২৬ জুন গাজীপুর সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এ নির্বাচনকে মানুষ খুলনামার্কা দেখতে চায় না। গত ১৫ মে খুলনা সিটি নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের জন্য এসিড টেস্ট। মানুষ আশা করেছিল সরকার নির্বাচনটি নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করে দেশ-বিদেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনবে। দু’তিনটি বাদে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সকল ক্ষেত্রে নির্বাচনের নামে তামাশা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির তামাশা ও কৌতুকপূর্ণ নির্বাচনের পর সরকার তার অনুগত নির্বাচন কমিশন দিয়ে একের পর এক স্থানীয় সরকার নির্বাচনী তামাশা অনুষ্ঠান করে। উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও ইউপি নির্বাচনী তামাশা অনুষ্ঠান দেখে সকলে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও কর্মকাÐের উপর বিতশ্রদ্ধ ও হতাশ হয়ে পড়ে। নির্বাচনগুলি ছিল খুবই একপেশে, ত্রæটিপূর্ণ, জালিয়াতি ও জবরদখলের। নির্বাচন এলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধড়পাকড়, গ্রেফতার, দৌড়-ঝাপ বেড়ে যায়। পাইকারীহারে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মামলা-হামলা, গ্রেফতার ভীতি, গুম-খুনের ভয়, ক্রসফায়ারের ভীতি, গ্রেফতার করে অত্যাচার নির্যাতন প্রভৃতি অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাÐ জ্যামিতিকহারে বেড়ে যায়। নেতাকর্মীদের এমনভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শনও অত্যাচার নির্যাতন করা হয় যে, তারা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাÐ চালাতে পারে না। এই সুযোগে ফাঁকা মাঠে খেলে সরকারি দল নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করে নেয়। এসব নির্বাচনে অনেক জায়গায় প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী পাওয়া যায়নি। অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীর বাড়িতে প্রশাসনের লোকজন গিয়ে মামলা হামলার ভয় দেখিয়ে প্রার্থী না হতে বাধ্য করেছে। যেখানে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানকার নেতাকর্মীদের দিয়ে জেলখানা ভরে দেয়া হয়েছে। এসব কলংকিত নির্বাচনে বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে বহু জায়গায় চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছে। বিরোধীদলের প্রার্থী না থাকলেও অনেক জায়গায় সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফলে শতাধিক লোকের করুণ মৃত্যু হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি দেখে দেশের মানুষের সাথে বিদেশিরাও প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী তামাশা দেখে কূটনীতিকরা সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করে। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর প্রভৃতি সিটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু করে মানুষের আস্থা ফিরানোর চেষ্টা করে। মানুষ আশা করেছিল সামনে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে খুলনা সিটি নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো যাতে নেতাকর্মীরা ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় পড়ে দৌড়-ঝাপ শুরু করল। নেতাকর্মী নির্বাচনী মাঠে থাকা তো দূরের কথা লুকিয়ে থেকেও রেহাই পায়নি। ভোটের আগে ২০০/৩০০ নেতাকর্মীর গ্রেফতারে বাকীরা ভীত, সন্ত্রস্ত্র হয়ে লুকিয়ে থেকে কোনরকমে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করে। হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে মানুষ খুশি হতে পারেনি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা নাই, সেসব নেতাকর্মীর পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না, এরূপ নির্দেশনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের কোন লাভ হয়নি। কারণ মামলা নাই এরকম নেতাকর্মী বিএনপিতে নাই। কারও বিরুদ্ধে মামলা দেয়া না থাকলে দিতে কতক্ষণ, বেনামী আসামির তালিকা থেকে যে কাউকে গ্রেফতার করতে কোন অসুবিধা নাই। গ্রেফতার করে মামলা দেখানো এদেশে এ সময়ে বহু নজির আছে। বিএনপির বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে পর্যন্ত ডজন ডজন মামলা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিবের মতো সজ্জন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ৮৭টি মামলা রয়েছে। অতএব যে কোন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের পর মামলা দেখানো পুলিশের জন্য ডাল ভাত।
আমাদের কথা হলো, দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবার দাবি অযৌক্তিক। প্রথম আলো সরকার সমর্থক পত্রিকা বলে সকলে জানে। তাদের পর্যবেক্ষণে ৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৬টিতে বিএনপি প্রার্থীর কোন এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ভোট কারচুপি ও ভোট ডাকাতিতে আওয়ামী লীগ সিদ্ধ হস্ত। ১৯৭৩ সালের প্রায় সকল আসনে জয়ী হয়েও অন্তত: পাঁচটি আসনের ব্যালট পেপার ঢাকায় নিয়ে ফলাফল পাল্টে দেয়া হয়। বিষয়টি সাড়া দেশের মানুষ অবগত। ৬০টি কেন্দ্রে এজন্ট না থাকায় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা বসে আঙ্গুল চুষবে না। তারা ইচ্ছামত ব্যালট পেপারে সিল মারবে এতে কোন সন্দেহ নাই। প্রথম আলো বলছে ‘সকাল ১১টা পর্যন্ত মোটামুটি ভালো ভোট হয়। ভোটারের উপস্থিতিও ছিল ভালো। কোথাও ধানের শীষের ব্যাজধারী কাউকে দেখা যায়নি। দুপুর ১২টার পর থেকে কারচুপি ও জাল ভোটের প্রবণতা বাড়তে থাকে। কেবল গণমাধ্যমকর্মী কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল আসতে দেখলে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশকে সক্রিয় হতে দেখা যায়। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা যেসব কেন্দ্রে গেছেন, প্রায় সবকটির প্রবেশপথে সরকারি দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের শক্ত অবস্থান দেখা গেছে। রাস্তার মোড় থেকে ছিল তাদের পাহারা, গণমাধ্যম কর্মীদের উপরও ছিল তাদের সতর্ক দৃষ্টি।’ প্রিয় পাঠক, ভাবুন এরকম একপেশে প্রতিরোধের মধ্যে কীভাবে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারে। চিহ্নিত বিএনপি ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এজেন্টদের বের করে দিয়ে জোর করে সিল মারার মহোৎসব চলেছে। নির্বাচনী কর্মকর্তার সিল সই ছাড়া হাজার হাজার ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরাট করা হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে দেখা গেছে ব্যালট পেপার শেষ। ব্যালট পেপার আনা হচ্ছে বললেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ব্যালট পেপার পাওয়া যায়নি। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারেনি। সরকারি দলের পাহাড়া ও প্রতিরোধে মানুষ নির্ভয়েও নিঃশংকচিত্তে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে নিজের ভোট নিজে দিতে না পারায় হতাশ, ক্ষুব্ধ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুয়ায়ী ৬০টি কেন্দ্রে ধানের শীষের কোন এজেন্ট দিলেও কর্মীর অভাব হবে না। তারা আগে থেকে যে অভিযোগ করে আসছিল নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধরপাকড় করে মাঠ ছাড়া করা হয়েছিল। তাদেরকে হুমকী ধমকী দিয়ে এমন অবস্থায় ফেলা হয়েছিল যে, শ্যাম রাখি, না কুল রাখি। বেশি বাড়াবাড়ি বা প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে নির্ঘাত গ্রেফতার বরণ করতে হবে। এমন গ্রেফতার, অত্যাচার নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নেতাকর্মীরা অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বাধ্য হয়েছেন। তাছাড়া যারা একটু প্রতিবাদ করেছেন তাদেরকে জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে। পুলিশের চোখের সামনে বিএনপির এজেন্টকে পিটুনি দেয়া হয়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ সরকারি দলের কর্মকাÐ প্রত্যক্ষ করেছে। খুলনায় কোন নির্বাচন হয়নি, নজরুল ইসলাম সাহেবের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার কিছু নাই। প্রথম আলো বলেছে ভোটার আছেন, অথচ ব্যালট নাই, অনেক কাগজ সরকারি দলের তাÐবের কথা প্রকাশ করেছে। বিএনপি অনেক আগে থেকেই এসব জাল জুয়াচুরির আশংকা করা হচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেসব কথায় কর্ণপাত করেনি। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, নির্বাচনী কর্মকর্তা সকলে সরকারি দলের প্রার্থীর বিজয়ে সহায়তা করেছেন বললে বোধ হয় বেশি বলা হবে না। বাবার সাথে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুও ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে কমিশনের পর্যবেক্ষণ দলের একজন সদস্যকে অপদস্থ করার খবরও পত্রিকার এসেছে। কেন্দ্রের বাইরে জটলা পাকানো আওয়ামী লীগ মুখোশধারী বাহিনী ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে, বাছাই করে কেন্দ্রে ভোটার ঢোকানো হয়েছে, ব্যালট পেপার ছিনতাই, নৌকায় সিলমারা, প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেয়া প্রভৃতি কর্মকাÐ মিডিয়ায় এসেছে। রিজভী আহমদ দাবি করেছেন ১৫০টি কেন্দ্র দখল করে সিল মেরেছে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা। খুলনায় প্রহসনের ভোট হয়েছে বলে সিপিবি প্রার্থী দাবী করেছেন। ভোট যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি একথা সকলে বিশ্বাস করে। এত অনিয়ম, জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতি কি প্রতিরোধ করা যেত না?
আমরা মনে করি খুলনার ভোটটিকে অবাধ, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করার অনেক উপায় ছিল। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচন নিয়ে কোনরকম প্রশ্ন তোলা যেত না, অথবা প্রশ্ন তুললেও সেটি গ্রহণযোগ্যতা পেত না। নির্বাচনের অনেক আগে থেকে বিএনপি নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি দাবি জানানো হচ্ছিল। নির্বাচনের একমাস আগে থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ রেখে তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দিলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। সমতল মাঠ পেলে নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনী কর্মকাÐে নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় অংশ নিতে পারত। তাদেরকে গ্রেফতার করেছে নির্বাচনের দিন যারা বেশি সাহস দেখিয়েছে, তারা মান অপমান হজম করে, পিটুনি খেয়ে, গলাধাক্কা খেয়ে কেন্দ্র থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছে। গুলির আদেশ আগে থেকেই দেয়া ছিল। এত ব্যাপক অনিয়মের মধ্যেও কিন্তু একটি গুলিও ফোটেনি। বিএনপি নেতাকর্মীরা সাহস দেখাতে গিয়ে গুলির শিকার হতে চায়নি। ফলে ফাঁকা মাঠ পেয়ে সরকারি দলের পেটুয়া বাহিনী নির্বিচারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেছে। বিএনপি বহু আগে থেকে কারচুপি আঁচ অনুমান করে ধরপাকড় বন্ধ রাখা ও সেনা নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিল। নির্বাচন কমিশন অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে সেনা নিয়োগ দিতে চায়নি। সেনা নিয়োগ দিলে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাÐ ঘটতে পারত না। সন্ত্রাসীরা ভয়ে কেন্দ্র থেকে বহুদূরে অবস্থান করতে বাধ্য হতো ও নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা পেত। টকশোতে অনেকে নির্বাচনী কারচুপি ও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নারাজ। তাদের কথা হলো অনিয়ম না হলেও খালেক সাহেব বিজয়ী হতেন, তবে ভোটের ব্যবধান কমত। আমাদের কথা হলো এসব ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির মধ্যে খালেক সাহেব ১,৭৬,৯০২ ভোট ও নজরুল ইসলাম ১,০৮,১৫৬ ভোট পেয়েছেন। ৬৭৯৪৬ ভোটের ব্যবধানে খালেক সাহেব বিজয়ী হয়েছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন ধরে অগ্রসর হলে দেখা যায় ৬০টি কেন্দ্রে ধানের শীষের কোন এজেন্ট ছিল না ১,০৮,৯৫৬ ভোট পাওয়া বিএনপি প্রার্থী এজেন্ট খুঁজে পাননি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভয়ে এজেন্ট ঢুকতে সাহস পায়নি, অনেককে বের করে দেয়া হয়েছে, অনেকে এসেও সন্ত্রাসীদের বাধায় কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেনি। ৬০টি কেন্দ্রে নিশ্চয় সন্ত্রাসীরা চুপ করে বসে থাকেনি। তারা বীরদর্পে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভরাট করেছে যার প্রমাণ ভোটাররা এসে ব্যালট পেপার শেষ হওয়ায় ফিরে গেছে। ৬০টি কেন্দ্রে ১৫০০ করে সিল মারলে ৬০০০০ ভোট নৌকায় বেশি পড়েছে। প্রথম আলোর সাংবাদিকরা ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৮০টি কেন্দ্রে গেছেন। বাকী কেন্দ্রগুলির সবগুলিতে নিশ্চয় এজেন্ট থাকতে পারেননি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমদ দাবি করেছেন ১৫০টি কেন্দ্র দখল করে সিল মেরেছে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা। খুলনায় প্রহসনের ভোট হয়েছে বলে সিপিবি প্রার্থী। পুলিশের সহায়তায় বা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট ডাকাতি করেছে। এভাবে জোর করে নজরুল ইসলামকে পরাজিত করে সরকারি দল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের দাবি করছে যা বাস্তবের সাথে মিলে না। বাস্তব পরিস্থিতি ও পরিবেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকলে এরকম জোর করে নজরুল ইসলাম সাহেবের বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারত না একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। যারা ভোটের ব্যবধান কমার কথা বলছেন, তারা নির্বাচনী পরিবেশ ও সন্ত্রাসীদের কর্মকাÐ বিবেচনা করে দেখছেন কিনা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের কথা হলো, সমতল মাঠ না দিয়ে জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নেবার মধ্যে বাহাদুরী নাই। সত্যিকার বিজয়ের আনন্দ অনেক। বিএনপি মহাসচিবের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, একথা আর একবার প্রমাণিত হলো।’
অনেকে খুলনার নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত একদলীয় নির্বাচন বলছেন। আবার অনেকে বলছেন সরকার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন একজোট হয়ে খালেক সাহেবের বিজয়কে সম্ভব করেছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের চোখের সামনে ব্যালট পেপারে সিলমারা চলেছে অবরিতভাবে পুলিং অফিসারদের সিল-সই ছাড়া ব্যালট পেপার প্রমাণ করে যে, কতটা জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। এত ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শিয়া বার্নিকাট সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। আমরা মনে করি জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার কলংক ঘুচাতেই হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাতিসংঘ, ইইউ প্রভৃতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সংস্থা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ অব্যাহত ও ভালো নির্বাচন দেখতে চায়। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সংলাপের বিষয়ে বহুদিন ধরে তাগিদ দিলেও সরকার কর্ণপাত করছে না। দেশে কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। খুলনার শান্ত পরিবেশ পরিস্থিতির প্রচন্ডরকম অশান্ত ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছিল। বিএনপি নেতাকর্মীরা সরকারি দলের তাÐবের প্রতিরোধ করতে পারেনি। বিএনপি যে প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছে, তার প্রতি একটু সংবেদনশীল হয়ে বিবেচনা করলে সকলে বলতে বাধ্য হবেন যে, খুলনার নির্বাচনটি কারচুপি, জালিয়াতি, চৌর্য্যবৃত্তি ও ডাকাতির মহোৎসব ছিল। নির্বাচনের আগে ব্যাপক ধড়পাকড়, ভয়ভীতি প্রদর্শন, গ্রেফতার বাণিজ্য ও অত্যাচার নির্যাতন যেভাবে করা হয়েছে, তার ফলে নির্বাচনের দিন নেতাকর্মীরা চুপ থেকেছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অসমতল মাঠ, নির্বাচনী পরিবেশ, ভয়ভীতি প্রদর্শনে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রচন্ড চাপে রাখা প্রভৃতি বিবেচনায় নিলে, নির্বাচনটি চরম ক্রটিপূর্ণ ছিল বলতে বাধ্য হবেন।
বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ফেরাতে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক। ভালো নির্বাচনী ব্যবস্থা উদ্ভাবন ছাড়া এদেশে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। জোর করে বিজয়ী হয়ে বিএনপিকে আরও বড় পরাজয়ের ভয় দেখানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কূটকৌশল, চাপাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাÐ মোকাবেলা করে বিএনপির মতো শান্ত-শিষ্ট ও ভদ্রলোকের দল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। বর্তমান অসমতল মাঠে খেলতে গেলে বিএনপি পর্যদস্ত হবে, আওয়ামী লীগ অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকবে। এরূপ অসমতল মাঝে ভয়ভীতি নিয়ে নির্বাচন করতে গেলে কেয়ামত পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে কোন দল হটাতে পারবে না। এ দল অনিয়ম, কারচুপি, ভোট চুরি ও ভোট ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের স্বার্থে ও বাংলাদেশের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কার্যকর উদ্যোগ নিবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
লেখক: প্রফেসর (অব.), দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডীন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন