স্টাফ রিপোর্টার : দীর্ঘ নিরবতার পর মিডিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিক কথা বলেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী। দেশের রাজনীতি, জোটবদ্ধ হওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা সমর্থন, বিধর্মীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, হেফাজতের দ্ব›দ্ব, ১৩ দফা বিষয়ে নিষ্ক্রীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নে নানা জনের নানা মত ও বিচ্ছিন্ন কথাবার্তায় মানুষের মনে যে হতাশা ও জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছিল, আল্লামা শফীর এ বক্তব্যে এসব বিভ্রান্তির অবসান হবে।
এর আগে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী নানা সময়ে হেফাজতের অবস্থান তুলে ধরে বিবৃতি ও মিডিয়ার সাথে কথা বলেছেন। যা হেফাজতের দৃঢ় অবস্থান ও ঈমানী আন্দোলনমুখী চরিত্র সঠিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরতে পারে নি। সর্বশেষ গত সোমবার দেশের সর্বাধিক প্রচারিত একটি দৈনিকের চট্টগ্রাম প্রতিনিধির সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার দিয়ে হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফী সার্বিক বিষয় তুলে ধরেছেন। যাতে হেফাজতের বিষয়ে নানা অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির নিরসন হবে বলে বিজ্ঞ মহলের ধারণা। তিনি বলেছেন, ‘তার সংগঠনের রাজনৈতিক অথবা নির্বাচনী কোনো উদ্দেশ্য নেই। তিনি বলেন, দেশে নাস্তিকরা আগের মতো সক্রিয় নয়। তাই হেফাজতেরও কোনো কর্মসূচি নেই। হেফাজত মাঠে নেমে রাজনীতি ঘোলাটে করবে না।
বয়সের ভারে ন্যূব্জ দেশের শীর্ষ এই কওমি আলেম গত সোমবার বিকালে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় সেই প্রতিনিধিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই তথ্য দেন। দীর্ঘদিন পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি কথা বলেছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দেশের রাজনীতি নিয়ে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান এবং চলমান মাদকবিরোধী অভিযানসহ বিভিন্ন বিষয়ে। এ সময় তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা নেই বলে জানান আল্লামা শফী। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক কিংবা নির্বাচন করার উদ্দেশ্য নেই। এ সংগঠন অরাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন। হেফাজতে ইসলাম কোনো সময় রাজনীতি কিংবা জোটের সঙ্গে ছিল না। ভবিষ্যতেও কোনো রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কেউ যদি হেফাজতে ইসলামের জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা একাত্ম হওয়ার কথা বলে তা হবে একেবারে মিথ্যা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও হেফাজতে ইসলামের আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই। হেফাজতে ইসলাম রাজনীতির মাঠে নেমে কিংবা বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায় না।’ সব দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে কি না তা নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন। এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই হেফাজতে ইসলাম কিংবা আল্লামা শফীর। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে তা তাদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা বর্জনের বিষয়টা চিন্তা ভাবনা করবে। নির্বাচনের বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কোনো মন্তব্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যে মজা পায়, তা হেফাজতে ইসলাম পায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আল্লামা আহমদ শফীর সু-সম্পর্কটা অরাজনৈতিক বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে খুব পছন্দ করেন। শ্রদ্ধাও করেন। আমিও প্রধানমন্ত্রীকে খুবই পছন্দ করি। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। কখনো আমরা নির্বাচন কিংবা জোট নিয়ে কথা বলিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাজনৈতিক নয়। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের চিন্তা সব সময় থাকে দ্বীন ও ধর্ম নিয়ে। কেউ দ্বীন ও ধর্মের ওপর আঘাত করলে তার বিরোধিতা করব। যারা ধর্মের ওপর আঘাত করবে না তাদের বিরোধিতা আমরা করি না। কেউ ধর্মের ওপর আঘাত করলে তাদের বিরুদ্ধে মাঠে সোচ্চার থাকবে হেফাজতে ইসলাম। দেশের চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে আল্লামা শফি বলেন, দেশে ইসলামী শাসন নেই বলে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা থাকলে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে শরিয়া আইন অনুযায়ী আমরা বিচার করতাম। বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে কথা বললে এটা নিয়ে অনেক রাজনীতি হবে। বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। ‘হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন গতানুগতিক আন্দোলনের মতো নয়’ জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের এ কাÐারি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতো কর্মসুচি দেয় না এ অরাজনৈতিক সংগঠন। আল্লামা শফী বলেন, নাস্তিকরা আগের মতো বাংলাদেশে সক্রিয় নেই বলে হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মসুচি নেই। যদি নাস্তিক বøগাররা আবার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে তখন হেফাজত আবার মাঠে নামবে। তাদের প্রতিহত করতে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। আমরা যদি ওই সময় ঢাকা অবরোধ করে মাঠে না নামতাম তা হলে বাংলাদেশের সবাই এতদিনে নাস্তিক হয়ে যেত। আমরা মাঠে নেমে তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছি।
দেশের শীর্ষ এ কওমি আলেম দাবি করেন, হেফাজতে ইসলাম যখন ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধে মাঠে নামে তখন ট্রাকে ট্রাকে পোলাও, ফল ফ্রুট এবং নানান খাদ্য এসেছে আন্দোলনকারীদের জন্য। এ খাবার কোথায় থেকে এসেছে কেউ বলতে পারে না। শাপলা চত্বরে আল্লাহ গায়েবি সাহায্য করেছে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের। আল্লাহর ওয়াস্তে ডাক দিয়েছি বলে আল্লাহই ওই সময় পথে পথে ‘মান্না সালওয়া’ (আল্লাহর প্রদত্ত আসমানি খাবার) পাঠিয়েছেন। আবার যদি নাস্তিক বøগারদের বিরুদ্ধে ডাক দেই, ঠিক একইভাবে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। ইসলামের প্রথম যুগের মতো বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে চীন ও ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত সংবলিত চিঠিও তৈরি করার তথ্য জানান আল্লামা শফী। তিনি বলেন, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশার কাছে চিঠি পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এত বছর তা বন্ধ ছিল। আমি মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের চিঠি দিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেব। প্রাথমিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভারত ও চীনের রাষ্ট্র প্রধানদের চিঠি দেব। এরই মধ্যে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য লেখা হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেব। চিঠি দেওয়ার পর অপেক্ষায় থাকব তারা কী জবাব দেয় তার। এরপর অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের একই রকম চিঠি দেব। সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন আল্লামা শফী। বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের ক্ষমতাসীনরা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা যা করছে তা কেয়ামতের লক্ষণ। ক্রাউন প্রিন্সের নাম মুহাম্মদ সালমান হলেও তার আচরণ কাফেরদের মতো। তার ওপর গজব নাজিল হয়েছে। তাই তো তার ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। গুলি খেয়ে তিনি বেঁচে আছে কি না তা কেউ জানে না। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলের বিষয়ে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামে কোনো দ্ব›দ্ব নেই। হেফাজতে ইসলামে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছু নেই। এখনো আমার সিদ্ধান্তে সব কিছু হয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন