বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত সোনায় গরমিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উল্লেখ করেছেন, তিন কেজি স্বর্ণ নিয়ে প্রশ্ন, এটা বিরাট কিছু নয়। একই সঙ্গে জব্দ করা সোনা পরীক্ষা করেন ৬জন কর্মকর্তা। যাদের মধ্যে শুধুমাত্র স্বর্ণকারই বিশেষজ্ঞ। তার কষ্টিপাথরই সোনা বিচারে যথেষ্ট বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া ভল্টের নিরাপত্তা নিয়ে বলা হয়েছে, জাতিগতভাবেই নিরাপত্তা সচেতনতা কিছুটা কম আমাদের। গত ২৫ জুলাই অর্থমন্ত্রী স্বাক্ষরিত এই চিঠি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-এর কাছে পাঠানো হয়। যার অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান এবং অর্থ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিবকে পাঠানো হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত স্বর্ণের গরমিলে দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ে চলছে তোলপাড়। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছেন। যদিও এই চিঠির আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে ভল্টের স্বর্ণে কোনো ধরনের কারসাজি হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সোনা হেরফের হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণে কোনো সমস্যা নেই। ৯৬৩ কেজি স্বর্ণের মধ্যে মাত্র তিন কেজি স্বর্ণ দূষিত। এটা কোনো সমস্যাই নয়। এ ব্যাপারে এনবিআরকেও একহাত নেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা নিয়ে এনবিআর’র কোনো কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। যা করার বাংলাদেশ ব্যাংকই করবে। এ বিষয়ে কমিটি গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রশ্ন ওঠে, অভিযোগ পরীক্ষা ও যাচাইয়ের আগেই অর্থমন্ত্রী কীভাবে জানলেন যে, স্বর্ণে কোনো সমস্যা নেই?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভল্টের স্বর্ণ নিয়ে যদি সত্যিকারার্থে কোনো ধরনের গরমিল করা হয়ে থাকে, তবে তা হবে রিজার্ভ চুরির চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা। তাই শুল্ক গোয়েন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বর্ণের মান ও পরিমাণ যাচাই করে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একইসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদন কেন চেপে রাখা হয়েছিল, তা উদ্ঘাটনের উদ্যোগ নেয়া হলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। তবে কেবল তদন্ত করলেই হবে না, প্রতিবেদন প্রকাশ এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়ও উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়া ও কাউকে শাস্তি না দেয়ায় নতুন নতুন কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে। রিজার্ভ চুরি থেকে ভল্টে রাখা সোনায় গরমিল। খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও ডলারের অস্থিরতায় ব্যাংক খাত অস্থির। পাশাপাশি ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষ আস্থার সঙ্কটে। এখনই লাগাম টানতে না পারলে চির ধরা এই আস্থা ফিরিয়ে আনা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে আরও বড় ধরণের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এসব অনিয়মের মূল কারণ হলো- আগের দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। অর্থনীতিবীদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে স্বর্ণ কেলেঙ্কারির বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের নিরাপত্তা’ সম্পর্কিত চিঠিতে অর্থমন্ত্রী ৩টি বিষয় উল্লেখ করেছেন। প্রথমত; বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো বলে উল্লেখ করেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে এক্ষেত্রে নিরাপত্তা সচেতনতা জাতিগতভাবে একটু কম বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভল্টে ৩৮টি সিসিটিভি চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে, সবসময় ৬ স্তরভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদ্যমান একই সঙ্গে ২৪ ঘন্টা ৭০ জন পুলিশ অবস্থান করছেন।
দ্বিতীয়ত; অর্থমন্ত্রী চিঠিতে উল্লেখ করেছেন- পরশ্রীকাতরতা আমাদের বিশেষত্ব হলেও সচরাচর আমরা মানুষের ভালো দিকটাই দেখি, অযাচিতভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই। আর তাই সমস্যা হলো কাল প্রলেপযুক্ত দুই টুকরা তথাকথিত সোনার গোলাকার চাকতি এবং রিং নিয়ে। একই সঙ্গে ছয় জন কর্মকর্তা জব্দ করা সোনা সব পরীক্ষা করেন। তাদের মধ্যে স্বর্ণকারই আমাদের সচরাচর এক্সপার্ট এবং তার কষ্টিপাথরই জব্দ করা সোনা সব সোনা বিচারে যথেষ্ট বলে উল্লেখ করেন মুহিত।
তৃতীয়ত; বেশি সংগ্রহ হলো স্বর্ণবারের। এগুলো বার হিসেবেই চোরাচালান বা আমদানি হয়। অন্যান্য স্বর্ণ অলংকার বা অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত স্বর্ণ যা জব্দ হয় তা সময়ে সময়ে নিলাম করা হয়। তবে জানা গেছে যে, দশ বছরে কোন নিলাম হয় নি, বিষয়টির খতিয়ে দেখছি। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আরও জানান, ‘৯৬৩ কেজি ওজনের সোনা আমাদের ভল্টে মজুত আছে। তার মধ্যে প্রশ্নবোধক মান হলো ৩ কেজি চাকতি ও রিং নিয়ে। তাই বিষয়টি তেমন একটা বিরাট কিছু নয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন