আবিরাম বৃষ্টিতে গতকাল ছুটির দিনেও নগরবাসীর দুর্ভোগের শেষ ছিল না। বৃষ্টির তোড়ে জনজীবন থমকে যাবার উপক্রম হয়েছে। গত পাঁচ দিনের বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর আশেপাশের নি¤œাঞ্চলসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লাহর অলি-গলি। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতের নীচতলাসহ সড়কগুলোতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে কথায়ও হাটু পানি আবার কোথাও নালা পনি হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি দ্রæত নিষ্কাশন না হওয়ায় রাজধানীবাসী পড়েছে যানজটসহ পানিবদ্ধতার দুর্ভোগে।
বেশ কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হলেও অনেক জায়গায় ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানা গেছে, বৃষ্টিপাতের এই প্রবণতা ৩০ জুলাই সোমবার পর্যন্ত চলবে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। তাই সাগর শান্ত রয়েছে। এ কারণে সমুদ্রবন্দরকে কোনো সতর্কতা দেখাতে বলা হয়নি। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে স›দ্বীপে। সেখানে ১৮১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
‘অ্যাই যে পানি পার দশ টাকা, পানি পার দশ টাকা’। শুক্রবার সকালের দিকে রাজধানীর আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের দক্ষিণ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এভোবেই কোরাস সুরে পানি পারাপারের জন্য যাত্রীদের ডাকাডাকি করছিলেন একাধিক ভ্যানচালক। কবরস্থান গেটের সামনে অসংখ্য মানুষ জটলা বেধে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ অফিসে, কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কেউবা গার্মেন্টস বা ব্যক্তিগতভাবে কাজে বেরিয়েছেন। কিন্তু কবরস্থান গেটের সামনে এসে সবাই থমকে দাঁড়িয়েছেন।
কবরস্থান গেট থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। যেন অচেনা কোনো এক নদী। গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসসহ ইঞ্জিনচালিত যানবাহনগুলো দ্রæত চলে যাওয়ার সময় দু’পাশে পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এ ছাড়া নিউমার্কেট সংলগ্ন বড় ডাস্টবিনের ময়লা পানিতে ভাসছে। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে এক মিনিটের পায়ে হাটার পথ ১০ টাকা দিয়ে পার হচ্ছেন। আবার কেউ জামা কাপড় ভিজিয়ে গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছেন। রাস্তার ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো খুলে দিয়ে পানি অপসারনের ব্যর্থ চেষ্টাও দেখা যায়।
কবরস্থানের গেটে দাঁড়িয়ে সিটি মেয়রের সমালোচনা করছিলেন আনুমানিক ষাট বছরের এক বৃদ্ধ। বলছেন, মেয়র সাহেব তো বক্তৃতায় নগর উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু কই এই যে পানিবদ্ধতার কারণে হাজার হাজার মানুষের দুভোর্গ হচ্ছে এর সমাধান তো করতে পারছেন না। নিউমার্কেটের মতো এলাকায় যদি এমন পানি জমে থাকে তবে কী যে উন্নয়ন হচ্ছে তা সহজেই বোঝা যায়। এদিকে, গন্তব্যে ছুটে চলা মানুষদের জন্য টাকার বিনিময়ে সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন ভ্যানচালকরা। অন্যদিকে এক মিনিটের রাস্তা পার হতে জনপ্রতি গুণতে হচ্ছে ১০ টাকা। কবরস্থান গেট সংলগ্ন আইয়ুব আলী কলোনীর জামাল নামে একজন কেয়ারটেকার জানান, ভোর বেলা ভ্যানচালকরা জনপ্রতি পাঁচ টাকায় নীলক্ষেত পর্যন্ত পারাপার করলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে রেট দ্বিগুণ অর্থাৎ দশ টাকা করে ফেলেন।
গতকাল বিকেলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মিরপুর, শ্যামলি, পল্লবী, তালতলা, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও এলাকার সড়কগুলোতে বৃষ্টির পানি ঢেউ খেলতে দেখা গেছে। গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় বেশ কয়েকটি যানবাহন বিকল হয়ে সড়কে পড়ে আছে। সড়কের কোথাও কোথাও যানজট রয়েছে। পানির মধ্য দিয়ে পথচারীরা হেঁটে চলাচল করছেন।
অপরদিকে, দারুস সালাম, ক্যান্টনমেন্ট, কালশি, উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকা এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ধানমন্ডি-২৭, হাজারীবাগ, শংকর, জিগাতলা, রায়েরবাজার ও পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডসসহ বেশ কিছু স্থানে পানিবদ্ধতার খবর পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় যারা ঘর ছেড়ে কাজে বাইরে বের হয়েছেন, তাদের সীমাহীন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরো সড়কটি হাঁটু পরিমাণ পানি জমে গেছে। পানিতে ডুবে থাকা সড়কের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের সময় সড়ক জুড়ে সৃষ্টি হচ্ছিল ঢেউ। কাজী পাড়ার বাসিন্দা আবু সালেহ সাহাদাত বলেন, জুমার পর মিরপুর ১০ নম্বরে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দেখি পুরো রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে। যানবাহনও অনেক কম। কয়েকটি গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। পরে বাধ্য হয়ে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল। পানি জমলে বেগম রোকেয়া সরণিতে কাজী পাড়া নৌকা নেমে যায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতায় কাজ করার জন্য আমাদের অঞ্চল ভিত্তিক কাউন্সিলর ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করা আছে। তারা সড়কের বিভিন্ন ম্যানহোল ও ড্রেন উন্মুক্ত করে দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ডিএসসিসি এলাকায় পানিবদ্ধতা তেমন একটা নেই।
বর্তমানে রাজধানীর ১৩টি স্থানে পানিবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া, প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত খালগুলো খনন ও প্রশস্ত করে তীর উন্নয়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে খালের দুই তীরের পরিবেশ উন্নত করা হবে। এজন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ‘ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক স¤প্রসারণ ও খাল উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পানিবদ্ধতা নিরসন করা হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে রাজধানীর গুলিস্তান, সিদ্দিক বাজার, বাবুবাজারসহ পুরান ঢাকার বিভিন্নি এলাকায় সড়কে পানি থৈ থৈ করছে। পুরাতন ও অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে পানি দ্রæত নিষ্কাশন হতে না পেরে মুল সড়ক ও অলিগলিতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগে পড়ে। এছাও মুগদাপাড়া, মানিকনগর, মতিঝিল, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর টাউন হল, আসাদ গেট, ধানমন্ডি, কারওয়ান বাজার, গুলশান, বনানী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, নয়াপল্টন, কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন