ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের দাবি জানাতে হয়। কখনো কখনো আন্দোলন-সংগ্রামে নামতে হয়। শ্রমক্ষেত্রে অসন্তোষের আশংকা দেখা দেয়। মালিক ও আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হয়। এবারও শ্রমিকদের তরফে ঈদের আগেই বেতন-বোনাস দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। দাবি অনাদায়ে বা বিলম্বে শ্রমিক অসোন্তষ দেখা দিতে পারে, এমন আশংকা করা হচ্ছে। এক খবরে জানা গেছে, দেশের প্রায় সাড়ে চারশ কারখানা, যার মধ্যে গার্মেন্ট কারখানার সংখ্যা সর্বোচ্চ, অসন্তোষের আশংকা রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, যা নিতান্তই অধিকার, সেই বেতন-বোনাসের জন্য দাবি জানাতে হবে কেন? কেনই বা আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্তে যেতে হবে? এ নিয়ে শংকাই বা দেখা দেবে কেন? সবারই জানা, উত্তম মালিক-শ্রমিক সম্পর্কই উৎপাদন উৎকর্ষের মাপকাঠি। এ সম্পর্ক পরস্পরনির্ভর। একের অবর্তমানে অন্যের অস্তিত্ব নাস্তি। মালিক বিনিয়োগ করে শ্রমক্ষেত্রে তৈরি করে। পণ্য উৎপাদন ও বিক্রী করে লাভবান হওয়াই তার উদ্দেশ্য, যা শ্রমিক ছাড়া অসম্ভব। আর শ্রমিকরা তাদের কাজের বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক পায়, সেটাই তাদের জীবনযাপন বা জীবন নির্বাহের উপায়।
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট হতে হবে, শ্রমিকরা অন্যায্য ও অযৌক্তিক কিছুই চাইবে না এবং মালিকও তাদের ন্যয়সঙ্গত পাওনা দাবি করার আগেই পূরণ করে দেবে। তাহলে বিরোধ-বিসংবাদ-অসন্তোষ সৃষ্টি হবে না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে। যথারীতি নির্বিঘেœ উৎপাদন হবে এবং উভয়পক্ষই তার ফলভোগী হবে। আমাদের দেশে, বলার অপেক্ষা রাখে না, এ অবস্থা ও পরিবেশ বিরাজমান নয়। তাই দাবি-দাওয়া জানাতে হয় এবং দু’পক্ষের মধ্যে সদ্ভাবের ব্যত্যয় ঘটে।
মানব জাতি ও সভ্যতার আজকের উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে শ্রমিকদের ভ‚মিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। অথচ তারা সবসমই নানাভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। উনিশ শতকের শেষার্ধে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের যে হাল ছিল, এতদিনে তার অনেক উন্নতি হলেও এখনো ন্যয্যতা ও ন্যায়ের বিচারে শোষন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারা। আমাদের দেশে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার ও পাওনা দিতে মালিকদের সামর্থ ও মানসিকতারও ঘাটতি রয়েছে। ইচ্ছা করলে উপায় হয়। মালিকদের অনেকের সেই ইচ্ছা বা মানসিকতা নেই।
ঈদ উপলক্ষে একটু আগে বেতন-বোনাস হয়ে গেলে বাড়তি ও জরুরি খরচ মেটাতে সহায়তা হয়। বিষয়টি না বোঝার কিছু নেই। মালিকরা একটু সচেতন, অধিকতর দায়িত্বশীল এবং সহৃদয় হলেই এটা সম্ভবপর হতে পারে। এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় তাদের বেতন কম। এদিয়ে সংসার ও জীবনযাপন চলে না। রমজান ও ঈদে অতিরিক্ত খরচের উপলক্ষ তৈরি হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে আগেই বেতন-বোনাস পরিশোধ করা উচিত মালিকদের।
ইসলাম শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও তা আদায়ের ক্ষেত্রে জোর তাগিদ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. মজুরি নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছেন। শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে তিনি বলেছেন: তোমরা শ্রমিকদের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি দিয়ে দিবে। অপর একটি হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সাথে আমার ঝগড়া হবে। ১. ওই ব্যক্তি, যে আমার নামে কোনো চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে। ২. ওই ব্যক্তি, যে কোনো মুক্ত মানুষ বিক্রী করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে। ৩. ওই ব্যক্তি, যে মজুরের দ্বারা পুরোপুরি কাজ করিয়ে নিয়েছে, কিন্তু পারিশ্রমিক দেয় নি।
শুধু মালিকদের নয়, শ্রমিকদেরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলেছেন মহানবী সা.। তার ভাষায়: তোমরা যখন কেউ শ্রমের কাজ করবে তখন তা নিখুঁত ও নির্ভূলভাবে করবে। এটা আল্লাহ ভালোবাসেন। ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বিষয়ে যে ধারণা ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং উভয়পক্ষকে যে আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে বলা হয়েছে, তা অনুসৃত হলে মালিক-শ্রমিক বিরোধসহ শ্রমক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা আশা করি, মালিকরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রমিকদের বেতন-বোনাস প্রদান করে উত্তম নজির স্থাপন করবে।
একথা বলা আবশ্যক, ইসলামে অধীনস্তদের প্রতি, ভৃত্য ও গৃহকর্মীদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সদাচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতি ভাই-বোন ও সন্তানতুল্য আচরণ করতে বলা হয়েছে। ইসলামের এই বিবেচনা ও শিক্ষা অনুসরিত হলে আমাদের দেশই কেবল নয়, গোটা বিশ্বে শ্রমিকদের ন্যয্য অধিকার ও মানবিক ব্যবহার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন