বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঘুণে ধরা সমাজকে বাঁচাতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

একটা সময় ‘ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা’ বা সমাজে ঘুণে ধরেছে কথাটি বেশ শোনা যেত। নাটক-সিনেমায় এমনকি বামধারার রাজনীতির বক্তব্য-বিবৃতিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার হতো। বহুদিনের পুরনো এ কথাটিই এখন বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। সমাজে ঘুণ পোকা আক্রমণ করে নীতি-নৈতিককতা, মূল্যবোধ, মানবাতাবোধকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে। সমাজের ভেতরটা ফোকলা এবং বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। এ নিয়ে কারোরই যেন তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। যে যার মতো করে চলছে। চোখের সামনে ভয়াবহ অন্যায় ও অপরাধ ঘটতে দেখলেও চুপ করে থাকছে বা দেখেও না দেখার ভান করছে। ‘কী দরকার সেধে ঝামেলায় জড়ানো’, এমন একটা মনোভাব কম-বেশি সবার মনে কাজ করে। এই মনোভাবের সুযোগই নিচ্ছে অপরাধীরা। এমনকি নিজের সন্তানটি যে মাদকাসক্ত হয়ে বিপথে চলে যাচ্ছে, সেদিকেও অনেক অভিভাবকের খেয়াল নেই। কিছুদিন আগে মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে ধানমন্ডি এলাকায় দেখলাম দুই তরুণকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এরা দুজন মাদকাসক্ত। এদের একজন পুলিশের ভ্যান গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, বাসায় জানলে কী জবাব দেব। মান-সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যাবে। ঐ তরুণের বাসার লোকেরা নিশ্চয়ই জেনেছে। কারণ তাকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। তখন বাসার অভিভাবক ও আত্ময়স্বজনরা নিশ্চয়ই উপস্থিত ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই তরুণ যে মাদকাসক্ত হলো এর জন্য সে-ই কি শুধু দায়ী? নাকি এর দায় তার অভিভাবকদেরও রয়েছে? অবশ্যই এর দায় অভিভাবকদের উপরও বর্তায়। এতে কী হলো? সামাজিকভাবে ঐ পরিবারটি কি অসম্মানিত হলো না? এরকম আরও অনেক পরিবার রয়েছে, যারা মাদকাসক্ত সদস্যর কারণে অসম্মানিত হচ্ছে। অথবা অসম্মানিত হওয়ার পথে রয়েছে। যাকে বলে ঘুণপোকার অদৃশ্য আক্রমণের মুখে রয়েছে। ভেতরে ভেতরে খেয়ে ফেললেও দেখা যায় না। একসময় ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের সমাজ মাদকের মতো এমন অনেক ধরনের ঘুনপোকার আক্রমণ চলছে। বলা বাহুল্য, সামাজিক এবং পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দেশে মাদকের অবাধ বিস্তার। এর পাশাপাশি আরও যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে, অসুস্থ রাজনীতি, অর্থের প্রতি প্রবল মোহ, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, বেকারত্ব, ভিনদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দেয়া, সুস্থ্য বিনোদনের অভাব, দাম্পত্যকলহ, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, মোবাইল ফোন, ফেসবুক, বøগ-টুইটারসহ তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ না নেয়া, সর্বোপরি সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের উদাসীনতা। পুলিশের এক হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতিদিন দেশে গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। এসব খুনের অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতা বৃদ্ধি হঠাৎ করে হয় না। সময়ের সাথে সাথে এর বিধি-ব্যবস্থায় সংযোজন-বিয়োজন এবং পরিবর্তন সাধিত হয়। এই বিবর্তন ইতিবাচক ধারায় হচ্ছে, নাকি নেতিবাচক ধারায় হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখাটাই জরুরি।
দুই.
মানুষের জীবনযাপন যে দিন দিন যান্ত্রিক, অনুভূতিহীন, অসহিষ্ণু এবং প্রচÐ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে, তা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সংঘটিত বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। অতি তুচ্ছ ঘটনায়ও ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষে মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। প্রকাশ্যে খুন করতেও দ্বিধা করছে না। পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার মতো ঘটনা আগে কম শোনা যেত। এখন হর-হামেশাই হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষ এখন আপন মানুষের কাছেও নিরাপদ নয়। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে এমনকি সন্তান পিতা-মাতাকে এবং পিতা-মাতা সন্তানকে পর্যন্ত খুন করে ফেলছে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে উঠছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। এ অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে আগামী ১০ বছরে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তখন সমাজে সুস্থিরভাবে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আত্মরক্ষার্থে মানুষ একে অপরের প্রতি আরও আক্রমণাত্মক এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। গত পাঁচ বছরে মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এ প্রবণতার মূল কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা থেকে দিন দিন মানুষের দূরে সরে যাওয়া বা উপেক্ষা করে চলা। অধিকাংশ মানুষের সুকুমারবৃত্তি, লোভ-লালসা ও ক্রোধের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখেও প্রতিবাদের পরিবর্তে না দেখার ভান করছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য, তা হারিয়ে যাচ্ছে। সিনিয়র-জুনিয়রের আচরণের মধ্যে যে ধরনের ব্যবধান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন, তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাদের মধ্যকার আচরণ সমবয়স্ক হয়ে গেছে। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য এখন নেই বললেই চলে। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। পরিবারের সদস্যরা আলাদা হয়ে যার যার মতো বসবাস করছে। পারস্পরিক যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। যৌথ পরিবারে থাকাকালে যে নিয়ম-নীতির মধ্যে তারা থকত, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াও সেসব নিয়ম-নীতিরও ব্যত্যয় ঘটছে। আবার সন্তান-সন্তদি নিয়ে যারা বসবাস করছেন, তাদের অধিকাংশই সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, মোবাইলে, ফেসবুকে কাদের সাথে চ্যাট করছে, এ নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। উপরন্তু সন্তান তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে, এটা দেখে অনেককে পুলকিত হতে, বড়াই করতে দেখা যায়। তারা বুঝতে পারছে না বা খোঁজ নিচ্ছে না, এই তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সন্তান কি করছে। তাদের এই উদাসীনতা অনেক সময় সন্তানকে যে বিপথে নিয়ে যেতে পারে, তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না। পারিবারিক এই উদাসীনতা ও প্রশ্রয় থেকেই সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারের অভিভাবকের কাছে যদি জুনিয়র সদস্যদের জবাবদিহিতা না থাকে, তবে পরিবার ও সমাজ কোনভাবেই স্থির থাকতে পারে না। তারা দুর্নিবার হয়ে উঠে। সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং থেকে শুরু করে খুন-খারাবির ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এমনকি আপন মানুষকেও খুন করতে দ্বিধা করে না। পারিবারিক শাসন-বারন এবং নিয়ম-নীতির বিষয়টি যে পরিবারের অভিভাবকরা জানে না, এমন ভাবার কারণ নেই। তারা নিশ্চয়ই জানে। মূল বিষয়টি হচ্ছে, তারা আমলে নিচ্ছে না। শুধু পরিবারের অভিভাবকই নয়, সমাজে যাদের প্রভাব বিস্তার করার সক্ষমতা রয়েছে, তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের অবহেলাও সমাজকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, সমাজে বর্তমানে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার সঙ্গে পরিবারগুলো তাল মেলাতে পারছে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অসম প্রতিযোগিতা। ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণী তাদের মূল্যবোধ হারাচ্ছে। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রের উদাসীনতা দায়ী। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খোলামেলা অনুষ্ঠান ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের দেশি-বিদেশি সিরিয়াল আমাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল করে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে। মানুষ তার লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারছে না। সব মিলিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতায় মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এতে সামাজিক সম্পর্কে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা সে দায়িত্ব পালন করছেন না।
তিন.
সব ধরনের অপরাধের অন্যতম উৎস মাদক। মাদক চোরাচালান, বাজারজাত করা থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন-খারাবি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক ব্যবসার সাথে এমপি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগও বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর যথাযথ প্রতিকার না হওয়ায় দেশব্যাপী ব্যাপকহারে মাদকের বিস্তার ঘটেছে। অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে। মাদকের সহজলভ্যতা তরুণ শ্রেণীর মেধা-মনন ও বিকাশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা মাদকের ছোবলে ক্রমাগত নীল হচ্ছে। নেশার টাকা জোগাতে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। সরকারি হিসেবে ৫০ লাখ। এদের শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। তরুণী ও মহিলা রয়েছে শতকরা ১০ ভাগ। বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশে মাদকাসক্তের এই সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যদি ৯০ লাখ লোক মাদকাসক্ত থাকে এবং তাদের ৯১ ভাগই যদি হয় কিশোর ও তরুণ, তবে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা কোনভাবেই অটুট থাকতে পারে না। এরা কোন না কোনভাবে পরিবার ও সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘœ ঘটিয়ে চলেছে। মাদকের বিস্তার যেভাবে ঘটছে, তাতে মাদকাসক্তির সংখ্যা আগামী কয়েক বছরে যে কয়েক কোটিতে পরিণত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তখন যদি মেক্সিকোর মতো মাদক চোরাকারবারি ও সিন্ডিকেট দমনে সরকারকে সেনাবাহিনী নামিয়ে যুদ্ধ করতে হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ২০০৬ সালে মেক্সিকোতে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দখল নেয়ার জন্য সে দেশের সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধের নাম দেয়া হয় ‘মেক্সিকান ড্রাগ ওয়ার’। দেশটি এ যুদ্ধে সেনাবাহিনী নামিয়েছিল। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধে ১ লাখ ২০ হাজারের উপর লোক নিহত হয়েছে। ইতোমধ্যে মাদক চোরাকারবারিরা টেকনাফ, কক্সবাজার চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মিয়ানমার সীমান্ত বেছে নিয়েছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই ট্রানজিট রুট দিয়ে শত শত কোটি টাকার মাদক দেশে প্রবেশ করছে। গত মঙ্গলবার ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনা দেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই অশনিসংকেত। এখনই যদি মাদক চোরাকারবারিদের নির্মূল করা না যায়, তবে পরিস্থিতি কি হবে, তা বলা বাহুল্য। মাদক যেমন পরিবার ও সমাজকে অস্থির করে তুলেছে, তেমনি অর্থনৈতিক বৈষম্যও এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, একজন সৎভাবে উপার্জন করে কোন রকমে জীবনযাপন করছে, অথচ তার চোখের সামনেই আরেকজন দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রæত কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। এতে সৎভাবে জীবনযাপনকারীর মনে যেমন ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি হতাশাও ভর করছে। পরিবারের কাছে তাকে হেয়ও হতে হচ্ছে। এতে পরিবারে যেমন অশান্তি নেমে আসে, তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে উপার্জনকারী ব্যক্তি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। দ্রæত অর্থ রোজগারের এ প্রতিযোগিতায় শামিল হতে গিয়েই অনেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকাÐ ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া অনেক ছাত্র-ছাত্রীও ছাত্রাবস্থায়ই বড় লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে। একশ্রেণীর ছাত্র ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীর ব্যানারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, ব্যবসায়ী এমনকি ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে গাড়ি-বাড়ির মালিকও হয়ে গেছে। এদের নিয়ন্ত্রণে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিরা তাদের কিছু বলতে না পারলেও ক্ষুদ্ধ মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে পরিবারে। এতে পরিবারে নেমে আসছে অশান্তি। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটছে। সমাজবিদরা পরিবারের অশান্তির কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক টানাপড়েনকে দায়ী করেছেন। তারা বলেছেন, যে মানুষরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন, তারাই পরিবারের সদস্যদের হত্যার মতো অপরাধ করছে। পরকীয়ার ঘটনাগুলোর পেছনেও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকেও কেউ কেউ পারিবারিক অশান্তি, পরকীয়া এবং বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার কারণে এর ব্যবহারকারীরা নিজস্ব একটি ভুবন তৈরি করে নেয়। সে সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক স্বাধীনতা চায়। এ স্বাধীনতা চাওয়া এবং যার কাছে চাইছে, তার মধ্যে চিন্তার ফারাক থাকার কারণেই সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সমাজ কাঠামো থেকে আমাদের সমাজ কাঠামোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বৈষম্য আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে প্রযুক্তি ও আধুনিকতাকে সমাজ ব্যবস্থার উপযোগী করে ব্যবহার করতে না পারার কারণে অস্থিরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একটি শ্রেণী স্যাটেলাইট চ্যানেলের কারণে ভিনদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণকে আধুনিকতা মনে করে সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করছে। এর ফলে যারা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী তাদের সাথে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে। আধুনিকতার অপব্যবহার এবং ভিনদেশী সংস্কৃতিকে ধারণ করার প্রবণতাই পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলাকে দিন দিন শিথিল করে দিচ্ছে। সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সমাজ যত আধুনিক হবে, মানুষের মধ্যে দ্ব›দ্ব তত বেড়ে যাবে। আমাদের ট্র্যাডিশনাল সমাজ আধুনিকায়নের দিকে যাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের সব ধরনের উপকরণ প্রভাব বিস্তার করছে। এ কারণে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। মূল কথা হচ্ছে, পরিবর্তনে কোন সমস্যা নেই, তবে এই পরিবর্তন হতে হবে নিজস্ব সমাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে ধারণ করে সুষমভাবে। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে বলেই সমাজে অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলেছে।
চার.
মাদকাসক্তি, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবসহ নানা কারণে সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অবক্ষয় এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তির উপর এবং এ থেকে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযানে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মাধ্যমে কিছু মাদক ব্যবসায়ীকে নিহত করে হয়তো আতঙ্ক সৃষ্টি করে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তবে আখেরে এর কোনো সুদূর প্রসারী ফল বয়ে আনবে না। সীমান্তে মাদকের মূল রুট বন্ধ এবং এর গডফাদারদের যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্মূল করা না যাবে, ততক্ষণ মাদকের এই আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্তি এবং নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সবসময় জাগ্রত ও কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবী। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের যারা নীতিনির্ধারক তাদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিজস্ব অবস্থান থেকে সামাজিক অপরাধ ও নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে প্রশাসনিক ও সামাজিক দুর্নীতিসহ সব ধরনের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অন্যদের সতর্ক করতে হবে। শুধু শাস্তি দিলেই হবে না, যে কারণে অপরাধ ও অনৈতিক কাজ সংঘটিত হয়েছে, সে কারণ শনাক্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবারের তরুণ সদস্যরা কখন কি করছে, তাদের জীবনচক্র কিভাবে আবর্তিত হচ্ছে, কারা জড়িয়ে পড়ছে, সেদিকে অভিভাবকদের নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি এবং মূল্যবোধ চর্চার উপর জোর দিতে হবে। পুলিশ, আদালতসহ ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক, তা ঢেলে সাজিয়ে অপরাধীর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিষয়ক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রতিদিন প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধ বাড়াতে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, সমাজের অভিভাবকশ্রেণী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সচেতনতামূলক বক্তব্য প্রচার করা এবং কর্মসূচি নিতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ২৩ জুন, ২০১৮, ১১:৫৪ এএম says : 0
MashaAllah.. what you mentioned is 100% correct. .........................
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন