ড. মুহাম্মদ এনামুল হক আজাদ
গত ১৩ এপ্রিল ২০১৬ বুধবার রাত ৭টা ৫৭ মিনিট রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ৬.০৯ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এতে চট্টগ্রাম ও ফেনীতে কয়েকটি বিল্ডিং হেলে পড়া ছাড়া তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর জানা যায়নি। উঁচু ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে কিছু লোক আহত হয়েছে মাত্র। কিন্তু তারপরও আমরা ভূমিকম্প বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে আমদের উদ্বেগ অনেক আগ থেকেই। বিশেষ করে বিগত ২৫ এপ্রিল ২০১৫ শনিবার নেপালে ঘটে যাওয়া ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পর থেকেই আমাদের উদ্বেগ অনেক বেড়ে যায়। ঐ সময় নেপালে প্রায় ৯ হাজারের মত মানুষ মারা যায় এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকাকে নিয়ে শুরু হয় নানা হিসাব-নিকাশ, জল্পনা-কল্পনা, বক্তব্য-বিবৃতি। কেউ বলছেন ভৌগোলিক কারণে বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। কেউ বলছেন তীব্র ভূমিকম্পে ঢাকা হবে অগ্নিকু-। কেউ বলছেন ‘৭৮ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ঢাকায়।’ কোন জরিপকারী বলছেন ‘ভূমিকম্প হলে ৮৮ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটবে ঢাকায়।’ কেউ কেউ ভূমিকম্পের সময়ের করণীয় নির্দেশ করার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ ভূমিকম্পের কারণও বলার চেষ্টা করছেন। তারা বলেন যে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কয়েকটি প্লেটের উপর অবস্থিত। এগুলোর সংঘর্ষেই ভূমিকম্প তৈরি হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম তার গবেষণায় বলেন, হিমালয়ের পাদদেশে মেইন বাউন্ডারি ট্রাস্ট (এম বিটি) রয়েছে যা বাংলাদেশ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে। এখানে ইউরেশিয়া প্লেটের নিচে ভারতের যে প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে সেটি লক হয়ে আছে। এটি খুলে গেলেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হবে।
ভূমিকম্প হলে ঢাকার কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে এ নিয়ে যারা চিন্তিত, উদ্বিগ্ন এবং ঐ সময়ের করণীয় ও এর পূর্বের করণীয় বিষয়ে নির্দেশ করছেন, এর প্রায় সবটার সাথে আমরাও একমত। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘তীব্র ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকা অগ্নিকু-ে পরিণত হবে।’ তিনি জাপানের কোবে নগরীর উদাহরণ টেনে বলেন, ভূমিকম্পে ঐ বাণিজ্যিক নগরী শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসে প্রায় ৭ দিন জ্বলেছিল। ঢাকা শহরের বাসিন্দা হিসেবে এ কথা শুনে কেউ উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকতে পারেন কি? চিন্তাহীন ও উদ্বেগমুক্ত থাকা কি সম্ভব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, ‘পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা। সেই সঙ্গে ঢাকায় রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। শক্তিশালী ভূমিকম্পে রাজধানীতে ধসে যেতে পারে ১০ শতাংশ ভবন। এতে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ধসে যাওয়া ভবনে অবরুদ্ধ হবে ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ। নগরবাসীদের উদ্ধারে যথাযোগ্য প্রস্তুতি না থাকায় গ্যাসলাইন ফেটে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
কিন্তু চিন্তা ও উদ্বেগ শতগুণ বেড়ে যায় তখন, যখন ‘প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম’ এ সত্যটাকে অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন বা অনুভব করছেন না। যখন দেখা যায় এ দেশের ৮৫-৯০ জন মানুষের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এতদসংক্রান্ত বাণী থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। অবশ্য এ এড়িয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। আমাদের মনে হয়, এর সব চেয়ে বড় কারণ অজ্ঞতা, রাসূল (সা.)-এর বাণী সম্পর্কে উদাসীনতা ও জ্ঞানশূন্যতা। ভূমিকম্প কি কারণে ঘটে সেই সম্পর্কে জ্ঞানহীনতাই আমাদেরকে নানা জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত রেখেছে। নচেৎ কারণ জানা থাকলে সেই কারণ ঘটতে না দিলে ভূমিকম্পের আশঙ্কাও কমে যেত। বিজ্ঞানীগণ এ পর্যন্ত যে সব কারণ বলছেন সব অনুমাননির্ভর। তাদের বর্ণিত কারণই মূল কারণ হলে তারা অবশ্যই এর পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হতেন। আমরা জানি, বিজ্ঞানীগণ বলছেন, ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। তা হলে এখন একটা প্রশ্ন দেখা দেয় যে, বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা কি এতই নির্দয়, নিষ্ঠুর যে, কোন কারণ ছাড়া, কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি হাজার হাজার মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দেবেন? বিনা কারণে অপরিমেয় সম্পদ তিনি নষ্ট করে দেবেন? নাকি এটা এমনি এমনিই ঘটছে? এর কোনটাই যুক্তিতে টেকে না। প্রথমত, কোন কিছুই এমনি এমনিতে ঘটে না-ঘটেনি। কর্তা ছাড়া কোন কর্মই কখনও সংঘটিত হয় না- হয়নি। দ্বিতীয়ত, যিনি স্রষ্টা তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টি অনেক প্রিয়। নিজ সৃষ্টিকে তিনি বিনা কারণে এভাবে ধ্বংস করবেন না, করতে পারেন না। বরং তিনি বলেছেন, ‘যে সৎকর্ম করে, সে নিজের উপকারের জন্যেই করে আর যে অসৎকর্ম করে তা তার উপরই বর্তায়। আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি মোটেই জুলুম করেন না।’ (হা-মীম-সেজদাহ ঃ ৪৬) তিনি আরো বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (রুম ঃ ৪১) এতে বুঝা যাচ্ছে ভূমিকম্পের পেছনেও দৃশ্যমান কিছু কারণ অবশ্যই রয়েছে যা আমরা জানি না বা জানার চেষ্টা করি না। বিনা কারণে আল্লাহ ভূমিকম্প দেন না-দেননি কখনো। এখন জানতে হবে সেই কারণ কি? এবং তা জানতে হবে সন্দেহাতীতভাবে-নির্ভরযোগ্য সূত্রে। আর গ্রহণ করতে হবে এমন ব্যবস্থা যাতে সে কারণগুলো না ঘটে, বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমে আসবে, রক্ষা পাবে হাজার হাজার মানুষ ভূমিকম্পের আঘাত থেকে, বেঁচে যাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে, প্রয়োজন হবে না আমাদের এতশত প্রস্তুতি ও চিন্তাভাবনার। সেই নির্ভরযোগ্য সূত্র হলেন মহান স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের প্রিয় রাসূল, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও আদর্শ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ছিলেন পৃথিবীবাসীর জন্য করুণার আঁধার। আল্লাহ পাক বলেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। (আম্বিয়া ঃ ১০৭) সেই করুণাময়-দয়াল নবী পৃথিবীবাসীকে যাবতীয় ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার উপায় বলে দিয়েছেন। কি তাদের জন্য কল্যাণকর তার নির্দেশও তিনি দিয়েছেন। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায়ও তিনি বলে দিয়েছেন। ভূমিকম্পের কারণ প্রসঙ্গে বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ তিরমিযি শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘হযরত আলী (রা.) বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন ঃ আমার উম্মত যখন পনরটি কাজে লিপ্ত হইবে তখন তাহাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের বিপদ-বিপর্যয় নাযিল হইবে। তিনি উক্ত পনরটি কাজ কি কি তাহা গণনা করিয়া বলিয়াছেন।’ তিরমিযি শরীফের অন্য একটি হাদীসে সেই পনরটি কাজের উল্লেখ রয়েছে এভাবে ‘হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন ঃ যখন গনীমতের মালকে ব্যক্তিগত সম্পদরূপে ব্যবহার করা হইবে, আমানতকে গনীমতের মাল মনে করা হইবে, জাকাতকে জরিমানা ধারণা করা হইবে, দ্বীন ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে এলম হাসিল করা হইবে, পুরুষ তাহার স্ত্রীর আনুগত্য করিবে, সন্তান মায়ের নাফরমানী করিবে, বন্ধুকে খুব নিকটে স্থান দিবে, আপন পিতাকে দূরে সরাইয়া রাখিবে, মসজিদসমূহে শোরগোল করা হইবে, ফাসেক ব্যক্তিই গোত্রের সরদার হইবে, জাতির নিকৃষ্টতম ব্যক্তি তাহাদের নেতা হইবে, ক্ষতির ভয়ে মানুষের সম্মান করা হইবে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রাদি ব্যাপকভাবে প্রকাশ লাভ করিবে, মদ্যপান বাড়িয়া যাইবে এবং এই জাতির পরবর্তীকালের লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি অভিসম্পাত করিতে থাকিবেÑ সেই সময় তোমরা অপেক্ষা কর, রক্তিম বর্ণের ঝড়ের, ভূকম্পনের, ভূমি ধসের, রূপ বিকৃতির, পাথর বৃষ্টির এবং সুতা ছেঁড়া দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনসমূহের।’ (মেশকাত শরীফ বাংলা, ১০ম খ-)
হাদীসে রক্তিম বর্ণের ঝড়, ভূমিকম্পন, ভূমিধস, রূপ বিকৃতি, পাথর বৃষ্টি ও অন্যান্য বিপদ-বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ১৫টি কাজকে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যদি এ সকল বিপদ-মুসিবত থেকে বাঁচতে চাই তা হলে এ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যদেরও বিরত রাখতে হবে। এটাই হবে প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। তা হলে আর ভূমিকম্পজনিত ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য আমাদের এত ব্যাপক আয়োজন, চিন্তাভাবনা বা হা হুতাশ করতে হবে না। এটাই এ মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কাজ বলে আমরা মনে করি। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। তবে মাঝে মাঝে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় মো’মেন বান্দাদের পরীক্ষার জন্যও নানা বিপদ-আপদের সম্মুখীন করে থাকেন। সে কথাটিও সকলের স্মরণ রাখতে হবে। যেমন তিনি পবিত্র কালামে পাকে বলেন, ‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফলফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সফরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েতপ্রাপ্ত। (আল-বাকারা ঃ ১৫৫-১৫৭)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন