শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা

| প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বর ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং তাদের রাখাইন ছাড়তে বাধ্য করার কথা বিশ্ববাসীর অজানা নেই। গত বৃহস্পতিবার পাঁচ দেশের রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশদভাবে উঠে এসেছে। এই পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কানাডা, ফিলিপাইন ও নরওয়ে। গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৮ হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এদিকে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো ও তাদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের চার সামরিক ও পুলিশ কমান্ডারসহ দুইটি সামরিক ইউনিটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গত শুক্রবার মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া এটিই একমাত্র কঠোর পদক্ষেপ। নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি ফর টেরোরিজম অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাইগল মানডেলকার বলেছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী জাতিগত নিধন, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ইউনিটগুলো ও এর নেতৃত্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাখাইনদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছে, তা এতদিন দেশটি অস্বীকার করে আসলেও আন্তর্জাতিক মহল থেকে আগাগোড়াই তার সত্যতার কথা বলা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস আক্রমণ বন্ধ ও তাদের নাগরিকত্বসহ নিরাপদ আবাসন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়াদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহল বারবার অনুরোধ করলেও মিয়ানমার তা উপেক্ষা করেছে। বরং নিপীড়ন, নির্যাতন ও বিতাড়ন অব্যাহত রেখেছে। এমনকি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটিকে পর্যন্ত রাখাইনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে দেয়া হয়নি। অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক মহলের কোনো আহ্বানেই সাড়া দেয়নি। সব ধরনের হুমকি থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে ক্রমাগত চাপ আসতে থাকলে তারা কিছুটা নমনীয় হয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় বসতে রাজী হয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য চুক্তি করে। চুক্তির শুরুতে গত বছরের শেষের দিকে প্রাথমিকভাবে প্রায় আট হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার দিনক্ষণও ঠিক করা হয়। তবে মিয়ানমার নানা টালবাহানা করে এ চুক্তি লঙ্ঘন করে। ফলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি ঝুলে পড়ে। উল্টো রোহিঙ্গাদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্মম হত্যা, ধর্ষণ ও বিতাড়ন নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তীব্র নিন্দা ও তা বন্ধের আহ্বান জানালেও দেশটি তাতে সাড়া দেয়নি। অন্যদিকে আশ্রয় নেয়া প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণ এবং আবাসস্থল নির্মাণে বাংলাদেশকে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কক্সবাজার ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে আসেন। তারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ পর্যন্তই বিষয়টি থেমে থাকে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নিরাপদে বসবাস করার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ওপর একটি কার্যকর চাপ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমরা চাই না কোনো দেশের ওপর প্রভাবশালী দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হোক। এতে নিষেধাজ্ঞা কবলিত দেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। আমরা চাই, রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান। আমরা বরাবরই বলে আসছি, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে চীন। বলা যায়, চীনের কার্যকর উদ্যোগে সমস্যাটির সমাধান দ্রুততায়িত হতে পারে। চীন বলেছে, তারা এ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান চায়। চীনের এই শুভ ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ ও তৎপর হতে হবে। চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এ বন্ধুত্বকে কাজে লাগাতে সরকারের উচিত চীনকে কনভিন্স করে সমস্যার সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। কারণ আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বছরের পর বছর ভরণ-পোষণ করা আমাদের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব। আমাদের দেশেও প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে চাপছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের চাপ অর্থনীতিকে আরও নাজুক করে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দ্রুতায়িত হওয়া দরকার। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র একটি উদ্যোগ নিয়েছে, তাই বাংলাদেশকে অন্য প্রভাবশালী দেশ বিশেষ করে চীনের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এগিয়ে নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন