শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পরাজয়

প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ আবদুল লতিফ নেজামী

তুরস্কে এবারই প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর আগে আরো কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। ১৯৬০ সালের মে মাসে তুরস্কে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেটি ছিল তুরস্কে ওসমানীয় শাসন পরবর্তীকালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। পরবর্তীতে তুরস্কে একের পর এক সরকারবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৬০ সালের পর ১৯৭১, ১৯৮০ ও ১৯৮৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। ২০০৭ সালেও আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৬ সালেই প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় তুর্কি জনগণের প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে।
তুরস্কে ১৯৬০ সালে সংঘটিত প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আলি আদনান মেন্দারেস। তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জালাল বায়ার। ১৯৫০-এর নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক পার্টি বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। পাশ্চাত্যমুখী আলি আদনান মেন্দারেসের শাসনামলে ১৯৫২ সালে তুরস্ক ন্যাটোর পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করে। তার আমলে সেন্টা, সিয়াটো সামরিক জোট গঠিত হয়।
পাশ্চাত্যমুখী হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য জীবনধারার অনুশীলন মেন্দারেসের কাম্য ছিল না। জীবনযাপনে চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসরণ প্রশ্নে মেন্দারেস সহনশীল ছিলেন। পুরুষ ও নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারে তিনি ছিলেন নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার পক্ষে। ইসলামী রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান পালন তিনি অপছন্দ করতেন না। আজানে আরবি শব্দ ব্যবহারকে আইনি বৈধতাদানের একটি মাত্র দাবিতে ১৯৫০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আরবি শব্দে আজান নিষিদ্ধ করেছিলেন কামাল আতাতুর্ক। তাছাড়া ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি মেন্দারেস সহানুভূতিশীল ছিলেন। ইসলামের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কারণে মেন্দারেসের প্রতি সেনাবাহিনী এই মর্মে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে যে, মেন্দারেস কামাল আতাতুর্কের উত্তরাধিকার খ-ন করতে চলেছেন। এই দ্বন্দ্বের কারণেই ১৯৬০ সালের মে মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানে মেন্দারেস ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং এক প্রহসনমূলক বিচারে মেন্দারেসকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৫ জন মন্ত্রীসহ তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
কামাল আতাতুর্ক ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর ক্ষমতাসীন হয়ে গায়ের জোরে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেন। বন্দুকের মুখে প্রতিষ্ঠিত এই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করতে গিয়ে শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষ শাহাদাতবরণ করেন। ১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ওসমানীয় খেলাফত ১৯২৪ সালে বিলুপ্ত করেন। কামাল আতাতুর্ক ওসমানীয় খেলাফত বিলুপ্ত করে তুরস্ককে পশ্চিমা ধাঁচে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। ১৯২৫ সালে তিনি ইসলামভিত্তিক শরিয়াহ আদালত বাতিল করেন। ১৯২৬ সালে ওসমানীয় সা¤্রাজ্য প্রবর্তিত ও ইসলামী বিধানের পরিবর্তে সুইস সিভিল ও ইতালিয়ান দ-বিধি চালু করেন। তুর্কি সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বাদ দেয়া হয়। ১৯২৮ সালের ১ নভেম্বর তুরস্কের পার্লামেন্ট বিদ্যমান আরবি বর্ণমালার স্থলে ল্যাটিন বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। কামাল আতাতুর্ক কোরআন শরিফ তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে নতুন বর্ণমালায় তা প্রকাশ করার আদেশ দেন। তবে তুর্কি ভাষায় আজান এবং নামাজ আদায়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। তুর্কি ভাষায় কোনো দিনই মুসলমানদের নামাজ আদায় করাতে পারেননি। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামা, মুফতিদের দুটি জাহাজে বোঝাই করে ভূমধ্যসাগরে তাদের মর্মান্তিক ইন্তেকাল নিশ্চিত করা হয়। পুরুষ ও মহিলাদের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন, মক্তব বিলুপ্তি এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার করা হয়। পীর, ফকির ও দরবেশদের আস্তানা ও খানকাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।
কামাল আতাতুর্ক ওসমানীয় খেলাফত কর্তৃক প্রণীত পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী ভাবধারার প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ভাবাদর্শের রচনা, গল্প ও কবিতা প্রতিস্থাপন করেন। শিশুদের ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়, মাদ্রাসা-মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং হজ ওমরাহ পালন নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় উৎসবকে বর্জনীয় ঘোষণা করা হয়। বড় বড় মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে সেগুলোকে জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তুরস্কের সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘আয়া সুফিয়া’কে রূপান্তরিত করা হয় সরকারি জাদুঘরে।
এ ছাড়াও তুরস্কে আরবি হরফের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আরবিতে কোরআন তেলাওয়াত, নামাজ আদায় ও আজান দেয়া নিষিদ্ধ হয়। তুর্কি ভাষা আরবি হরফে না লিখে ল্যাটিন হরফে লেখা হতো। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার নির্ধারণ করা হয়। তুরস্কের অধিবাসীদের ইসলামী পোশাক বাদ দিয়ে ইউরোপীয় পোশাক পরিধানে বাধ্য করা হয়। তুরস্কের অধীন আজারবাইজানকে রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। বক্তৃতা ও বিবৃতিতে ইসলাম ও ইসলামী পরিভাষাসমূহ নিয়ে মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনা করে সেগুলো বর্জনের জন্য সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়। সরকারি লোকদের জামাতে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করা হয়। ইসলামী নিয়মকানুন অনুযায়ী ‘সালাম-কালাম’ নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরিবর্তে সুপ্রভাত সম্মোধন চালু করা হয়। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও দরবেশদের পাগড়ি-জুব্বা প্রভৃতি ইসলামী পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হিজরি সনের পরিবর্তে চালু করা হয় খ্রিষ্টীয় সন। ইসলামী নাম রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়। আলেম-ওলামাদের প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেয়া হয় এবং আলেমদেরকে প্রজাতন্ত্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ২৭ বছর তুরস্কে এক ব্যক্তির একদলীয় ডিক্টেটরশিপ কায়েম থাকে। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় একটি দল প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া হয়। সেটির নাম ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি। নেতা ছিলেন আলি আদনান মেন্দারেস। তার শাসনামল থেকেই শতভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্কে আবার ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করার কাজ শুরু হয়। আর রজব তৈয়্যব এরদোগানের আমলে এসে তা আরো বিকশিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।
১৯২৩ সালের পর ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ইসলামপন্থি রাফা পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করলে সেনাবাহিনী তাকে অতি অল্প সময়ে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১৮ জুন ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের দল রাফা পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা হয়।
যার কারণে আজ আবার তুরস্কের মুসলিম মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী হিজাব ও জিলবার (স্কার্ফ) পরিধান করছেন। মুসলিম মহিলারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরিধানের অধিকার লাভ করে। তুরস্কের এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে, সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও দমন নীতি মোকাবেলা করে ইসলাম আবারো তুরস্কে ফিরে আসছে, আপন আদর্শ ও আসল ঐতিহ্য নিয়ে এবং ইসলামই তুরস্কে আবারো নেতৃত্ব দেবে। যার নেতৃত্বে তুর্কি নাগরিকরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ত্যাগ করে শাশ্বত ধর্ম ইসলামের দিকে আবার ঝুঁকে পড়েছেন তিনি হলেন তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগান।
এরদোগান এক সময় জীবন-জীবিকার তাগিদে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায় লেবু ও পিঠা বিক্রি করতেন। ইস্তাম্বুলে মেয়র থাকাকালে একটি মিছিলে ইসলামী কবিতা পড়ার জন্য যেই এরদোগানকে স্বল্প মেয়াদের কারাবাস করতে হয়েছিল। তিনি এখন তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যারিশম্যাটিক নেতা। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, সেই রজব তৈয়্যব এরদোগান। ৬১ বছর বয়সী এই মানুষটি তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন। আগামী দিনগুলো তার জন্য আরো কুসুমাস্তীর্ণ হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মহল। তার দল জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একেপি) নির্বাচনে বার বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ায় ১৩ বছরের শাসনকে আরো প্রলম্বিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
রজব তৈয়্যব এরদোগান তার দীর্ঘদিনের মিত্র আবদুল্লাহ গুল ও অন্যদের সঙ্গে মিলে ২০০১ সালে একে পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের মানুষ একে পার্টিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেয়। ২০০২ সাল থেকে দলটি প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছে। একেপি ২০০২ সালে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। ২০০২ সালে এই পার্টি আসন পেয়েছিল ৩৬৩টি, ২০০৭ সালে ৩৪১, ২০১১ সালে ৩২৭ এবং ২০১৫ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ২৫৮টি আসন পায় একেপি। জুন মাসের নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন না পাওয়ায় কোয়ালিশন গঠন করতে ব্যর্থ হওয়ায় নভেম্বরে নতুন নির্বাচনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। সেই নির্বাচনে ৫২% ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় একেপি। ২০০২ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও কারাদ-ের কারণে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি দলনেতা এরদোগান। পার্লামেন্টে নতুন আইন পাসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন।
তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ব্যর্থতায় ইসলামপন্থিদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাওয়াই বার বার সেদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণ। ধর্মনিরপেক্ষ সভ্যতার বিকল্প মডেল হিসেবে ইসলাম রাষ্ট্রিক চেতনা, বিকল্প রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনা এবং পবিত্র কোরআনকে ভিত্তি করে সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবন গড়ার লক্ষ্যে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার চালকের আসনে এরদোগান বসায় ইসলামের প্রতিযোগিতা উচ্চকিত হয়ে ওঠায় পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষকরণ গোষ্ঠীর তাঁবেদার তুর্কি সেনাবাহিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সেনাবাহিনীর বড় রকমের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ক্ষয়িষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ রক্ষায় সেনাবাহিনী ইসলামপন্থি এরদোগান সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
শুধু তুরস্কে নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রবাদীদের ব্যর্থতায় সমগ্র বিশ্বে ইসলামপন্থিদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে চলেছে। কারণ মুসলমানরা এমন একটি ঐশী গ্রন্থের অনুসারী যা বিশ্বব্যাপী অতুলনীয় প্রশংসার অধিকারী। মুসলমানদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-বিজ্ঞান, প্রভৃতি এতো উৎকৃষ্ট যে, তার উত্তরাধিকারত্ব অর্জন পৃথিবীর যে কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষেই শ্লাগার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের উদ্ভাবিত রাজ্য শাসন-ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল যে, তা রোমান ও বৃটিশ শাসন ব্যবস্থাকেও হার মানিয়েছে। তাছাড়া ইসলাম এখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্ম (নিউজ ওয়ার্ল্ড, নিউইয়র্ক)। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। ইতিহাসে প্রথম খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীর চেয়ে সারা বিশ্বে মুসলমান ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা বেশি। খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের তীর্থস্থান ভ্যাটিকান সিটি থেকে প্রকাশিত সংবাদ বুলেটিনে এ খবর জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৯.২ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন ইসলাম ধর্ম অনুসারী। ভ্যাটিকান সিটির পরিসংখ্যান মতে খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা এখন বিশ্বের ১৭.৪ শতাংশ। ভ্যাটিকান সিটিতে পরিসংখ্যান সংরক্ষণকারী ধর্ম যাজক মনসিগনর ভিটরিও ফোরমেন্টি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ইসলাম ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মকে টেক্কা দিয়েছে। তিনি বলেন, ক্যাথলিক বিশ্বাসীরা এখন আর সংখ্যার দিক থেকে প্রথম স্থানে নেই। তাই খ্রিস্টান বিশ্ব ইসলামের এই উত্থানকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে নানা ফন্দি-ফিকির অবলম্বন করে চলেছে।
তাছাড়া ইসলাম একটি সমতাবাদী ধর্ম। ইসলামে বিভাজন নেই। আহার-বিহারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। মুসলমানদের মধ্যে একত্রে বসে খাবারের প্রবণতা আছে। ইসলাম ধর্ম সমতাবাদী ও মানবিক। ইসলামই সমতাবাদী সমাজের ধারণা সৃষ্টি করেছে। এ কারণে অমুসলিমরা ইসলামের দিকে ঝুঁকছেন। ইসলামে অস্পৃশ্যতার স্থান নেই। এ কারণে ভারতে অতি সম্প্রতি কয়েকশ লোক এক সাথে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে ঈমানদার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। ইসলামে সমতাবাদী চেতনার প্রাধান্য রয়েছে। মানুষকে তার যোগ্যতা অনুসারে কর্মে নিয়োজিত করার সুযোগ বিদ্যমান থাকার নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্বকে ধর্মনিরপেক্ষকরণের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ায় বিশ্বের নবপ্রজন্ম ইসলামের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। তুরস্ক তার প্রমাণ।
তুর্কি জনগণ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তারা ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর অনুসারী থাকতে চান। তারা তাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-বিজ্ঞান প্রভৃতি ধারণ, চর্চা ও অনুশীলন করতে চান। শুধু মুসলমান নন, পৃথিবীর যে কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষেই ইসলাম শ্লাগার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মুসলমানদের উদ্ভাবিত রাজ্য শাসন-ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল যে, তা রোমান ও বৃটিশ শাসন ব্যবস্থাকেও হার মানিয়েছে।
তুরস্কে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতায় তুর্কি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা এবং ইসলামী চেতনার প্রতিফলন যেমন হয়নি, তেমনি তুর্কি জনগণের চিন্তা-চেতনার রূপায়ণ ও অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি ঘটেনি। তুর্কি জনগণের জীবনধারা প্রমাণ করেছে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ নয়। এই বাস্তব ও সত্য কথাটা ভুলে বুদ্ধিবৃত্তির সিন্ডিকেট করে সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায়ে তুরস্কের আদর্শিক মূল শিকড় কেটে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে জোর করে সংবিধানে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। সংবিধান একটি দেশের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন। দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা, ঈমান-আকিদার রূপায়ণ। জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। তুর্কি জনগণের চিন্তা-চেতনার রূপায়ণ ও অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসেবে সেদেশের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আলি আদনান মেন্দারেস ও ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। কিন্তু তাদের সেই প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করে পশ্চিমা ঘেঁষা ও মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের বশংবদ তুর্কি সেনাবাহিনী।
রজব তৈয়্যব এরদোগান ক্ষমতাসীন হয়ে জনগণের অনুভূতির কথা বিবেচনা করে অনেক ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনেন। কেননা পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এটাই গণতন্ত্রের কথা। তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি অংশ এরদোগানের ইসলামভিত্তিক গণমুখী পদক্ষেপ বাঞ্চাল করার জন্যই সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী অন্যান্য মুসলিম দেশকেও তুরস্ক থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
লেখক : ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন