শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
এডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন আমার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। কোনো পত্রিকায় আমার লেখা তার চোখে পড়া মাত্রই সেলফোনের মাধ্যমে আমাকে জানাবেন আমার লেখা পড়ে তার ভাল বা মন্দ লাগার কথা। তিনি আমাকে প্রায়ই একটা কথা বলেন, যার সহজ অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সমাজের সর্বস্তরে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে তা থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই এবং আবার এমন কথাও বলেন শুধুমাত্র লেখালেখি করে কি সম্ভব সমাজ থেকে সকল অবক্ষয় দূর করা, যদি না রাজনীতি থেকে অপসংস্কৃতির চর্চা দূর করা যায়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের যেসব বিজ্ঞজনরা মনে করেন আমাদের সব ক্ষেত্রে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে তার জন্য কিছুসংখ্যক ব্যক্তির কিংবা গোষ্ঠীর অপরাজনীতিই দায়ী। আমরা যদি সূক্ষ্মভাবে সবকিছু অবলোকন করি তাহলে একটা বিষয় আমাদের চোখের সামনে অবশ্যই ধরা পড়বে আর তা হল, আমাদের সমাজ থেকে যেন নৈতিক মূল্যবোধটুকু দিন দিন কর্পুরের মতো একেবারে উধাও হয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা এমন এক অবস্থায় বাস করছি, যেখানে একজন ছাত্র নিরাপদ নয় তার শিক্ষকের কাছে কিংবা একটি শিশু সন্তান নিরাপদ নয় তার পিতামাতার কাছে। আবার বলা যায় একজন ভাই কিংবা একজন বোন নিরাপদ নয় নিজের ভাইবোনের কাছে। যারা সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশের খবরাখবর রাখেন তারা ভাল করে জানেন, আমাদের চারপাশে এখন শিশুহত্যার মহোৎসব চলছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র পাঠ করলে দেখা যায়, দুর্বৃত্তদের হাতে কিংবা আপন স্বজনের হাতে কোথাও না কোথাও শিশুরা হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে। এই যে অপঘাতে আমাদের আদরের ছোট্টমনিরা মারা যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা কোনো কথা বলছেন না। সবাই যেন নির্বিকার। শিশুদের হারিয়ে হত্যাকা-ের শিকার শিশুদের পরিবারের লোকজনের আর্তনাদ আমাদের সমাজপতিদের চেতনাকে আজ যেন নাড়া দিতে পারছে না। সমাজপতিদের কিংবা কর্তাব্যক্তিদের নীরবতা দেখে এমন কথাও বলা যাবে না যে, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা অল্প শোকে কাতর না হয়ে, অধিক শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন। সমাজপতিরা মনে করছেন দুর্বৃত্তদের হাতে কিংবা আপন স্বজনের হাতে আগেও শিশুরা খুন হয়েছে এখনও খুন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সমাজের ভাগ্যবান ব্যক্তিরা এ কথা বুঝেও বুঝতে চান না যে, একটা সমাজে শিশুহত্যা থেকে শুরু করে অপরাধের উৎসব তখনই চলে, যখন সেই সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দেয়। মানুষ আজ ভোগবাদের পেছনে অন্ধের মতো ছুটতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছে তার নিজের অবস্থান। একটা মানুষ যখন তার অবস্থান কোথায় তা ভুলে যায়, তখন তার মধ্যে কিছুতেই মূল্যবোধের চর্চা পরিলক্ষিত হয় না। যারা পুঁজিবাদের অন্ধ চেতনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকে তারা জানে না তারা কোথায় আছে। ভোগবাদের কামনায় বধির হয়ে আছে এই শ্রেণীর মানুষেরা। ব্যবসাপাতির উন্নতির জন্য নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকেও অন্যের বেডরুমে তুলে দিতে এই প্রকৃতির লোকেরা দ্বিধাবোধ করে না। অনেকেই বলে থাকেন, পুঁজির বিকাশ না ঘটলে সমাজের মানুষেরও বিকাশ ঘটবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, পুঁজির বিকাশ হলেই যে সমাজের মানুষের কিংবা সম্পদের বিকাশ হবে তার গ্যারান্টি কোথায় ? যখন কোনো কিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় তখনইতো দুর্ঘটনা ঘটে। মানুষ সামাজিক মূল্যবোধের রীতিনীতি ভুলে গিয়ে তখন যা মন চায় তা-ই করতে থাকে। আমরা যদি পুলিশ কর্মকর্তা পিতার হত্যাকারী মেয়ে এই ভোগবাদী সমাজের বলির পাঁঠা ঐশীর কথা এখানে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরি তাহলে কি আমরা বলতে পারব না, অতিরিক্ত পুঁজির বিকাশ কিংবা স্বেচ্ছাচারী ভোগবাদ আমাদের সমাজে ঐশীর মতো মেয়েদের তাদের পিতার হত্যাকারী হতে বাধ্য করে? আবার এমন কথাও বলা যায়, পচা-গলা পুঁজিবাদ আমাদের সমাজকে এতই দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে যে, যেখানে নৈতিক মূল্যবোধ, সৌজন্যবোধ কিংবা সম্পদের শুভ কাম্যতা শব্দগুলো কিছু কিছু মানুষের কাছে একেবারেই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তাই দেখা যায়, আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষের কাছে নৈতিকতার কোনো মূল্যই নেই। আমরা যদি ঢাকার বনশ্রীর দুই শিশুহত্যা নিয়ে আলোচনা করতে যাই সেখানে দেখা যাবে, এক স্নেহময়ী মাকে পুঁজিবাদের সহোদর ভাই ভোগবাদ এতটাই অন্ধ করেছে যে, যে অন্ধত্বের অহংকারে একজন মা নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধন শিশু সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। চারদিকের শিশুহত্যার চালচিত্র দেখলে মনে হয়, আজ একটা শিশু তার মায়ের কাছে নিরাপদ নয়। বলা হচ্ছে, শিশুরা বড়দের ঝগড়া বিবাদের জন্য বলির পাঁঠা হচ্ছে। একটা সমাজের শিশুরা টার্গেট হয় তখন, যখন মানুষ নিজেদের আধিপত্য কিংবা নিজেদের লাভ-লোকসানের হিসাবটা অন্ধের মতো করে থাকে।
অনেকেই বলেছেন, ঢাকার বনশ্রীর শিশু হত্যাকারী মা খুবই উচ্চাকাক্সক্ষী। আবার অনেকে বলছেন, ওই শিশু হত্যাকারী মা মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। আমাদের দুর্গন্ধযুক্ত সমাজব্যবস্থায় লোভের তাড়নায় মানুষের মানবিক ও মানসিক অবক্ষয় এতটাই নিচে নেমেছে যে, যেখানে ভালমন্দের বিচার করতে মানুষ ভুলে যাচ্ছে। আজ একজন ভাই যেমন একজন ভাইকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না তেমনি করে একজন মা তার সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। পুঁজিবাদ-ভোগবাদ মানুষকে আজকের দিনে রক্ত-মাংসের মানুষ আর রাখছে না। মানুষকে করে ফেলছে রক্ত-মাংসের রোবট। মানুষ যখন তার নৈতিক চেতনা হারিয়ে রোবট হয়ে যাবে, তখনতো আর তার নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না। একটা রোবটকে তার নির্মাণকারী যে ইশারা দেবে, সে তা-ই করবে। তাই চলমান অবস্থায় চরম অবক্ষয়ে নিমজ্জিত মানুষ তার মানবিক হৃদয়ের ইশারায় কিছু করতে পারে না। তাকে অসুস্থ পচা-গলা নৈতিক মূল্যবোধহীন সমাজের লোভ ও প্রলোভনের প্রতিচ্ছবি যে ইশারা করবে, সে তা-ই করবে। শিশু হত্যা কোন পর্যায়ে গেছে তা আমরা শিশু অধিকার ফোরামের এক জরিপ রিপোর্টের দিকে তাকালে বুঝতে পারবো। শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গত চার বছরে শিশু হত্যা হয়েছে এক হাজার পঁচাশি জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু হত্যার স্বীকার হয়েছে ২০১৪ সালে, তিনশ পঞ্চাশ জন এছাড়া ২০১২ সালে দুইশ নয় জন, ২০১৩ সালে দুইশ আঠারো জন, ২০১৫ সালে দুইশ বিরানব্বই জন। মা-বাবার হাতে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে ২০১৫ সালে তেঁতাল্লিশ জন। আর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল পনেরো। শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট বলছে শিশু হত্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে বড়দের জমিজমার বিরোধ, পরকীয়া, অপহরণ ও প্রতিশোধ। বলা হয়ে থাকে, হতাশা ও মাদকাসক্তি থেকেও মানুষ শিশুদের হত্যা করে থাকে। আমাদের সমাজে বিবেকবান ব্যক্তিদের বুঝতে হবে, আমরা একটা চরম অন্ধকারময় গহ্বরে ডুবে আছি। সেই অন্ধকারময় গহ্বর থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু বিকাশমান পুঁজির কথা চিন্তা করে পুঁজিবাদের হাতছানিতে সব নৈতিকতা ভুলে ভোগবাদের পেছনে ছুটলে চলবে না। রাজনীতি থেকে শুরু করে সকল স্তরের কর্তাব্যক্তিরা যদি আজ একবার চিন্তা করেন আমাদের আগামী প্রজন্ম কিসের ইশারায় উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে কিংবা এই যে তারা সব নৈতিকতা ভুলে মরীচিকার পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার জন্য তাদের দায় কতটুকু। তবেই বুঝতে পারবেন শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ দেখতে গিয়ে এবং নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে আজ আমাদের এই সমাজ রসাতলে যাচ্ছে। আমরা ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা কিছুতেই চাইবো না আমাদের সমাজ অবক্ষয়ের গভীরে নিমজ্জিত হোক। যে সমাজ একজন মাকে সন্তান হত্যাকারী বানায়, সেই সমাজ কিছুতেই সুস্থ সামাজিক কাঠামোর উপর দাঁড়ানো বলতে পারি না। আজ যদি দেশের মানুষের চিন্তার মাঝে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না আসে তাহলে কিছুতেই সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী কিংবা শিশু বলাৎকারী ও নারী ধর্ষণকারীদের উচ্ছেদ করা যাবে না। কেননা শরীরে চর্মরোগ রেখে আমরা যতই ভাল পোশাক পরে চলাফেরা করে থাকি না কেন তাতে কিন্তু শরীরের যন্ত্রণা কিছুতেই কমবে না। বরং শরীরের চর্মরোগ দিন দিন শুধু বাড়তেই থাকবে এবং এই চর্মরোগ সংক্রামিত হয়ে সবকিছুকে রোগাক্রান্ত করে ফেলবে। আজ আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে শুধু অসভ্যতা ছাড়া আর কিছু যেন আমাদের সামনে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকের অবস্থা দেখে আমাদের চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। চলমান অবস্থায় যারাই মনে করেন না কেন খুবই ভাল আছেন, তারা কিন্তু খুব ভুল করছেন। হয়তো আমরা রঙ্গীন স্বপ্ন নিয়ে রাতে ঘুমাতে যাই। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন কাচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে যায়, যখন ভোরের সংবাদপত্রে দেখতে পাই একজন মাকে তার নিজের সন্তানকে হত্যার অভিযোগে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কিসের মধ্যে বসে আছি অর্থাৎ কোন শূন্যতায় আগামীকালের স্বপ্নের প্রাসাদ নির্মাণ করছি। আজ আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে একজন মার কাছে সন্তান নিরাপদ নয়। বড় বড় শহরের আলো ঝলমল বিলাসিতা দেখে অনুভব করতে পারছি না আমরা এক বোকার স্বর্গে বসবাস করছি। এই যে আলো ঝলমল বিলাসী জীবন, সেটাতো মিথ্যার আস্ফালন ছাড়া আর কিছু নয়। মূলত আমরা গভীর থেকে গভীরতর তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকারে বাস করছি। শেষে দেশের সুখী মানুষদেরকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই- ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও’।
লেখক : কবি, গল্প ও আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন