শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

বিবেক বিক্রেতাদের নিকট জাতি অসহায়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

যখন পৃথিবীতে সভ্যতা বিকশিত হয়নি, নিশ্চিত হয়নি মানুষের জন্মগত অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার তখন শাসকের বিরাগভাজন হওয়ার অর্থই ছিল নির্জন কারাবাস বা দ্বীপান্তর বা ফাঁসি বা শিরোচ্ছেদ। আইন যাই হোক না কেন শাসক বা শাসন যন্ত্রের চক্ষুশুল হলেই তা প্রয়োগ হতো উল্টো পথে এবং আশ্চর্যের বিষয় এখনো তাই হচ্ছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সে যুগ ছিল বর্বরতার যুগ অর্থাৎ রাজা যা মনে করতেন তাই আদেশ এবং আইন। এমনো দেখা গেছে যে কোন সাধারণ মানুষ বা উজির-নাজির যেই হোক, যে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড পেতো, কিন্তু রাজপরিবারের সদস্যের একই অপরাধের জন্য কোন জবাবদিহিতাই ছিল না। এ ভাবেই একটি জনগোষ্টি ইতিহাসের পাতায় BLUE BLOOD নামে পরিচিতি লাভ করে। এখন রাজপরিবার তারাই যারা ক্ষমতাসীন ও তাদের আর্শীবাদপুষ্ঠ। বহু আন্দোলন সংগ্রামের পর গণমানুষ দাসপ্রথা থেকে আনুষ্ঠানিক মুক্তি লাভ করলেও দাসত্বের মুক্তি হয়নি। দাসপ্রথাটি বাতিলে নানা বিদ্রোহ ও রক্ষক্ষয়ী ইতিহাস রয়েছে। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ১৮৪৩ সালে অপঃ ঋরাব আইনে দাস-দাসী আমদানি-রফতানি নিষিদ্ধ হলেও মনস্তাত্তি¡কভাবে দাসপ্রথাটি বিলুপ্ত হয়নি, বরং রং পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ যখন মানুষকে ক্রয় করে তখন ক্রেতা হয় মালিক, যে মানুষটি বিক্রয় হয় সে হয় কৃতদাস। Salvery ev Thalldom মধ্যযুগীয় বর্বরতার সময় দাসপ্রথা হিসেবে অনুমোদিত আইনানুগ সমাজিক প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সভ্যসমাজেও মানুষ ক্রয়-বিক্রয় হয়, কোথাও সে দেহ বিক্রি করে, কোথাও বুদ্ধি বিক্রি করে, কোথাও শ্রম বিক্রি করে এবং কোথাও বিবেক বিক্রি করে। যে নারী তার দেহ বিক্রি করে, সে অর্থের বিনিময়ে তার দেহকে অন্য পুরুষের নিকট উজাড় করে দেয়। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা তার একারই হয়। আর যে বিবেক বিক্রি করে তার দেহে কোনো চিহ্ন থাকে না, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হয় মানুষ, দেশ ও জাতি। এখন চলছে প্রমোশন, সুবিধামত পোস্টিং বা সুখশান্তি ও অর্থের বিনিময়ে বিবেক বিক্রি করার যুগ। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের বিবেক বিক্রি হওয়ার প্রবণতায় ভিকটিম হচ্ছে দেশের নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ।
দেহ বিক্রি পৃথিবীর আদি ব্যবসা বা অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা। দেহ বিক্রি একটি ঘৃণিত পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেহ বিক্রিতাদের মধ্যে গড়ে উঠা সমাজ ‘পতিতা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Prostitute, যার সংজ্ঞায় বিচারপতি P.K. Unni Kumar মন্তব্য করেন যে, "Prostitute" Means a female who offers her body for PROMISCUOUS Sexual intercouese on hire(ভাড়া) whether in money or kind [সূত্র: ১৮ MAD LJ (১৯৭৪) (৬২৯)].Promiscuous এর বাংলা শব্দার্থ বাছ-বিচারবিহীন, ভেদবিচারবিহীন নির্বিচার, নৈমিত্তিক। বিষয়টি এই দাঁড়ায় যে, দেহ যখন বিক্রয় হয় তখন নির্ধারিত সময়ের জন্য ক্রেতাই মালিক ইচ্ছামত তা ব্যবহারের জন্য। এ জন্য ক্রেতাকে ঘৃণার পাত্র হতে হয় না, বরং বিক্রেতাই সমাজে ঘৃণিত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। ১৯৮৬ সালে শিকাগো শহরে ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের পর শ্রম বিক্রয়ের বিষয়টি এখন আলাদা মর্যাদা লাভ করে। যারা শ্রম বিক্রয় করে তাদের ক্রেতারা কৃতদাসের মতই ব্যবহার করতো। কিন্তু শিকাগো শহরের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভসহ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ এখন শ্রমজীবীরা সম্মানের পাত্র, কৃতদাস নয়। পতিতারা রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক স্বীকৃতি লাভের জন্য সময়ে সময়ে আন্দোলন, সংগ্রাম বা দাবি উপস্থাপন করলেও তা সফল হয়নি। কারণ ধর্মীয় বিধান মতেও পতিতাবৃত্তি একটি ঘৃণিত পেশা। তবে বস্তিতে বসবাসকারী দেহ বিক্রেতাদের পতিতা বললেও রাজ প্রাসাদ, অট্টালিকা ও বিলাসবহুল হোটেলে দেহ ব্যবসা করলে তাদের পতিতা বলে সম্মোধন করা হয় না বরং এখন তারা সমাজের উঁচু শ্রেণির সদস্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত।
যারা বিবেক বিক্রি করে তাদের সম্পর্কে সভ্যসমাজ কী ধারণা পোষণ করতে পারে? বুদ্ধি বিক্রি আর বিবেক বিক্রি করা এক জিনিস নয়। যে ব্যক্তি সাদাকে সাদা এবং কালো কে কালো বলতে না পারে সে ব্যক্তিই বিবেক বিক্রেতা। এ বিবেক বিক্রেতাদের নিকট জাতি আজ অসহায়। বিবেক বিক্রেতারা প্রলোভনের কারণে বিবেককে বির্সজন দিয়ে মিথ্যাকে গ্রহণ করে। মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করাই বিবেকহীনদের প্রধান কাজ। অথচ ভিন্ন পন্থায় অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে নিজেকে অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া অথবা ঘুষ খাওয়ার আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সুবিধামত পোস্টিং ও প্রমোশনের লোভে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এখন মিথ্যাকে সত্যে এবং সত্যকে মিথ্যায় রূপান্তরিত করছে যা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ থেকে এদেশের আমলারা প্রাপ্ত হয়েছে। জেনে শুনে মিথ্যাকে বড় বড় আমলারা সত্যে রূপান্তর করে নিজেরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে, এ জন্য যে তাতে তাদের উপরওয়ালারা খুশি থাকবে। কিন্তু নিগৃহীত হচ্ছে জনগণ। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণের পরও স্বার্থের জন্য অহরহ বিবেক বিক্রি করে যাচ্ছে, এ অবস্থা এখন দৃশ্যমান।
পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ছাত্রলীগ নেতা পুলিশকে পিটিয়েছে। তখন পুলিশ নির্বাক, কারণ যে পিটিয়েছে সে সরকারি দলের লোক বা তার অভিভাবক সরকারি দলের কর্মকর্তা। অথচ কোন ঘটনাই ঘটে নাই এমন কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহরহ গ্রেফতার করা হচ্ছে। যেখানে রিমান্ড দেয়া যুক্তিসংগত নয় তারপরও নিজ বিবেককে মাটি দিয়ে দাঁড়িপাল্লা (ন্যায়বিচার) খচিত চেয়ারে বসে ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করে পুলিশকে রিমান্ড বাণিজ্য (পত্রিকার ভাষায়) করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তারপর জজ কোর্ট এখন রাজনৈতিক মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের মতই আচরণ করেন। হাইকোর্টের জামিনের আদেশে জেল থেকে বের হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন তখন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের আদেশে এজাহারে নাম না থাকা মামলায় জেল গেইট থেকে পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করছে। এ যেন এক ‘রাম রাজত্ব’। এ ‘রাম রাজত্বে’ নতুন ইভেন্ট যোগ হয়েছে। রিমান্ডে থাকাবস্থায় ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে পরিবারদের নিকট থেকে চাহিদা মতো টাকা আদায়ের মতো ঘটনা ঘটছে। রিমান্ড ও ক্রস ফায়ার বাণিজ্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য (যারা টার্গেট) অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছে, অনেকে আবার বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে।
হাইকোর্ট জামিন দেয়ার পর পুলিশের জেল গেইট থেকে গ্রেফতারের প্রবণতা পূর্বেও ছিল, তা খুবই কদাচিত দেখা যেতো। ১/১১ এর অবৈধ সরকারের সময় এটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে যা এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। আইনের অপপ্রয়োগ করে কৌশলে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য জেল গেইটে গ্রেফতার বর্বরতার একটি বহিঃপ্রকাশ। সরকার নির্দেশিত পুলিশের এ বর্বরতাকে রোধ করার জন্য মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট জেল গেইটে গ্রেফতার নিষেধ করে এই দিক নির্দেশনা প্রদান করেন:"We direct that the respondent Mahmudur Rahman should not be shown arrested in connection with any other case unless there is true complaisance of section 167 of the Code of Criminal Procedure. Even he should not be arrested at the Jail gate after he is released from the custody which is not permissible in law." [সূত্র: ৬৮ ডি.এল.আর (এ.ডি) (২০১৬)(৩৭৩)]
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচেছদ-১১১ এ বলা হয়েছে যে, ‘আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হইবে।’ অর্থাৎ সংবিধান মোতাবেক সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক আইন সংক্রান্ত প্রদত্ত দিক নির্দেশনা দেশের সকল আদালতের উপর প্রযোজ্য। অ্যাপিলেট ডিভিশনের জেল গেইটে গ্রেফতার সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনাকে অমান্য করে জামিন হওয়ার পর পুলিশ জেল গেইটে গ্রেফতার করছে। পুলিশ তো বটেই, বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেটরাও সুপ্রিমকোর্টের দিক নির্দেশনা মানছেন না। কারণ এখন তাদের সরকারের অধীনস্ত করে দেয়া হয়েছে। যদিও আইনে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিচার বিভাগ, বাস্তবতা এই যে, সংবিধানের ৪৮(গ) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সকল প্রশাসনিক কার্যক্রমই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক কোন কাজে নাক গলাতে পারবেন না।
রাজনীতিতে পতিতাদের প্রভাব পূর্বেও ছিল বর্তমানেও আছে। ইতিহাসবিদ গোলাম আহাম্মদ মোর্তজা তার ‘বজ্রকলম’ (পৃষ্ঠা-১৬৫/১৬৬) বইতে ব্রিটিশ আমলে রাজনীতিতে পতিতাদের সংশ্লিষ্টতার একটি চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন, ‘ঐ সমস্ত রাজা-মহারাজা, বাবু ও জমিদার ধনীরা প্রকাশ্যে বেশ্যাখানায় যেতে দ্বিধাবোধ তো করতেনই না, বরং প্রতিযোগিতা করে বাহাদুরি দেখাতেন তাঁরা। সেই সময় নাচে গানে পটু বেশ্যাদের একটা সম্মানীয় নাম ছিল বাঈজী। ঐ সুন্দরী বেশ্যা-বাঈজীর মধ্যে যারা ছিল খুব খ্যাতনামা তাদের নাম নিকি, সুপন, বকনাপিয়ারী, হিঙ্গুল প্রভৃতি। ঐ বাবু ও জমিদারেরা এদের ভাড়া করে আনতেন। নাচ, গান, বাজনা আর খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে বাজী পোড়ানো এবং আরও কুৎসিত আমোদ-প্রমোদের উৎসব চলতো ঢালাওভাবে। বাড়ির এই উৎসবে ইংরেজ মনিবদের নেমতন্ন করা হোত।’
বিবেকই মানুষ এবং বন্যপ্রাণির সাথে তফাতের প্রধান মাপকাঠি। পতিতা যখন দেহ বিক্রি করে তখন কলঙ্কিত হয় একজন নারী। অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যখন বিবেক বিক্রি করে তখন বিপর্যস্ত হয় গোটা জাতি যার প্রধান শিকার হয় সমাজের শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। তোষামোদীতে কে কার চেয়ে এগিয়ে তা নির্ধারণের জন্য বিবেক বিক্রির প্রতিযোগিতা চলছে যা এখন মাহামারীতে পরিণত হয়েছে।
পবিত্র কোরানে আল্লাহপাক বলেন, ‘সাবধান! সে যদি সত্য বিরোধিতা থেকে বিরত না হয়, তবে আমি এই মিথ্যাচারী পাপিষ্টের মাথার সামনের চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবো। তবে সে সাহায্যের জন্য ডাকুক ওর সঙ্গীসাথীদের। আর আমি শুধু নির্দেশ দেবো আজাবের ফেরেস্তাদের’ (সূরা: আলাক, আয়াত ১৫-১৮)। তফসীরকারকদের মতে, যেহেতু মানুষের মস্তিষ্কে (মগজে) বিবেকের উৎপত্তি সেহেতু মাথার সামনের চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে নেয়ার কথা পবিত্র কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এটাই অনুমেয় যে, শেষ বিচারের দিনে বিচারের কাঠগড়ায় মানুষের বিবেককেই দাঁড় করানো হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন