শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ভূমিকা

প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক এনায়েত আলী বিশ্বাস
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি বাঙালি মুসলমানদের একটি সাহিত্য সংগঠন। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের (১৮৯৩) অনুপ্রেরণায় কয়েকজন উদীয়মান মুসলিম লেখক ১৯১১ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতারা হলেন মুহম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ ইয়াকুব আলী চৌধুরী, মুহম্মদ মোজাম্মেল হক প্রমুখ। মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। একটি পরিচালনা পরিষদ দ্বারা সমিতি পরিচালিত হতো। ১৯১৭-১৮ সালে পরিচালক পরিষদের সভাপতি পদে ছিলেন মুহম্মদ আব্দুল করিম। সহ-সভাপতি ছিলেন খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও মুহম্মদ আকরাম খাঁ। সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ মোজাম্মেল হক এবং ২৫ জন সদস্য। বাংলা সাহিত্য চর্চা, ফারসি, উর্দু ভাষায় রচিত ধর্মশাস্ত্র ও ইতিহাসাদির অনুবাদ প্রকাশ। প্রাচীন বাংলার সাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, পীর দরবেশদের জীবনী রচনা, মুসলমান সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদান ও হিন্দু মুসলানদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন ইত্যাদি সমিতির উদ্দেশ্য ছিল। সাহিত্য সমিতি ৩২ বছরের ইতিহাসে মুসলিম জাতীয়তাবোধের বিকাশ সাধনের চেষ্টা করে। সমিতির মাসিক সভা ও বার্ষিক সম্মেলনের ব্যবস্থা ছিল। সমিতির উদ্যোগে সাতটি সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে তৃতীয় সম্মেলন চট্রগ্রামে, চতুর্থ সম্মেলন বসিরহাটে এবং বাকিগুলো কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনগুলো খুব গুরুত্ব ও আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হতো। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (বৈশাখ ১৩২৫, এপ্রিল ১৯১৮) ও সাহিত্যিক (অগ্রহায়ণ ১৩৩৩, ডিসেম্বর ১৯২৬) নামে এর দু’টি মুখপত্র ছিল। সমিতির ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৪১ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতায় রজত জুবিলী পালিত হয়। একে ফজলুল হক অধিবেশনের উদ্বোধন ও কবি নজরুল ইসলাম তাতে সভাপতিত্ব করেন।
ইংরেজের ভেদনীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এদেশের মুসলমানদের অর্থনৈতিক জীবনে চরম বিপর্যয় বহন করে এনেছিল। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠাকে হিন্দুরা কেবল প্রভু বদল বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যহারা মুসলমানদের পক্ষে আঘাতটা ছিল আরো মারাত্মক। ইংরেজ শাসকরা মুসলমানকে প্রতিপক্ষ রূপে কল্পনা করেছিলেন। তাই তাদের ধ্বংস করার ব্যাপারে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে মুসলমানের উপর আঘাতটা এসেছিল প্রবল রূপে। ফলে মুসলমান অস্তিত্ব সংরক্ষণ হয়ে পড়েছিল মুসকিল। জ্ঞান সাধনা, জ্ঞান অর্জন ছিল সে সময়ে সুদূরপরাহত। অন্যদিকে হিন্দু সমাজ বিশেষত হিন্দুবিদ্বজ্জন ম-লী ইংরেজ শাসনকে জানিয়েছিলেন স্বাগত। পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে তারা নিজেদেরকে আলোকিত করে তুলতে ছিলেন বিশেষ রূপে অভিপ্রায়ী। রাম মোহন থেকে শুরু করে বঙ্কিম চন্দ্র পর্যন্ত কারো মনোভাব ইংরেজবিরোধী ছিল না। এমনকি রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে ইংরেজদের প্রশংসা করেছেন। পরবর্তীতে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকা-ের পর তাঁর সে ধারণা পাল্টে যায়। কিন্তু তখন অনেক জল গঙ্গায় গড়িয়ে গেছে। এ কারণেই সিপাহী বিপ্লবের সময় হিন্দুবিদ্বজ্জন ম-লী ইংরেজের বিজয় কামনা করেছিলেন। তাদের মনোভাব এই ছিল যে, ইংরেজ রাজত্ব স্থায়ী হলে অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী হিন্দুসমাজের অর্থনৈতিক প্রগতি সাধিত হবে এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি সাধনা ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশের পথ প্রশস্ত হবে। এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেকালে হিন্দু চিন্তানায়ক ও বুদ্ধিজীবীদের ব্রিটিশবিরোধী কোন কর্মকা-ে সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্ভবপর ছিল না। এমনকি ব্রিটিশ যে এদেশে অর্থনৈতিক শোষণের জন্যই এসেছে, দেশের জনসাধারণের কোন মহৎ কল্যাণ সাধনের জন্যে নয়, এ উপলদ্ধি তাদের মনে তেমন জন্ম নেয়নি। এ চিন্তা এসেছে অনেক পরে। রামমোহনের চিন্তাধারা ও তাঁর ভাবাদর্শের উত্তর সাধক কাজী আব্দুল ওদুদ দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ হিসেবে রাজশক্তির সাথে সহযোগিতার কথাই ভেবেছেন। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ পরাশক্তি এদেশকে শোষণের একটি যোগ্য ক্ষেত্র হিসেবেই পেয়েছিল। স্বদেশের, স্বজাতির শ্রীবৃদ্ধি সাধনে তার লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা যতখানি নিয়োজিত হয়েছিল এদেশীয় জাতীয় জীবনের উৎকর্ষ বিধানে তার শতাংশের একাংশ নয়। এই সত্যোপলদ্ধি থেকেই মুসলিম জনম-লী ও চিন্তা নায়কেরা ব্রিটিশ পরাশক্তির উচ্ছেদে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ১৮৫৭ থেকে মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের সূচনা। কিন্তু রামমোহনের ভাবশিষ্য কাজী আব্দুল ওদুদের দৃষ্টি এবং বাণীর আবেদন জনসাধারণের কল্যাণচিন্তায় তেমন নিয়োজিত ছিল না। তিনি প্রধানত শিক্ষিত সম্প্রদায় ও বিদ্বজ্জনম-লীর মানস পরিকর্ষণা এবং তাদের চিত্তোত্থানের কথাই ভেবেছেন। হিন্দু নবজাগরণের ধারা এবং তাদের জ্ঞান, চিন্তচর্চার পটভূমি ও প্রকৃতি কাজী আব্দুল ওদুদকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ও আকৃষ্ট করেছিল। তবে তিনি হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান সত্যিকার জাতীয় জীবন গঠনে অপরিহার্য বিবেচনা করলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানের আত্মপ্রতিষ্ঠার আবশ্যকতার কথা স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করেননি। হিন্দু-মুসলমান অনৈক্য এবং বিরোধের মূলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎবর্তিতা এবং আত্ম প্রতিষ্ঠার অভাব যে বিশেষভাবে কার্যকর ছিল, এ সত্য তার চেতনায় তেমন ধরা পড়েনি। অন্যদিকে ভারতীয় মুসলমান যখনই জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন আত্মবিকাশের প্রয়াস পেয়েছে তখনই প্রতিবেশী অগ্রসর হিন্দুসমাজের পক্ষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা, এমনকি মুসলমানের স্বদেশপ্রেম এবং স্বাদেশিকতা সম্পর্কেও উত্থাপিত হয়েছে নানা প্রশ্ন। এই পটভূমিতেই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ইয়াকুব আলী চৌধুরীর ‘ভারতীয় মুসলমান ও স্বাদেশিকতা’ (সওগাত, শ্রাবণ ১৩৩৩) শীর্ষক এক নিবন্ধে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘ভারতীয় মুসলমানগণ যে জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র অধিকার লাভের চেষ্টা করিতেছে, তাহা শুধু আত্ম বিকাশের প্রেরণায়। তাহাদের এই চেষ্টা সফল হইতে দাও, তাহাদের জীবন বিকাশের পথ সরল, সহজ অবাধ করিয়া দাও, তাহারা যেমন করিয়া ছুটিতে চায় তেমন করিয়াই তাহাদিগকে ছুটিতে দাও, তাহার আর ধর্ম ভিন্ন অন্য কোন কারণে বাহিরের দিকে তাকাইবে না।’ সরকারের চাকরি ও সম্মানের ভাগ এবং যথেষ্ট পরিমাণ পদমান লাভের দাবীতেই অনগ্রসর মুসলমান সমাজ থেকে শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ চাকরি তাদের জন্য সংরক্ষণের আহ্বান জানান হয়। কিন্তু কাজী আব্দুল ওদুদ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিশারী অধ্যাপক আবুল হুসেন এ ধরনের সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র অধিকারের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
অধ্যাপক আবুল হুসেন তার সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘শতকরা পঁয়তাল্লিশ’-এ এরূপ সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র অধিকার দাবীর বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য, আবুল হুসেন সম্প্রদায় নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুসারে সরকারি সব কাজে নিয়োগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার এই মনোভাব যতখানি উদারতাপ্রসূত, আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন এবং ব্যাপক পটভূমিভিত্তিক ছিল ততখানি বাস্তব বুদ্ধিসজ্ঞাত ছিল না। কারণ ঐতিহাসিক ও সামাজিক এবং অন্যান্য কারণে যেখানে মুসলমানদের শিক্ষালাভ, জ্ঞানচর্চা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ-সুবিধা সমান ছিল না, ইংরেজদের ভেদনীতি ও বেনিয়া বুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দুদের অধিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল, সেখানে সম্প্রদায় নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুসারে সরকারী সব কাজে নিয়োগ লাভের অবস্থা ছিল দুরাশামাত্র। আবুল হুসেন জ্ঞানচর্চার মধ্যদিয়েই অধঃপতিত মুসলমানের আত্মোন্নতি এবং চিত্তোত্থান ঘটবে বলে মনে করেছিলেন। তাই অর্থনৈতিক আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেয়েও জ্ঞান আহরণের সংগ্রামে আত্মনিয়োগের জন্যই ছিল তার আহ্বান।
১৯২৮ সালে নিখিল বঙ্গীয় যুবক সম্মেলনে প্রদত্ত এক ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন ‘শিক্ষা বিস্তারের জন্য দু’টি বাধা আছে। একটি হচ্ছে, সাধারণের ভিতর লেখাপড়ার অনিচ্ছা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দরিদ্রতা। গোটা মুসলমান সমাজের দরিদ্রতা নিবারণ একটা মস্ত বড় সমস্যা।’ মুসলমান সমাজে এই দরিদ্রতা যে তার শিক্ষা, জ্ঞান সাধনা এবং সংস্কৃতি চর্চাও চিত্তপ্রকর্ষ সাধনের পথে এক প্রবল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ সত্যোপলদ্ধি কাজী আব্দুল ওদুদের রচনায় তেমন চিহ্নিত হয়নি। অথচ অধঃপতিত ও সম্মোহিত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি বদল, তাদের শ্রীহীন জীবনে সৌন্দর্য ফুটিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেওয়া ইত্যাদি ছিল আব্দুল ওদুদ, অধ্যাপক আবুল হুসেন প্রথম বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের দিশারীদের স্বপ্ন ও সাধনা। কিন্তু অর্থনৈতিক দারিদ্র্য দূর করে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে না পারলে যে শিক্ষা ও জ্ঞান সাধনা বিঘিœত হতে বাধ্য এ এক স্বীকৃত সত্য।
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জন্ম। এল লিওটার্ড ও ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তীর উদ্যোগে ১৮৯৩ সালের ২৩ জুলাই বেঙ্গল একাডেমী অব লিটারেচার নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে এর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ রাখা হয়। কলকাতার শোভা বাজারের বিনয়কৃষ্ণ দেবের বাসভবনে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমান ঠিকানা ২৪৩/১ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা। বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সাধনই ছিল পরিষদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রথম দিকে এর সব কাজই ইংরেজিতে সম্পন্ন হতো। এমনকি পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘দি বেঙ্গল একাডেমী অব লিটারেচার’-এর অধিকাংশই লিপিবদ্ধ হতো ইংরেজিতে। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য উমেশচন্দ্র বটব্যালের প্রস্তাবানুসারে ১৮৯৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিষদের সভায় মুখপত্রটি দি বেঙ্গল একাডেমী অব লিটারেচার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ উভয় নামেই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিলের সভায় পরিষদের নামটি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এরপর থেকে পরিষদের মুখপাত্রটি ‘সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা হিসেবে বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৯৪ সালে পরিষদের সভাপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। সহ-সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নবীন চন্দ্র সেন। সম্পাদক ছিলেন এল লিওটার্ড, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। বিশ শতকের দিকে এর কলেবর বৃদ্ধি পায়। এ সময় এর সদস্য সংখ্যা ৫২৩-এ উন্নীত হয়। প্রখ্যাত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীন চন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনী কান্ত গুপ্ত, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, দেবেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, অমৃত কৃষ্ণ মল্লিক, সুরেশ চন্দ্র সমাজপতি ও দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। কিন্তু এ প্রখ্যাত সদস্যদের মধ্যে কোন মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের নাম দেখা যায় না। সাধারণ সদস্যদের মধ্যেও কোন মুসলমানের নাম ছিল কিনা সে তথ্য জানা যায়নি।
তবে অনুমান করা যায় তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশে মুসলমানরা অনেকখানি পিছিয়ে থাকায় এবং ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দুদের দাপটের কাছে তারা ঘেষতে পারেনি। তাই হয়তো তারা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বাঘা বাঘা কবি সাহিত্যিকদের ধারেকাছে ঘেষতে না পেরে নিজেদের মত করে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যি সমিতির ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন। আজকের একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের দিনেও যেমন ভারতের মুসলমানরা এখনো কোণঠাসা, সেখানে ব্রিটিশ শাসনামলের সেই দিনগুলোতে আরো কতখানি কোণঠাসা ছিল ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। বস্তুত উচ্চ শিক্ষিত, চিন্তাচেতনায় প্রাগ্রসর, উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই প্রধানত চিন্তানায়ক ও সমাজকর্মীদের আবির্ভাব ঘটে। হিন্দুসমাজে যেমন, মুসলমান সমাজেও তেমনি মধ্যবিত্ত সুশিক্ষিত শ্রেণি থেকেই নবাব আব্দুল লতিফ, আমীর আলী, আব্দুর রহিম প্রমুখ মুসলমান মনীষী বাংলার অধঃপতিত কুসংস্কারাছন্ন মুসলমান সমাজে নতুন চিন্তাধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। এরা সবাই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকেও এ কথা সত্য যে, সুশিক্ষিার ব্যাপক ব্যবস্থা না হলে মনীষীর আবির্ভাবের পটভূমি ব্যাপক ও সুবিস্তৃত হতে পারে না। শিক্ষার আলোক যদি সীমাবদ্ধ পরিসরে বিস্তারিত হয় তাহলে মনীষীর আবির্ভাবের পরিধিও থাকে সংকুচিত এবং এও অনস্বীকার্য যে, শুধু মনীষীর আবির্ভাবের প্রয়োজনে নয়, তার বাণীর সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন ও গ্রহণের জন্যও সমাজে শিক্ষার আলোক সম্প্রসারিত হওয়া আবশ্যক। সৈয়দ আমীর আলী, নবাব আব্দুল লতিফ, আব্দুর রহিম প্রমুখ বাংলার মুসলমান সমাজে যে নবজাগরণের বাণী বহন করে এনেছিলেন, তার যথার্থ তাৎপর্য এ কালে যত গভীরভাবে উপলদ্ধ হচ্ছে সমকালে তা হয়নি। তার কারণ, শিক্ষার আলোক বঞ্চিত বাংলার মুসলমান সমাজে তখনও আবশ্যক ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল না। এসব মনীষীর অনুপ্রেরণায় মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও সমাজসেবীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মুসলমান জাতীয়তাবাদ উন্মেষের চেষ্টায় ব্রতী হন। তারা উপলদ্ধি করেছিলেন রাজনৈতিক, সামাজিক কারণে কবি-সাহিত্যিকদের লেখনীর বিশেষ প্রয়োজন আছে। এর কর্মকর্তারা ঘুমন্ত মুসলমান সমাজকে শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার উৎসাহ জুগিয়েছে। তাদেরই অনুপ্রেরণায় আজ মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আলো ছড়াচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন