শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জনঅভিপ্রায় প্রতিষ্ঠাই সংবিধানের উদ্দেশ্য

আবদুর রহমান মল্লিক | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশের প্রতিটি নাগরিকের কামনা আইনের শাসন। এটি তার সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। এই অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব। জনগণের অধিকারগুলো সুরক্ষিত হলেই কেবল সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জনগণের অধিকার সুরক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতা সুরক্ষার দিকেই অধিক মনোযোগী হতে দেখা যায়। শুধু ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে বার বার ভুলন্ঠিত করার দুঃখজনক নজির রয়েছে। তারা ক্ষমতা গ্রহণ করে দিনের পর দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। ফলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আর স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। সরকারের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও মর্জি অনুয়ায়ী সেগুলো কর্মপন্থা গ্রহণ করে। কোন বিশেষ দলের শাসনামলে নয়, কেবল স্বাধীনতার পর থেকেও নয়, এই উপমহাদেশে বহুকাল ধরে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত হয়েছে সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানে [অনু-৭(২)] স্পষ্টত: উল্লেখ রয়েছে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ মোটকথা জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করাই একটি সরকারের দায়িত্ব। সংবিধান তাদের সেই শপথবাক্যই পাঠ করায়। সংবিধান মেনে চললে কোনো সরকারেরই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলসমূহ সরকার গঠন করে একটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। তাই নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়া গনতন্ত্রের জন্যই খুব জরুরি হয়ে পড়ে।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কীনা তা নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের মর্জির ওপর। তারা যদি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয় তাহলেই সেটি সম্ভব। অতীতে নির্বাচন নিয়ে প্রায় সব সরকারই টালবাহানা করেছে। ক্ষমতার পুনরায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যা যা করা যায় তাই করেছে, আর সংবিধানের দোহাই দিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বাধীনতার দীর্ঘ সময়ের পরও একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি। যে কমিশনই গঠিত হোক তা ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বরাবরই আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগেও অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রাজপথে এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। ব্যাপক হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে।
একথা ঠিক যে শুধুমাত্র একটি নির্বাচনই গণতন্ত্রের সবকিছু নয়। তবে গণতান্ত্রিকভাবে দেশটাকে শাসন করার জন্য জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট বা সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। ক্ষমতায় এসে বিরোধী পক্ষের সাথে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। কারণ সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল জনগণের একটি অংশ। সকলকেই নাগরিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করার সুযোগ দিতে হবে। কাউকে ইচ্ছেমতো গ্রেফতার করে পরে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। আবার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তাকে গ্রেফতার করা হয় না। এটা চলতে পারে না। ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয় বলেই সরকারি দল দ্রæত জনসমর্থণ হারায়। জনসমর্থণ হারিয়ে তখন যেকোনো প্রকারে আবার ক্ষমতাসীন হতে চায়। এই অসুস্থ চর্চা বন্ধ না হলে যতই সংবিধান কাটাছেড়া হোকে তাতে কোনো সুফল আসবে না। সংবিধানতো নিজে দেশ চালাতে পারেনা । তাই রাজনীতিবিদ কিংবা মন্ত্রী-এমপিরা হবেন সংবিধান মান্যকারী এক একজন সুনাগরিক। তারা হবেন সংবিধানের মূর্ত প্রতীক।
স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকেই আমরা লক্ষ করে আসছি, যে সরকারই জনগণের ইচ্ছার বাইরে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে তারাই জনসমর্থন হারিয়েছে। আর সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগর মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থা- (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ^াস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে -তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রেহিতার অপরাধে দোষি হইবেন।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনমতের বাইরে কোনো সংবিধান সংশোধন রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
সংবিধান প্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দুঃখ হয় যারাই ক্ষমতায় আসে, তারাই ক্ষমতাকে অপব্যয় করে, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে। দেশের মালিক জনগণ। আইনের শাসন মানে হলো জনগণের শাসন। জনগণের শাসন হলো প্রকৃত অর্থে কার্যকর গণতন্ত্র। এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। দেশে যেন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, দেশের মালিক জনগণকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। আজ ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। তবে বাস্তব সত্য হলো বিচারপতিরা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছেন, এটা বাতিল হয়ে গেছে। দেশের সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিকে কেউ কেউ টেলিভিশনে যখন ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে বলেন, ব্যাটা তোকে কে নিয়োগ দিয়েছে? তখন কেবল তিনি একা অপমানিত হন না, গোটা দেশ অপমানিত হয়।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, সংবিধানের প্রথমেই বলা হয়েছে আমরা আইনের শাসন করবো। তা হয়নি। আজ বিনা বিচারে মানুষ হত্যা চলছে। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে যে তান্ডব হলো তা কি ঠিক হয়েছে? তিনি আরো বলেন, জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা যদি আইন প্রণীত না হয়, সেটা জনগণ মানতে বাধ্য নয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ আহমদ বলেন, আমি আইনের শাসন বলতে বুঝি যেখানে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকবে, অন্যায়কারীরা ভয়ে থাকবে এবং দুর্বল ব্যক্তিরা নিরাপদে থাকবে- সেটাই আইনের শাসন। দেশে কম গণতন্ত্রের শাসন সহ্য করা যায়। কিন্তু আইনের শাসনের অভাব হলে রাষ্ট্র অকার্যকর হতে বাধ্য।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আইন প্রণেতাদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হতে হবে। যে আইন প্রণেতা বিনাভোটে নির্বাচিত তাদের প্রণীত আইনের নৈতিক ভিত্তি আছে কীনা? এটা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন সঠিক হতে হবে। যে কারণে আমরা সামরিক শাসনের আইনকে আমরা আইন হিসেবে সাধারণত মেনে নেই না। আর আইন কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে, কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে না তা আমরা মেনে নিতে পারি না।
জনগণের অভিপ্রায়কে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সংবিধানের ইচ্ছে মাফিক পরিবর্তন গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয়। সংবিধানকে একটি পবিত্র জায়গায় রাখতে হবে। যে সংবিধান আমাদের পথ দেখাবে তাকে বিতর্কিত করা অনুচিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত শাণিত। ইচ্ছেমাফিক দেশ পরিচালনা করলে কোনা সরকারকেই জনগণ পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করে না, যদি তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ পায়। যেহেতু দেশের জনগণ অত্যন্ত সচেতন তাই আগামী দিনে নির্বাচন কমিশনসহ সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তাদের ভাবমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে সেই প্রত্যাশা অবশ্যই করি।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন