শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

জ্বালানি খাতে সরকারের লোকসান নেই, তবুও মূল্যবৃদ্ধি কেন?

প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ বি সিদ্দিক
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (পেট্রোবাংলার অধিনস্থ গ্যাস কোম্পানীগুলো মুনাফাতেই চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) কোম্পানীগুলো পরিচালনা মুনাফা করে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। বিবিধ আয় করে ১ হাজার ৫ কোটি ২০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আয়করপূর্ব মুনাফা করে ২ হাজার ১৭২ কোটি ৫০ লাখ ২৭ হাজার টাকা। করঅন্তে নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৯০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ২ হাজার ৯১৪ কোটি ৬০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা (সূত্রঃ পেট্রোবাংলা)। এ গেলো গ্যাসে মুনাফার চিত্র। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলে দাম কমায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিট মুনাফা করে ৫ হাজার ২৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা আর একই সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ৫ হাজার ৪৪৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বিপিসির নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৬-৭৭ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিপিসির নিট লোকসান ৪৫ হাজার ৯৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা দেখানো হয়। পাশাপাশি সরকারের কোষাগারে যায় ৬৯ হাজার ৬০২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। মূলত জ্বালানিতে সরকারের কোন ভর্তুকি নেই। বিদ্যুতেও সরকারের ভর্তুুকি নেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মুনাফার একটি চিত্র হলো এমন।
বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন উৎপাদন খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকারও কম আর পেট্রলের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৪০ টাকার মতো। অথচ দেশে এক লিটার অকটেনের বর্তমান দাম ৯৯ টাকা এবং পেট্রলের দাম ৯০ টাকা। তার মানে, এই দুটো পণ্যে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। তেল ডিজেলের লিটারপ্রতি আমদানি খরচ পড়ছে ৪০ টাকার কম। অথচ এক লিটার ডিজেল বিক্রি করা হচ্ছে ৬৮ টাকায়। এ ক্ষেত্রে মুনাফার হার ৭০ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলের ক্রয়মূল্য পড়ছে ২৫ টাকা। বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত রয়েছে ৬২ টাকা। অতএব, এ ক্ষেত্রে মুনাফা করা হচ্ছে ১৪৮ শতাংশ। যদিও বর্তমানে কিছুটা দাম কমলো। ১১টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানীকে এখন সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব, তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এখন ছয় টাকার নিচে নেমে এসেছে। অথচ পিডিবি বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য পাচ্ছে ছয় টাকার বেশি। তাহলে তাদের লোকসান হচ্ছে কীভাবে? আর সরকারি ভর্তুকি লাগছে কোথায়? এমতাবস্থায় দাম বাড়ানোর আবদারের কী যুক্তি? সামিট পাওয়ারের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। (যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এ সুবিধা পায়নি, তারা সরকারি দাম ৬২ টাকায় এক লিটার ফার্নেস অয়েল কিনছে অথবা ৬৮ টাকায় ডিজেল কিনছে এবং তাদের খরচ পড়ছে ইউনিটপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। ওই দামে সরকার বিদ্যুৎ কিনছে তাদের কাছ থেকে, ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ৯ থেকে ১৪ টাকা। পিডিবিকে লোকসানের অজুহাতে ভর্তুকি প্রদানের এই তেলেসমাতি কার স্বার্থে?) ফার্নেস অয়েলের দাম কমলে জনগণের কোন লাভ নেই। এই তেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এতে বরং বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমবে।
গত ২০১৫ সালে গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ২০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে করে গ্যাসের মাসিক বিল এক চুলার জন্য ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫০ টাকা করা হয়। গৃহস্থালির কাজে যারা মিটারে গ্যাস ব্যবহার করেন তাদের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৫ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা করা হয়েছে। সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য ৮ টাকা ৩৬ পয়সা, শিল্পের জন্য ৬ টাকা ৭৪ পয়সা, চা বাগানে ৬ টাকা ৪৫ পয়সা, বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ১১ টাকা ৩৬ পয়সা করা হয়েছে। এদিকে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ১ থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের জন্য বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত আছে। গ্রাহক পর্যায়ে ১-৭৫ ইউনিটের জন্য নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ টাকা ৮০ পয়সা। ৭৬-২০০ ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ১৪ পয়সা যা আগে ছিল ৫ টাকা ১ পয়সা। ২০১-৩০০ ইউনিটে ৫ টাকা ৩৬ পয়সা, আগে ছিল ৫ টাকা ১৯ পয়সা। ৩০১-৪০০ ইউনিটের মূল্য আগে ছিল ৫ টাকা ৪২ পয়সা যা বাড়িয়ে করা হয় ৫ টাকা ৬৩ পয়সা। ৪০১-৬০০ ইউনিটের জন্য ৮ টাকা ৫১ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৭০ পয়সা হয়েছে। ৬০০ ইউনিটের উপরে ৯ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৯৮ পয়সা করা হয়েছে। সেচ পাম্পের জন্য শহরে দাম ছিল ইউনিট প্রতি ২ টাকা ৫১ পয়সা তা বেড়ে হয়েছে ৩ টাকা ৮২ পয়সা। আর পল্লীবিদ্যুতে বিতরণ কোম্পানীভেদে ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ও ৩ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৮২ পয়সা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পে বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৬ পয়সা; অনাবাসিক বাতি ও বিদ্যুতে (দাতব্য, মসজিদ, মন্দির, ক্লাব ইত্যাদি) ৪ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৫ টাকা ২২ পয়সা; রাস্তার বাতির জন্য ৬ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৯ টাকা ৫৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। বৃহৎ শিল্পে ১১ কেভি ৭ টাকা ৩২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৫৭ পয়সা; ৩২ কেভির জন্য ৬ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৩৫ পয়সা; ২৩০ কেভির জন্য ৭ টাকা ২৫ পয়সা; ৩৩ কেভির জন্য ৭ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা করা হয়েছে। বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানীর জন্য বিভিন্ন মূল্য হার ছিল। দাম বাড়াতে দিয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান এ আর খান বলেছিলেন, আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। ২০১৮ সালের মধ্যে আমাদের উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যেতে হবে। সবাই জানেন, জ্বালানি বা বিদ্যুতের দাম বাড়লে সরকারি গোটা উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থাৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আর উৎপদন খরচ বাড়লে গোটা অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অপরদিকে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, আয়-ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়লে যা হয়। বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম বাড়লে উচ্চবিত্তদের গায়ে ধাক্কা লাগে না, ধাক্কাটা লাগে এদেশের সিংহভাগ নিম্ন আয়ের মানুষের।
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন