প্রসঙ্গ : যুগ-যমানা, চাল-চলন, আহার-বিহার ও স্থান-পাত্রের পরিবর্তন- বিবর্তনে চারিদিকে পরিবেশে সবকিছুতেই কেমন যেন পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গত দু’দশক পূর্বেও সার্বিক অবস্থা-পরিস্থিতি যেমনটি দেখা যায়নি, বর্তমানে তা-ই যেন অধিকহারে ঘটছে। উদাহরণত ফল-ফসল, খাদ্যÑখাবারে ফরমালিন ইত্যাদি ব্যবহার এবং তার একটা কু-প্রভাব মানবদেহে , শরীর-স্বাস্থ্যে বিস্তৃতি। একইভাবে অল্প বয়সে চুল পড়তে শুরু করা বা সাদা হয়ে যাওয়া বিষয়টি, যা ইতোপূর্বে অনেকটা ব্যতিক্রম ব্যাপার ছিল, তা এখন যেন, অনেকটা ব্যাপক হারেই ঘটছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে খেযাব ইত্যাদি ব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার এতে আমলদার সাধারণ মুসলমানের পাশাপাশি মুত্তাকী আলেম/ইমামগণের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ বিষয়টি সম্পর্কে অনেকগুলো সহীহ হাদীসে নেতিবাচক বর্ণনা বিদ্যমান ; যদিও ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো হাদীসে তার বৈধতার কথাও দেখা যায়। যে কারণে ইদানিং বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে অনেক বেশী। তাই মানসিক তাড়া থেকে কিছুটা লেখার এ প্রয়াস।উল্লেখ্য, বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের এ উপমহাদেশের পরিচিত ও প্রচলিত বিজ্ঞ, স্বনামধন্য মুফতিয়ানে কিরাম যেমন মুফতী মুহাম্মদ শফী (র), মুফতী মাহমূদ হাসান গাঙ্গোহী (র) ও মুফতী রশীদ আহমদ লিুধয়ানী (র) প্রমুখ যাঁদের ফাতাওয়া সংক্রান্ত গন্থাদি এ অঞ্চলে অধিক পঠিত হয়, অনুস্মৃত হয়ে থাকে। এঁদের ব্যাখ্যা-বক্তব্যের সূত্র ধরে এবং এঁদের অভিমত দ্বারা আমার এ লেখাকে সম্বৃদ্ধ করেছি।
প্রশ্ন-১ : প্রশ্ন উঠে, চুলে বা দাঁড়িতে কালো খেযাব ব্যবহার জায়েয কিনা। যদি বলি, “না জায়েয”।সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে, তাহলে ইমাম আবূ ইউসুফ (র.) এর বিরোধিতা করেন কেন ? কারণ, তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “আমি অবশ্যই আমার স্ত্রীর জন্য সাজগোজ (খেযাব দ্বারা) করাকে পছন্দ করি”Ñ এ থেকে তো সুস্পষ্টভাবে কালো খেযাব ব্যবহারের বৈধতা বরং উৎসাহ এমনকি তা একটা উত্তম কাজ বলে মনে হচ্ছে! আর যদি বলি যে, “তা জায়েয”। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে, তাহলে ইমাম আবু হানিফা (র.) ও অন্যান্য ফকীহগণ তা হারাম বা ‘মাকরূহ তাহরীমী’ বলেন কেন ? আবার গাজী/মুজাহিদ এর জন্য জায়েয বলেন এবং অন্যদের জন্য নিষেধ করেন কেন ?
খেযাব বিষয়ে বিভিন্ন অবস্থা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিবেচনায় শরীয়তের বিধানে কিছু ব্যাখ্যা বিদ্যমান। যার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে, কালো রঙ ব্যতীত অন্যান্য রঙের খেযাব ব্যবহার মুজতাহিদ ইমামগণের মতে, জায়েয এমনকি মুস্তাহাবও বটে। লাল রঙ্গের খেযাব যা শুধু মেহেদী দ্বারা হোক বা কিছুটা কালো রঙ্গের কাছাকাছি হয়ে থাকে, যেটিকে ‘কাতাম’ (এমন উদ্ভিদ যার দ্বারা চুলে কলপ দেওয়া হয়) বলে। অর্থাৎ যা গাঢ়, মিশমিশে কালো নয়। এটিকে আমরা ব্রাউন-‘ধুসর’ বা ‘বাদামী’ রঙ্গের কাছাকাছি ‘ হালকা কালো রঙ’ বলতে পারি। সেটিও সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত। অধিকাংশ (জুমহুর) মুহাদ্দিসীন এর মতে এমন খেযাব মহানবী (সা:) ব্যবহার করেছেন মর্মে প্রমাণ রয়েছে। সাহাবাগণের মধ্যে একমাত্র হযরত আনাস (র.) এবং গবেষক ইমামগণের মধ্যে ইমাম মালেক (র.) যদিও এমন আমলী প্রমাণকে আমলে নেননি। কিন্তু তারপরও তাঁরা সেটিকে না জায়েযও বলেন না।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.) আবার উক্ত দু’জনের তা আমলে না নেওয়া বিষয়টির যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ জবাব দিয়েছেন। যার অন্যতম বাক্য হচ্ছেÑ “হযরত আনাস (রা.) ব্যতীত অন্যান্যগণ মহানবী (সা:) খেযাব ব্যবহার করেছেন মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। যিনি সাক্ষ্য দেননি তিনি যাঁরা সাক্ষ্য প্রদান করেছেন তাঁদের সমতুল্য নয়। মোটকথা, ইমাম আহমদ (র.) এবং তাঁর সঙ্গে একদল হাদীস বিশরদ প্রমাণ করেছেন যে, মহানবী (সা:) খেযাব ব্যবহার করেছেন। অবশ্য ইমাম মালেক (র.) তা আমলে নেননি। (যাদুল মা‘আদ : খ-২, পৃ-১২৭)
একইভাবে সহীহ বুখারীতে উসমান ইবন আব্দুল্লাহ্ ইবন মুয়াহহাব সূত্রে বর্ণিত, “আমরা উম্মে সালামা (রা.) এর কাছে গেলাম। তখন তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে হুযুর (সা:) এর চুল মুবারক বের করে দেখালেন। দেখা গেল, তা মেহেদী ও কাতাম দ্বারা খেযাবকৃত (রঙ্গিন) ছিল। (যাদুল মা‘আদ : খ-২ পৃ-১২৭)
সহীহ হাদীসে আরও বিদ্যমানÑ “সর্বোত্তম খেযাব যা দ্বারা তোমরা কেশের শুভ্রতাকে পরিবর্তন করতে পার, তা হচ্ছে মেহেদী ও ‘কাতাম’। (চারটি সহীহ গ্রন্থেই এটি বিদ্যামান)
একইভাবে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত, “তিনি মেহেদী ও কাতাম দ্বারা খেযাব ব্যবহার করতেন।” (প্রাগুক্ত)
সুনানি আবূ দাউদ গ্রন্থে হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, “নবী করীম (সা:) এর সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রম করে গেলেন যিনি মেহেদী দ্বারা খেযাবকৃত ছিলেন। মহানবী (সা:) বললেন, “লোকটি কেমন সুন্দর!” তারপর আরেকজন লোক অতিক্রম করে গেলেন যিনি মেহেদী ও কাতাম উভয়টি দ্বারা খেযাব করেছিলেন। একে দেখে মহানবী (সা:) বললেন, “এইলোক ওই ব্যক্তির চেয়েও উত্তম।” আবার তৃতীয় একজন অতিক্রম করে গেলেন যিনি হলুদ রঙ্গের খেযাবকৃত ছিলেন। তখন নবীজী (সা:) বললেন, “এ লোক সবার চেয়ে উত্তম।”
উক্তসব হাদীসের প্রেক্ষিতে হানাফী বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছেÑ “পুরুষদের বেলায় লাল খেযাব ব্যবহার সুন্নাত। আর এটি হচ্ছে মুসলমানদের চিহৃ ও পরিচায়ক।” (আলমগীরী; ফারাহিয়াত অধ্যায়, খ-৫, পৃ-৩৬৯)
দুররুল মুখতার গ্রন্থে রয়েছেÑ “পুরুষের পক্ষে মুস্তাহাব হচ্ছে তার চুল ও দাঁড়িতে খেযাব ব্যবহার করা ; যদিও যুদ্ধ পরিস্থিতি না হয়। এটিই হচ্ছে গবেষণাকৃত বিশুদ্ধতম অভিমত। আল্লামা শামী (র.)ও এতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (শামী : খ-৫, পৃ-২৯৫, অধ্যায় : আল হায়র ওয়াল ইবাহা)Ñ এ পর্যন্ত আলোচনা হলো সেই খেযাবের যা নিরেট কালো বা মিশমিশে কালো হবে না।
যে খেযাব কালো হবে তার ক্ষেত্রে তিন রকম গবেষণা অভিমত বিদ্যমান :
যে ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয, ২. যে ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে না জায়েয, ৩. বিরোধপূর্ণ ক্ষেত্র। যা অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতে না জায়েয এবং কোন কোন ইমামের মতে জায়েয।
(এক) : প্রথম অবস্থা বা ক্ষেত্র হচ্ছে, জিহাদকালীন কালো খেযাব কোন মুজাহিদ বা গাজীর পক্ষে ব্যবহার করা। যেন শত্রæদের প্রতি ভয়-ভীতি ও প্রভাব সৃষ্টির কারণ হয়। এটি ইজমা উম্মত ও বিশেষজ্ঞগণের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে জায়েয। কেননা আলমগীরীতে রয়েছেÑ“আর কালো খেযাব গাজীদের মাঝে যিনি তা ব্যবহার করবেন, এ উদ্দেশ্যে যে, তাতে শত্রæরা তাকে দেখে অধিক ভীত হবে ; সেক্ষেত্রে তার জন্য সিটি উত্তম বিবেচিত হবে। এতে ফিকহ বিশেষজ্ঞগণের ঐক্যমত্য রয়েছে।” খ-৫, পৃ-৩৬৯; একই অভিমত ‘যখীরা’ সূত্রে শামী গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে। (খ-৫, পৃ-২৯৫)
(দুই) : দ্বিতীয় ক্ষেত্র বা অবস্থা হচ্ছে, কাউকে প্রতারিত করার লক্ষ্যে কালো খেযাব ব্যবহার করা। যেমন পুরুষ নারীকে বা নারী পুরুষকে ধোকা দানের নিমিত্তে এবং নিজেকে যুবক প্রমাণের জন্য বা দেখানোর জন্য কালো খেযাব ব্যবহার করছে ; কিংবা কোন কর্মচারী স্বীয় মালিককে প্রতারিত করার লক্ষ্যে তা ব্যবহার করে। তাহলে এমনটি সকলের ঐক্যমত্যে না জায়েয। কেননা, ধোকা দান মুনাফেকির পরিচায়ক। আর কোন মুসলমানকে ধোকা দিয়ে তার দ্বারা কোন কাজ বা স্বার্থ আদায় করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।একটি সহীহ হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা:) ইরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি আমাদের (কারও) ধোকা দেয়, সে আমার উম্মতের মধ্যে গন্য নয়। চলবে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন