ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কি? এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তারা এর অর্থ গভীরভাবে ভাবেন বলে মনে হয় না। সাধারণভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যারা ব্যবহার করেন, তারা এর মাধ্যমে যা বোঝাতে চান, আদতে তা বোঝায় না। এ নিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে আলাপ হয়, যিনি ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বেশ উচ্চকিত। বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললাম, ভাই, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র অর্থ হচ্ছে ‘ধর্মহীনতা’। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, আপনার এ কথাটি সঠিক নয়। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে সঠিকটা কি? ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কি? ‘নিরপেক্ষ’ মানে কি এই নয়, ‘আমি কোনো কিছু বা কারো পক্ষে নই’? কোনো ধর্মেরও পক্ষে নই। আমার ধর্ম নাই। সাংবাদিক বন্ধুটি বেশ জোর গলায় বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি এ অর্থে বোঝায় না। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কোন অর্থে বোঝায়? আপনি যদি ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তাহলে আপনাকে তো মানতেই হবে, ধর্ম হোক বা অন্য কোনো বিষয়ে হোক আপনি কোনোটিরই পক্ষে নন। তিনি বললেন, না না বিষয়টা এমন নয়। প্রশ্ন করলাম, তাহলে কেমন? এটা কি হতে পারে, আপনি কোনোটারই পক্ষে না? এদিকও না সেদিকও না। তবে হ্যাঁ, আপনি এমন এক নীতি অবলম্বন করতে পারেন, যা মাঝামাঝি। তবে এটাও কিন্তু একটা নীতিÑযা কোনো কিছুর সাথে নেই। যিনি ধর্ম মানেন না বা নাস্তিক, সেটাও তার একটা নীতি। তিনি নিজস্ব যুক্তি দিয়ে এ নীতি বা পথ বিশ্বাস করেন। তবে আপনি ধর্মবিশ্বাসী হয়ে যখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবেন, তখন কিন্তু তা স্ববিরোধী হয়ে যায়। তিনি বললেন, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা অর্থে বোঝায় না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিন। তিনি এর জবাব দিতে পারেননি।
বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে ধর্মাবলম্বী বা বিশ্বাসীদের (যে ধর্মেরই হোক না কেন) সংখ্যাই বেশি। এই যে সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে এবং যার কোনো প্রতিষেধক নেইÑএ অবস্থায় ধর্মাবলম্বীরা যার যার ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্য কামনা করছে। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। অস্ট্রেলিয়ায় আমার এক কাজিন থাকেন যিনি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। সেখানে একটি খাবারের দোকানে ক্যাশিয়ারের চাকরি করেন। অস্ট্রেলিয়ান এক কাস্টমার বিল দিতে এসে হাঁচি-কাশি দেয়া শুরু করে। কাজিন একটু দূরে সরে যান। কাস্টমারটি জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ এফ্রেইড অফ করোনাভাইরাস? কাজিন জবাবে বললেন, ইয়েস আই এম, ডোন্ট ইউ? কাস্টমার জবাব দিলেন, ডোন্টওরি জেসাস প্রটেক্ট আস। প্রে টু জেসাস। তিনি তাকে আহŸান জানিয়ে বললেন, কাম টু জেসাস। অর্থাৎ কাস্টমারটি এক কাজে দুই কাজ করলেন। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থণা এবং তার ধর্মের দিকে আহŸান জানালেন। কাজিনটি বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি আর কেনো কথা বাড়ালেন না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, বিশ্বাসী মানুষ যে কোনো বিপদে স্ব স্ব ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার দ্বারস্থ হয়। আধুনিকতা বা অতি প্রগতিশীলতার কারণে কেউ কেউ কিছু সময় ধর্মকে উপহাস বা ভুলে থাকলেও বিপদে ঠিকই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে। এখন যেমন করোনার মহামারি আকার ধারণ করায় দেশে দেশে বিশ্বাসী সৃষ্টিকর্তার কৃপা প্রার্থনা করছে। আবার কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পে সৃষ্টিকর্তার নাম জপ করতে থাকে। এ সময় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদেরও স্ব স্ব ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করতে দেখা যায়। অথচ প্রগতিশীলতার নামে একটি ভুল ধারণা নিয়ে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে নিজেকে জ্ঞানী বা পন্ডিত মনে করছে।
দুই.
পরিবর্তনশীল মুসলিম বিশ্বে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আগামীতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেবেÑএমন সম্ভাবনার কথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইসলাম বিশারদ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। তাদের এই আশাবাদ অমূলক নয়। ভৌগলিক অবস্থান ও ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে, মুসলমানদের মধ্যকার সুদৃঢ় বন্ধন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির অনুকুল পরিবেশের কারণেই বাংলাদেশকে আদর্শ মুসলমানের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অন্তর্গত বিষয় এবং বিশ্বাসের ভিত্তি এবং এর বাইরে যাওয়ার যে সুযোগ নেই, এ বাস্তবতার আলোকেই এ কথা বলছেন। অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হিন্দু প্রধান দেশ হিসেবে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করাই স্বাভাবিক। তেমনি বৌদ্ধ প্রধান দেশ হিসেবে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভূটান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়াও বৌদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্ম প্রধান দেশও খ্রিস্টান দেশ হিসেবে পরিচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্ম প্রাধান্য দিয়েই একটি দেশের মূল পরিচয় ফুটে উঠে। স্ব স্ব দেশের সরকারকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যেখানে ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান, সেখানে তাদের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ বাদ দিয়ে একটি গোষ্ঠী সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চিরায়ত ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার এক ধরনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেক্যুলারিজমের ধোঁয়া তুলে ধর্মকে দূরে ঠেলে দেয়ার আহŸান জানানো হচ্ছে। অথচ যেখানে ভারত বরাবরই তাকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে মনে করে, সেখানেই এখন হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ধর্মনিরপেক্ষতা ঝেড়ে ফেলে দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশটির দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিতাড়ন করে পুরোপুরি একটি হিন্দু দেশে পরিণত করার জন্য নাগরিকত্ব আইন পাস করেছে। মোদি এবং তার দলের নেতারা ভারতকে ‘হিন্দুস্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিশ্বের আর কোনো দেশ এভাবে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশকে ডাকে কিনা, জানা নেই। অথচ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে একটি শ্রেণী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে চাইছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং এখানে কেবল মুসলমানরাই থাকবেÑএমন কথা কখনো উচ্চারিত হয়নি এবং দেশের মানুষের মনেও এ ধারণা জন্ম নেয়নি। আমাদের দেশের কিছু লোক ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অতি প্রগতিশীল বা আধুনিক হতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কথা, এমনকি নিজের পরিবারের ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা ভুলে ধর্মের বাইরে চলতে চাইছে। ধর্মের কথা বললেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে। এর কারণ হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বা প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বা একে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাশ কাটানো যায় এবং বেলেল্লাপানাসহ অশ্লীল যত কাজ আছে তা করা যায়। অথচ পৃথিবীর কোনো দেশই তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না। এটাই সত্য এবং বাস্তব। আমরা কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কথা বলব? যে দেশের ধর্মভীরু মানুষ কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা কুমতলব ছাড়া কিছুই নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করা। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্তে¡ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি রাষ্ট্র আলাদা কোন শরিয়া ভিত্তিক আদালত গঠনেরও প্রয়োজন পড়েনি। অথচ মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং তাদের আলাদা শরিয়াভিত্তিক আদালত রয়েছে। এ থেকেই তথাকথিত সেক্যুলারিস্টদের বোঝা উচিত, অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মুসলমানরা চিন্তাÑচেতনা ও সহনশীলতায় অনেক এগিয়ে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়া তুলে লাভ নেই।
তিন.
অনেকে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার অনুচিত বলে মনে করেন। তাদের এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, যিনি রাজনীতি করেন, মন্ত্রীত্ব করেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, তিনি যদি প্রকৃতই ধর্মে বিশ্বাসী হন (যে ধর্মেরই হোক), তবে তার কর্মকাÐে ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণের প্রভাব ও প্রতিফলন থাকবেই। এক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রয়োজন পড়ে না। বরং তার ধর্ম বিশ্বাসই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে পরিচালিত করে। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়াতে আমাদের সামাজ ও পারিবারসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইসলামের চেতনাবোধ রয়েছে। যে কোন শুভ কাজ শুরুর আগে মুসলমানরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করে। আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে শেষ করে। এটা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থেকেই করেন। অর্থাৎ হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরাত্মায় ইসলামী মূল্যবোধের চেতনা প্রোথিত হয়ে আছে। এটাই বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকা কি ধর্মকে উপেক্ষা করতে পেরেছে বা পারছে? পারছে না। বরং তারা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরুই করেন ধর্মের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন সাধারণত তিনি বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উঁচু করে ধরেন। শপথের শেষ বাক্যে বলেন, ‘সো হেল্প মি গড’। তারা যে কোন সভা-সমাবেশ এই বলে শেষ করেন, ‘গড বেøস আমেরিকা’। এমনকি তাদের যে ডলার, সেখানেও তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা এবং ব্যবহার রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ধর্মের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা তা মেনে চলেন। এ নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে কোন হইচই হতে দেখা যায় না। এমনকি সেখানে যারা ধর্মবিদ্বেষী বা ধর্মের নাম শুনলেই রেগে যান, তারাও ধর্মের কথা লেখা ডলারই ব্যবহার করছেন। ব্রিটেনে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মাদকাশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ এবং নীতিÑনৈতিকতার সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বৃটেনের এক সময়কার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন মুসলমানদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। এতে ব্রিটিশদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, মুসলমান রীতি-নীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনযাপনের ধারাই পারে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ধর্ম নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। তিনি মুসলমান নাকি খ্রিস্টান, এ নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। সে সময় ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার এক জরিপে দেখানো হয়, শতকরা ২০ ভাগ আমেরিকান মনে করে ওবামা মুসলমান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে থাকে, তিনি গোপনে মুসলমান ধর্ম পালন করেন, মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন, ২০০৫ সালে সিনেটর হিসেবে কোরআন হাতে নিয়ে শপথ নিয়েছেন, তার নামের মাঝে মুহম্মদ আছে এবং তিনি খ্রিস্টান বিরোধী। আমেরিকানদের এই উদ্বেগের কারণ, তারা কোনভাবেই তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরের একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। এসব বিতর্ক এড়াতে ওবামাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। বিতর্কের অবসান ঘটাতে তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হয়েছিল, ‘আমি একজন খ্রিস্টান। প্রতিদিন প্রার্থনা করি। আমি মনে করি, ‘আমি যে খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী, আমার কর্মকাÐের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করা আমার দায়িত্ব। তিনি ধর্মীয় আবেগ থেকে বলেন, আমরা মানুষ। মানুষই ভুল করে, পাপ করে। সৃষ্টি কর্তার দয়ার মধ্য দিয়ে এ থেকে আমরা মুক্তি পাই।’ ওবামাকে নিয়ে সে সময় আমেরিকানদের উদ্বেগের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয়, আমেরিকানদের অধিকাংশের জীবনযাপনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা না থাকলেও, অন্য ধর্মের প্রেসিডেন্টকে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ধর্মের প্রতি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের জনগণ যখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল, তখন আমাদের দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মধ্যে এই চেতনা আরও বেশি কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের দেশের কিছু লোক, যারা নিজেদের অতি প্রগতিবাদী মনে করেন, কেউ ধর্মের কথা বললেই মনে করেন তিনি মৌলবাদী। তারা এ কথা বুঝতে চান না, বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামের প্রাধান্য থাকাই স্বাভাবিক এবং এই বাস্তবতা উপেক্ষার সুযোগ নেই। বরং তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়া তোলার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও মতলববাজি রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের হাজার বছরের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফায়দা লুটতে চায়। পার্শ্ববর্তী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা হলেও, সেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে জীবনচর্চা হয় না, রাজনীতিও হচ্ছে না। ধর্ম নিয়ে ভারতে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি তারা ধর্ম দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। বিশ্বে বিভিন্নভাবে তাদের ধর্মাচার তুলে ধরছে। ধর্মের নামে গো-মূত্রও সেবন করছে। মুম্বাইয়ের সিনেমাগুলোর ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আধুনিকতার মাঝেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে। পূজার জন্য ঘরে আলাদা দেব-দেবীর মূর্তি রেখে দিচ্ছে। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করছে। এমনকি বাংলাদেশে জনপ্রিয় কলকাতার বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালগুলোতেও তাদের ধর্মচর্চা ব্যাপক হারে দেখানো হচ্ছে। অধিকাংশ তেলেগু সিনেমাগুলো শুরুই হয় মন্দিরের দৃশ্য দিয়ে এবং সিনেমার বেশিরভাগ জুড়েই থাকে মন্দির-পুরোহিত এবং পূজার দৃশ্য। হলিউডের সিনেমায়ও গির্জায় গিয়ে এবং খাওয়ার আগে প্রার্থনার দৃশ্য অহরহ দেখানো হয়। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও আমাদের দেশে এ সময়ের সিনেমা বা মেগা সিরিয়ালে ধর্ম চর্চার ব্যবহার দেখানো হয় না বললেই চলে। অথচ আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে তা দেখানোই স্বাভাবিক। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়েও আচার-আচরণে একটি উদার ও অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্রের নিদর্শন রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ধর্ম নিয়ে কখনোই উগ্রতা প্রদর্শন বা বাড়াবাড়ি হয় না, হওয়ার আশঙ্কাও নেই। কিছু লোক যারা, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে ধর্মহীনতা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তারা প্রকারন্তরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছে। তাদের এ উপেক্ষা করা বোকার স্বর্গে বসবাস ছাড়া কিছুই নয়।
চার.
ধর্মের প্রতি মানুষের উদাসীনতা আত্মিক বন্ধন শিথিল করে। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধকে দূরে ঠেলে দেয়। বিশ্বাসী মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা ধর্মীয় আচারÑআচরণ থেকে সাময়িক দূরে থাকলেও যে কোন বিপদে-আপদে বা অসুখ-বিসুখে ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি ধর্মীয় কোন উপলক্ষ্য বা সমাবেশে তাদের সুপ্ত বিশ্বাস জাগ্রত হয়। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে রমজানে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আচরণ ও অনুশাসনের চর্চা বেশি দেখা যায়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবেও এ ধারা লক্ষ্যণীয়। ধর্মের প্রতি তাদের মনে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি এবং এর প্রতিফলন তাদের জীবনাচরে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। অর্থাৎ মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ধর্মই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে যে সংঘাত-সহিংসতা চলেছে, তার পেছনে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবই নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মহীনতার কথা যারা বলছে, তাদের কথা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কখনো শোনেনি এবং শুনবেও না। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার পাতা ফাঁদে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যে ফেলা যাবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন