান, এ নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে সন্দেহ দানাবাঁধে। সে সময় ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার এক জরিপে দেখানো হয়, শতকরা ২০ ভাগ আমেরিকান মনে করে ওবামা মুসলমান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে থাকে, তিনি গোপনে মুসলমান ধর্ম পালন করেন, মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন, ২০০৫ সালে সিনেটর হিসেবে কোরআন হাতে নিয়ে শপথ নিয়েছেন, তার নামের মাঝে মুহম্মদ আছে এবং তিনি খ্রিস্টান বিরোধী। আমেরিকানদের এই উদ্বেগের কারণ, তারা কোনভাবেই তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরের একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। এসব বিতর্ক এড়াতে ওবামাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। বিতর্কের অবসান ঘটাতে তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হয়েছে, ‘আমি একজন খ্রিস্টান। প্রতিদিন প্রার্থনা করি। আমি মনে করি, ‘আমি যে খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী, আমার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করা আমার দায়িত্ব। তিনি ধর্মীয় আবেগ থেকে বলেন, আমরা মানুষ। মানুষই ভুল করে, পাপ করে। সৃষ্টি কর্তার দয়ার মধ্য দিয়ে এ থেকে আমরা মুক্তি পাই।’ ওবামাকে নিয়ে সে সময় আমেরিকানদের উদ্বেগের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয়, আমেরিকানদের অধিকাংশের জীবনযাপনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা না থাকলেও, অন্য ধর্মের প্রেসিডেন্টকে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য ধরে রাখতে সবসময়ই তৎপর। ধর্মের প্রতি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের জনগণ যখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল, তখন আমাদের দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে এই চেতনা আরও বেশি কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
চার.
বাংলাদেশে যে ধর্মীয় কোন উন্মাদনা নেই, তা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যে বহুবার বলেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বলা বাহুল্য, যেখানে বিশ্বের কোন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘোষণাতেই জঙ্গী ও সন্ত্রাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশকে বারবার মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফরে এসেও এ ধরনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ বিশ্বে সহনশীল ও সব ধর্মের মানুষের বসবাসের আদর্শ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সামনে বিশ্বে একটি আদর্শ এবং আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেল হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ইসলামী মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং রীতি-নীতি চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এখানে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মহীনতার কথা বলছে তাদের কথা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কখনো শোনেনি এবং শুনবেও না। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার পাতা ফাঁদে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ফেলা যাবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
রাসেল আহাম্মেদ ১ জুন, ২০১৮, ৪:২৯ এএম says : 0
সুন্দর লেখাটির জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
Amir ১ জুন, ২০১৮, ১০:১৪ এএম says : 0
'Rastrer dhormer khetre niropekkho obosthan' --ektike bad die arekti dhormoke pisthoposokota korbena, rastro pisthoposokota korle sokol dhormokei korbe gonotantrik vabe. Etai hosse rastrer chokhe 'Dhormoniropekkhota'. aponar lekhar vitoroi eta aponi prokash koresen. Otoeb mimangsito bisoy nie jotilotar sristi kora ki jukti jukto?
Total Reply(0)
মাহবুব ২ জুন, ২০১৮, ১১:৩৩ পিএম says : 0
এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন ভালো লেখা,ভালো লাগল। আমার একটি প্রশ্ন সেক্যুলার পন্থী ভাইদের কাছে--আপনারা যে ব্যখ্যা প্রদান তাই মেনে নিলাম।ধর্মীয় উস্কানীমূলক কবিতা তথা সাহিত্য রচনা,ফ্লিম তৈরী,ফিচার লেখা কি আপনাদের ব্যখ্যার সাথে বৈসাদৃশ্যমূলক নয়? প্রমান শতাধিক।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন