ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার কৃতিছাত্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল গত ১০ এপ্রিল’১৬। চৈত্রের দাবদাহে ক্লান্ত পথিকের মতো সেদিন যখন ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরায় অনেকটা নিরিবিলিতে অবস্থিত মাদ্রাসা কম্পাউন্ডে পৌঁছলাম তখন মাগরিবের আযান হচ্ছিল। দু‘পাশে মাদ্রাসার উঁচু দালানের মাঝখানে মাঠে সন্ধ্যার ¯িœগ্ধ হাওয়ার পরশে হাজারো ছাত্রের প্রাণবন্ত উপস্থিতির পুরো আয়োজনটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। মনে হয়েছে, সরকারি আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাটির বহুবিধ অর্জনের মধ্যে অন্যদের জন্য অনুকরণ করার মত অনেককিছু আছে।
সরকারি আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলো সম্পর্কে সাধারণ অভিযোগ হল, সেখানে আরবি ইলমের চর্চা থেমে গেছে। বাংলা ইংরেজি ও জেনারেল সাব্জেক্টের চাপে আরবি ও ইসলামী শিক্ষা একেবারে কোণঠাসা। অথচ আরবি শিক্ষার উৎকর্ষ ও সরাসরি কুরআন হাদীসের জ্ঞানে পা-িত্য অর্জন ও তার বিস্তার ঘটানোই মাদ্রাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও প্রতিপাদ্য। আরেকটি অভিযোগ হল, মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে আলেমসূলভ দ্বীনি চরিত্রের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। মাদ্রাসা অঙ্গনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক লম্বা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও পাজামা। অনেকের মতে এগুলো সুন্নাতি লেবাস। এর বিপরীতে প্যান্ট-শার্ট ইংরেজদের অনুকরণে স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ পোশাক। তিক্ত হলেও সত্য যে, আলিয়া নেসাবের অনেক মাদ্রাসার ছাত্রদের দেখলে তারা কি স্কুল কলেজের ছাত্র, নাকি মাদ্রাসার তা ফারাক করা কঠিন। পোশাকের সাথে নামায-দোয়া ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালনে কোন কোন মাদ্রাসার ছাত্রদের উদাসীনতা দেখে অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর বাহ্যিক উন্নতির অন্তরালে অপর যে দৈন্য হাহাকার করে তা হল, স্থানীয় জনগণের সাহায্য কমে যাওয়া। অথচ এক সময় জনগণের সাহায্যে; বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ দানশীল ব্যক্তিদের অর্থে এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। এখন নাকি দানশীলরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ, মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রচুর সরকারি বেতনভাতা ও অনুদান পান এবং যে দ্বীনি পরিবেশের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় আর দোয়ায় ধন্য হওয়ার আশায় তারা অকাতরে চাঁদা দিত, তা এখন বিদায় নিয়েছে।
কথাগুলো মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়ার জো নেই। এসব অভিযোগ ও সমস্যার সমাধান দিতে না পারলে অতীতের নিউস্কীম মাদ্রাসার মতো আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলো স্কুল কলেজে পরিণত হওয়া সময়ের ব্যাপার বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। বৃটিশ আমলে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক মাদ্রাসাগুলোতে ইংরেজী শিক্ষার সমন্বয়ে নিউস্কীম পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল ১৯১৫ সালে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে নিউস্কীমভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০৭৪টিতে। এই পদ্ধতিটি উন্নত মনে হলেও দুঃখজনক হল, এগুলো খুব অল্পসময়ে মাদ্রাসার চরিত্র হারিয়ে ফেলে। ফলে ১৯৫৭ সালে এক সরকারি আদেশ বলে নিউস্কীমভুক্ত সব মাদ্রাসা সাধারণ হাই স্কুল ও ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। যার জীবন্ত সাক্ষী ঢাকার নজরুল কলেজ, যা পূর্বে ঢাকা মুহসেনিয়া মাদ্রাসা বা ঢাকা মাদ্রাসা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। আরমানিটোলার হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় এক সময় মওলানা জাফর আহমদ উসমানীর মতো উপমহাদেশ খ্যাত আলেমে দ্বীন শিক্ষকতা করেছেন। সেটি এখন হাম্মাদিয়া হাইস্কুল। চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদ্রাসায় চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বহু বুযুর্গ আলেম ছাত্র লেখাপড়া করেছেন। সেটি রূপান্তরিত হয়েছিল ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে। শুরুতে দানবীর হাজি মুহাম্মদ মুহসিনের ওয়াকফ স্টেটের অর্থে প্রতিষ্ঠিত ছিল বিধায় ভদ্রতার খাতিরে এখন নামকরণ করা হয়েছে হাজি মহসিন কলেজ। কালের সাক্ষী রাজশাহী হাই মাদ্রাসা এখনো স্বনামে বহাল আছে। তবে ভেতরে সাধারণ স্কুল। ভোলার আব্দুর রব হাই স্কুলটি এভাবে মাদ্রাসার চরিত্র হারিয়ে স্কুল হয়ে গেলে সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাবার অর্থানুকুল্যে বেদনাহত আলেমরা বর্তমান ভোলা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঠিক একইভাবে চট্টগ্রামে চান মিয়া সওদাগরের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা।
আমরা আশাকরি, বর্তমান আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসা শিক্ষা সবাইকে কাঁদিয়ে সে ধরনের কোন পরিণতির শিকার হবে না। কেননা, অতীতের নিউস্কীমের করুণ পরিণতির ইতিহাস সামনে আছে বিধায় আগে থেকে সতর্ক হওয়ার একটি সুযোগ সবার সামনে আছে। তবে অভিজ্ঞ মহলের মতে আলিয়া নেসাবের মাদ্র্রাসার শিক্ষক ও অভিভাবকরা যদি উপরোল্লেখিত মৌলিক প্রশ্ন কয়টির জবাব বা সমাধান দিতে না পারেন তাহলে নিউস্কীমের চেয়েও করুণ ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হবেন। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, মাদ্রাসার দাখিল স্তরের ছাত্র আসে ইবতেদায়ী থেকে, যা সাধারণ প্রাইমারির সমান্তরাল। প্রাইমারিতে ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া হয়, কিন্তু ইবতেদায়ীর জন্য সেই বরাদ্দ নেই। কাজেই ফিডার স্তর থেকে ছাত্রশূন্যতার হাহাকার শুরু হয়েছে মাদ্রাসাসমূহে। এর সাথে যদি উপরের স্তরে ফাযিল ও কামিলে শিক্ষক শূন্যতার বাস্তবতাকে একত্রিত করা হয় তাহলে যে কেউ আতঙ্কিত না হয়ে পারবে না।
মাদ্রাসার এ অবস্থার জন্য ভাগ্যের ফায়সালাকে দোষ দেয়ার উপায় নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার হেফাযত আল্লাহ করবেন একথা বলার সুযোগও অতীতের নিউস্কীম মাদ্রাসাগুলো বাকি রাখেনি। ‘আমাদের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন না করলে আল্লাহও পরিবর্তন করবেন না’ এটিই কুরআনের শিক্ষা। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষার দরদী অভিভাবকদের জরুরি ভিত্তিতে তৎপর হতে হবে সমস্যা সমাধানের জন্যে। আমি মনে করি, দারুন নাজাত মাদ্রাসার অভিজ্ঞতা এই সংকট উত্তরণে আমাদেরকে আলোর রেখা দেখাতে পারে।
কুরআন হাদীসের জ্ঞানচর্চা, ছাত্রদের আলেমসূলভ পোশাক ও চরিত্র এবং জনগণের আস্থা অর্জনের সব সূচকেই দারুন নাজাতের সাফল্য অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। মাদ্রাসার তরুণ প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মওলানা আ খ ম আবু বকর সিদ্দীক বললেন, তার মাদ্রাসায় সরকারি সিলেবাসের সীমাবদ্ধতার ভেতরও মিশকাত শরীফের পাঠ পুরোপুরি শেষ করা হয়। আলিয়া ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষায় হাদীসের সংকলন মিশকাতের গুরুত্ব কতখানি তা কম বেশি সবাই জানেন। কাজেই পুরো মিশকাত শরীফের পাঠ শেষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি জানালেন, আমরা বুখারী শরীফও সম্পূর্ণ পাঠ দান করি। মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত যে কারো কাছে এ তথ্যটি আনন্দের ও বিস্ময়ের। এতে প্রমাণ হয়, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যদি ইচ্ছা করেন, উপায় অবশ্যই বের হয়। মাদ্রাসার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যটি ছিল, ছাত্রদের সবার লেবাস পোশাকে ধর্মীয় আবহ ও গাম্ভীর্য, একই সাথে সৌন্দর্য ও রুচিবোধ। ভর্তির সময় থেকে কড়াকড়িভাবে তদারক করা হয় তাদের আচরণ। কোন ছাত্রের লেবাস ও আচরণ সুন্নাতের বরখেলাফ হতে পারবে না। নামায ও ইবাদতে পূর্ণ যতœশীল হতে হবে। মাগরিবের নামায শেষে লক্ষ্য করলাম, ছাত্রদের যিকিরের তালিম দেয়া হল কিছুক্ষণ।
মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য এখানেই। আরবি বা ইসলামের জ্ঞান বিশ্ববিদ্যায়ে ইসলামিক স্টাডিজ ও এরাবিক ডিপার্টমেন্টেও আছে। এমনকি পাশ্চাত্যের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চর্চা আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত। কিন্তু সেখানে ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার বা তাতে অভ্যস্ত করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এখানেই ইসলামিক স্কলার ও আলেম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ও জেনারেল লাইনে ইসলামী শিক্ষার মধ্যে মৌলিক তফাৎ। নবীজীকে যে মিশন নিয়ে পাঠানো হয়েছে তাতে কিতাব ও হিকমত বা পুথিগত বিদ্যা ও প্রজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে তাযকিয়া বা নৈতিক শুদ্ধির দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। যুগে যুগে মাদ্রাসা শিক্ষা যতেœর সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছে আর এর জন্য তদারকি করেছেন আউলিয়ায়ে কেরাম। দারুন নাজাতের অধ্যক্ষ জানালেন, তারা শর্ষীনা দরবারকে অনুসরণ করেন। এই দেশে কুরআন হাদীসের শিক্ষা ও তার নৈতিক-আধ্যাত্মিক পরিচর্যা ও উন্নয়নে ফুরফুরা শরীফ ও শর্ষীনা দরবারের অবদান কালজয়ী। দারুন নাজাতের মিনি শর্ষীণাও যেভাবে ছাত্রদের ইসলামী আখলাকে দীক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে তা অন্যদের জন্য নিশ্চয়ই অনুকরণীয়।
মাদ্রাসায় যখন দ্বীনি ইলমের চর্চা হয় আর ছাত্রদের জীবনে তার প্রভাব প্রস্ফুটিত হয় তখন মাদ্রাসা শিক্ষার দরদী যে কারো মনে প্রশান্তি আসে। তখন মাদ্রাসা পরিচালনায় কোন কিছুর অভাব থাকে না। অধ্যক্ষ জানালেন যে, সরকারি বরাদ্দের বাইরে আমরা প্রচুর টাকা খরচ করি শিক্ষকদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতা খাতে। বললেন, চলতি সালে সরকারি এমপিও-এর বাইরে মাদ্রাসার নিজস্ব ফান্ড থেকে শিক্ষকদের বেতনভাতার জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক কোটি দুই লাখ টাকা। হিসাব নিকাশে স্বচ্ছতা ও সততার গুণেই যে এত টাকা আসে তার একটি রহস্য খুলে বলেছিলেন বায়তুল মুকাররামের মরহুম খতিব মওলানা উবায়দুল হক। আশির দশকের শুরুতে তিনি উপদেশ স্বরূপ আমাকে যে কথাটি বলেছিলেন তার মাধুর্য এখনো অনুভব করি। তিনি বলেন, করাচিতে মওলানা ইউসুফ বিননূরীর মাদ্রাসায় রমযানের ১৫ তারিখ বিরাট কাপড় ঝুলিয়ে ঘোষণা দেয়া হয়, ‘যাকাত লেনে কি গুনজায়েশ নেহী’। অর্থাৎ যাকাত ফান্ডে ব্যয়ের যেসব খাত রয়েছে তাতে লোকেরা স্বেচ্ছায় এনে যে পরিমাণ যাকাতের অর্থ দিয়েছে তার বেশি ব্যয় করার সুযোগ এ বছর আর হবে না। কাজেই এ বছর আর যাকাত নেয়ার সুযোগ নেই। মাদ্রাসাগুলোর আয়ের প্রধান উৎস যাকাত। তার জন্য অনেক মাদ্রাসা দোকানে বা অফিসে গিয়ে যাকাতের জন্য ধর্ণা দেয়Ñএটিই আমরা জানি। তিনি আমার কৌতুহল দেখে তিনি রহস্যের জট খুলে বললেন, বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি টাকা হলেও কোত্থেকে আয় হল আর কোন খাতে ব্যয় হল যদি তার পরিষ্কার হিসাব রাখেন আর সেই হিসাব বিবরণী জনসমক্ষে ছাপিয়ে বিতরণ করেন, তাহলে লোকেরা দেখবে যে, তার দান সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে আর সঠিক খাতে তা ব্যয় হয়েছে। তখন দেখবেন মানুষ আপনার প্রতিষ্ঠানে দান করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মনে হয় দারুন নাজাতে মওলানা আবু বকর সিদ্দীক এ ধরনের কোন রহস্যজ্ঞান নিজের আয়ত্তে রেখেছেন। যে কারণে তার হাতে এখন আলাদিনের চেরাগ। তিনি বললেন, হেফজখানা ও মহিলা শাখাসহ আমাদের ছাত্রসংখ্যা এখন ৫,০০০ এর উপর। ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে দাখিল ৮ম ও ১০ম এবং আলিমে জিপিএ ৫ পেয়েছে মোট ১১৭৯জন। বললেন, জায়গার অভাবে দুঃখভারাক্রান্ত মনে অনেককে ফেরত পাঠাতে হয়।
আমার মতে সরকারি ব্যবস্থাপনার নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মাদ্রাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে দু‘টি উদ্যোগ নেয়া দরকার। একটি হল মাদ্রাসার যেসব প্রবীণ শিক্ষক ও আলেম সরকারি নিয়মে অবসর গ্রহণ করছেন তাদেরকে অবসরের জীবন্মৃত অবস্থায় যেতে না দেয়া। অর্থাৎ তাদেরকে অনুরোধ জানানো, যাতে তারা সরকারি স্কেলের বাইরে এবং নির্ধারিত ক্লাসের পরে ফজরের পরে বা বিকেলে কিংবা রাতে আগ্রহী ছাত্রদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাব বা সাব্জেক্টভিত্তিক ক্লাস পরিচালনা করেন। তাদের জন্য নামমাত্র বেতন ভাতার খরচ বার্ষিক সভা বা বেসরকারি খাতের আয় ও অনুদান থেকে জোগান দেয়া যাবে। তাহলে মাদ্রাসায় ইলম চর্চার একটি ক্ষেত্র বহাল থাকবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস।
আমরা যখন চট্টগ্রামে চুনতি হাকিমিয়া মাদ্রাসার ফাযিলের ছাত্র তখন নাজেমে ‘আলা ছিলেন হযরত মওলানা ফযলুল্লাহ (র)। মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ব্যক্তি বলতে আমরা তাকেই জানতাম। মাদ্রাসার পুরো পরিবেশের উপর তার নজরদারির মাধুর্য জীবনের এ পর্যায়ে এসেও অনুভব করি। মাদ্রাসায় সুপারিন্টেন্ট থাকতে নাজেমে আলা বা সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপকের অর্থ কিÑ এ কথার জবার পেয়েছি বড় হওয়ার পরে। অর্থাৎ তিনি ছিলেন মাদ্রাসার নিয়মিত শিক্ষকদের অতিরিক্ত, তবে মেধা ও ব্যক্তিত্বের গুণে সবার অভিভাবক ছিলেন। এখনো মাদ্রাসাগুলো এই দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করলে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বীনি ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র রক্ষায় দারুন নাজাতের মতো সাফল্য দেখানো সম্ভব হবে। এ ধরনের সম্মানিত উস্তাদদের যেহেতু নামমাত্র বেতনভাতা দেয়া হবে এবং রাতদিন তাদের খেদমত নেয়া হবে সেহেতু নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন লবিং বা দুর্নীতির প্রশ্ন আসবে না। বস্তুত মাদ্রাসার সুপার বা অধ্যক্ষ কিংবা কমিটির সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। বুযুর্গ উস্তাদগণও তখন বাকি জীবন দ্বীনি ইলমের খেদমতে উৎসর্গ করার তৃপ্তিতে আকাশের পানে দু‘হাত তুলবেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও এর সাথে জড়িত। অর্থাৎ মাদ্রাসার নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করা। মাদ্রাসার পরিভাষায় যাকে ফুনুনাত বলা হয়। মাদ্রাসার দরদী অনেক প্রবীণ হুযুর ছাত্রদেরকে উর্দু ও ফারসি পড়াতে আগ্রহী। তারা অপরিকল্পিতভাবে নিচের ক্লাসে এগুলোর পাঠ দান করতেন। আমাদের সময়ে এ নিয়মে দুএকটি ফারসি কিতাবের দরস আমরা পেয়েছিলাম। উদ্যোগটি মহৎ হলেও অবৈজ্ঞানিক। তবে ইসলামী শিক্ষায় পারদর্শী হতে চাইলে ফারসি ও উর্দু শিখতেই হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই।
আমার প্রস্তাব হল, অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া সাপেক্ষে উপরের স্তরে বা সেন্টার পরীক্ষার পর রেজাল্টের জন্য যখন অপেক্ষা করা হয়, সে সময়টিতে ফারসি, উর্দু, আরবি বা ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা যাবে। মাদ্রাসায় সাপ্তাহিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও দেয়াল পত্রিকা কিংবা সামর্থ্য থাকলে মাসিক পত্রিকা বের করে ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এর পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। এভাবে দ্বীনি ইলম চর্চার ঐতিহ্যগত পরিবেশ গড়ে তোলা হলে দ্বীনি পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।
সেই রাতের চোখ জুড়ানো স্মৃতির মাধুরি নিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। ধ্রুবতারার সম্পাদক মুসাব্বির সালেহ এর দৃষ্টিনন্দন আয়োজনের প্রতিটি পরতে ছিল শিল্প ও সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া। মনে হয়েছে কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনায় গিয়ে নিজেই সম্বর্ধিত হয়েছি। সফরসঙ্গী অন লাইন পত্রিকা ২৪ ডট নেট-এর সম্পাদক এস এম সাখাওয়াত হোসাইন, মাদ্রাসা ছাত্রদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল কাদের, মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, বিশেষ অতিথি দৈনিক ইনবিলাবের সহকারী সম্পাদক মওলানা উবায়দুর রহমান খান নদবী, ব্যারিস্টার সিদ্দীকুর রহমান খান এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের সহযোগি অধ্যাপক ড. আহমদ আবুল কালামের উস্থিতিতে পুরো আয়োজনটি ছিল মনোমুগ্ধকর।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন