সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
বর্তমান সরকার ক্রমেই ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে ভাটা পড়েছে ব্যাপকভাবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এখন ভারসাম্যহীনতা চরমে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে কমে গেলেও দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশার কারণেই জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীলরা একেক সময় একেক কথা বলছেন। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। তিনি এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় দেনার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা। মূলত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীলও নেই বরং ক্রমেই অবনতিশীল অবস্থার দিকে মোড় নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কোন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দিন দিন অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থার উপরই দাঁড়িয়ে। তার উপর অর্থনৈতিক সেক্টরে যেভাবে লুটপাট শুরু হয়েছে তাতে আগামী দিনে আমাদের গন্তব্যটা কোথায় হবে ঠাহর করা খুবই মুস্কিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮শ কোটি টাকা চুরি হয়ে গেল। তা উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা তো হলোই না বরং এই অপকর্মের সাথে যারা জড়িত তাদেরও কেশাগ্র স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। টাকা উদ্ধার ও অপরাধীদের শনাক্ত করার ব্যাপারে ঢাকাঢোল পেটানো হলেও ফলাফলটা একেবারে অন্তসারশূন্য বলেই মনে হচ্ছে। এর আগের ঘটনাগুলোরও একই পরিণতি হয়েছে।
দেশের শেয়ারমার্কেট থেকে লক্ষ-কোটি টাকা চুরি হলেও তার কোন বিহিত করা সম্ভব হয়নি। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও ডেসটিনির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মূলত অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই এসব ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আর এ বৃত্ত থেকে আমরা কোনভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছি না।
সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণেই অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে মন্দাভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আর একদেশদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বৈদেশিক শ্রমবাজারেও ধস নেমেছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহেও ভাটা পড়েছে। সর্বোপরি বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতিটা পর্বত প্রমাণ। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।
রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ক্রমশ সীমিত হয়ে আসলেও ব্যয় বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ফলে সরকার রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেকটাই ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সুদের হার কমানোর পরও বেড়েই চলেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি যা সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের ‘বোঝা’ হিসাবেই গণ্য হয়। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অংক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। এই আট মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর যেটি অবশিষ্ট থাকে সেটাকে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়। সুদ-আসল পরিশোধের পর যে নিট অর্থ জমা থাকে সেটাকেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বা ধার বলে হিসাব করা হয়। আর এ জন্য সরকারকে সুদ গুণতে হয়। এ হিসাবে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ২০ হাজার কোটি টাকার যে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার জন্য সরকারকে মোটা অংকের সুদ দিতে হচ্ছে। এর ফলে সরকারের ঋণের ‘বোঝা’ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য মতে, ‘সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের অন্য সব পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে বলা চলে। ব্যাংকে টাকা রাখলে ৭/৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। শেয়ারবাজারের অবস্থা তো দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।’ ‘সুদের হার কমানোর পরও ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হারের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকেই ঝুঁকছে মানুষ।’ সে কারণেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে টাকা ধার করার কথা ভেবে রেখেছিল, আট মাসেই তার চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেয়া হয়ে গেছে। তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৮৯০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। অথচ পুরো অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল বাজেটে।
এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটেও সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকার ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল। বছর শেষে তা ২৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। ওই মাসে সবমিলিয়ে পাঁচ হাজার ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। জানুয়ারি মাসে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর জানুয়ারিতে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল আরও একটু বেশি; ৩ হাজার ২৯৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৫৪ কোটি, ২ হাজার ৩৫৩ কোটি এবং ২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। অবশ্য ডিসেম্বরে তা কমে এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে। বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই ঋণের বোঝা কমাতে গত বছরের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। মে মাসের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে প্রতি মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পেতেন একজন গ্রাহক। সুদের হার কমায় এখন পাচ্ছেন ৯১২ টাকা।
সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশের অর্থনীতি এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ফলে সরকারকে রাষ্ট্রীয় খরচ মেটাতে ঋণনির্ভর হতে হচ্ছে। আর সে ঋণের বোঝাটা বাড়তে বাড়তে পর্বত প্রমাণ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কোন পক্ষকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। মূলত অর্থনীতির এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যেমন অভ্যন্তরীণ আহরণ বাড়াতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনাও জরুরি।
আর বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে। যেসব দেশ থেকে আমরা বাজার হারিয়েছি, সেসব দেশে বাজার উদ্ধারের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। ক্রমবর্ধমান জনশক্তির জন্য নতুন করে বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুই ঋণনির্ভরতা স্থায়ী কোন সমাধান নয় বরং যে কোন দেশের জন্যই আত্মঘাতী বলেই বিবেচিত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন