ঢাকা থেকে প্রকাশিত ১ আগস্ট ২০১৮ তারিখ বুধবারের ‘যুগান্তর’-এর অষ্টম পৃষ্ঠায় একটা খবরে দেখছি, ৩০ জুলাই ২০১৮ তারিখ সোমবার ভারতের আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণের যে দ্বিতীয় ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই রাজ্যটির ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জন নাগরিকের নাম নেই। ‘আসামের দেখাদেখি নাগরিক তালিকা আরও দুই রাজ্যে’ এই শিরোনামে ‘যুগান্তর’-এর এই অষ্টম পৃষ্ঠায় পরিবেশিত খবরে আছে ‘সরকার মুসলিম শরণার্থীদের টার্গেট করেই এ তালিকা করেছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।’ এই খবরেই আছে ‘ভারতের আসাম রাজ্যের দেখাদেখি’ মধ্যপ্রদেশ ও ঝাড়খন্ড, এই দুটো রাজ্যও ‘নাগরিক তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে’। দৈনিক কাগজ ‘যুগান্তর’-এর এই একই শিরোনামে প্রকাশিত খবরে আছে, ৩১ জুলাই ২০১৮ তারিখ মঙ্গলবার দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের কনফারেন্সে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আসামের নাগরিক পুঞ্জিকরণ ইস্যু দিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধ ও রক্ষপাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার।’ লক্ষণীয় যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কথাটা অত্যন্ত সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে। তাদের সমাজের জাতীয়বাদী মহলকে তিনি নিশ্চিয়ই খুব ভালো করেই চেনেন এবং জানেন। তার এ রকম মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকেই তাকে শ্রদ্ধা করেন।
দুই.
এ বিষয়ে প্রকাশিত খবর এবং ভারতের বড় সম্প্রদায় ও সমাজের সাংবাদিকদের যেসব লেখা পড়েছি তাতে এটা বুঝেছি যে, মিয়ানমারের মুসলমানদের মতো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুসলমানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের অধিকার বঞ্চিত করে যয়ীফ করে ফেলে একটা সময়ে, যখন প্রয়োজন হবে তখন এ দেশে ঠেলে পাঠানো হবে কেবল মুসলমানদের। অন্য কোনো ধর্মীয় সমাজের মানুষদের নয়। কেননা, হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্তে¡র প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে, বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে শনাক্ত হয়ে আছে কেবল মুসলমানরাই। বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতা সমাজের জাতীয়তাবাদী মহলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো মুসলিম প্রধান দেশ থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টানদের কেউ হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমাজপ্রধান স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে গেলে তাকে দেখা হবে শরণার্থী হিসেবে। আর মুসলমান কেউ গেলে তাকে দেখা হবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন তা খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি যে, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে কল্পনা করে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে তিনি চলতে চাচ্ছেন না। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলে সেখানে হিন্দু সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা আরোপ করে একজাতিতত্ত্ব কায়েম করার আকাক্সক্ষাও তার নেই বলেই আমি মনে করি। তিনি যে রাজ্যে যেভাবে যে দায়িত্ব নিয়ে আছেন তাতে এটাই স্বাভাবিক।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে। উচ্চ শিক্ষিত এবং সচেতন। তিনি তাদের সমাজের জাতীয়তাবাদী মহলকে জানেন। এ বিষয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অত্যন্ত আন্তরিক। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশ দুটোর সরকারপ্রধানদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যে, তারা যেন এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তত কথা বলেন। দুই সমাজের তরফে দু’পক্ষেরই দায়িত্ব আলাপ-আলোচনা করে মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দুঃখ-দুর্দশার হাত থেকে রেহাই দেয়া।
তিন.
মুসলিম শাসনামলে মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় সমাজের মানুষদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকার খর্ব করেননি। মুসলিম শাসনামলে অনেক রাজপুরুষই ছিলেন হিন্দু। ১৭৫৭-এর ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ-যুদ্ধ প্রহসন পূর্ববর্তীকালে বিভিন্ন সুবাহ্র সুবাহ্দাররা স্বাধীন নবাব এবং স্বাধীন সুলতান হয়েছিলেন মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে।
ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজভাষী খ্রিস্টান বণিকদের জাতীয়তাবাদী মহল ১৭৫৭-এর ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ-যুদ্ধ প্রহসনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা নিয়েছিলেন ভাগ করো এবং শাসন ক্ষমতায় আরোহণ করো নীতিতে। এরপর তারা শোষণ ও শাসন করেছেন ভাগ করো এবং শাসন করো নীতিতে। এই উভয় ক্ষেত্রে সহযোগী সমাজ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজকে অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণশাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজকে। এই সহযোগী সমাজকে তারা সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সব দিক দিয়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, যে মুসলমানদের কাছ থেকে তারা ক্ষমতা নিয়েছিলেন সেই মুসলমানদের তারা প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে দেখে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকারবঞ্চিত করে হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত একটা সমাজহীন সমাজে পরিণত করে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করেছিলেন।
মুসলমানদের এই অধঃপতিত অবস্থায় দেখে হিন্দুরা মুসলমানদের ঘৃণা করতে এবং অচ্ছুৎ ভাবতে শিখেছে এবং চিরদিনের জন্য মুসলমানদের অধিকারবঞ্চিত করে রাখার জন্য মুসলমানদের প্রতিপক্ষ দেগে দিয়ে এবং শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে, বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছে। ধর্মভিত্তিক হোক, বর্ণ বা গায়ের রঙভিত্তিক হোক, ভাষাভিত্তিক হোক, কিংবা অঞ্চলভিত্তিক হোক, যে কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ইতিহাস বিকৃত করার বা কাল্পনিক ইতিহাস সৃষ্টি করার প্রয়োজন পড়ে। হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করানোর জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল মুসলিম শাসনামলের ইতিহাস বিকৃতির অর্থাৎ মুসলিম শাসনামল সম্পর্কে কাল্পনিক ও মিথ্যা ইতিহাস সৃষ্টির। এ কাজে খ্রিস্টানদের জাতীয়তাবাদী মহল তাদের পথ দেখিয়েছে ও সহযোগিতা করেছে এবং কাল্পনিক ইতিহাস বানিয়েও দিয়েছেন।
মুসলিম শাসনামলের এসব কাল্পনিক ইতিহাস অবলম্বন করে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে দেগে দিয়ে বা শনাক্ত করে কেবল যে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ মজবুত করা হয়েছে তা-ই নয়, মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলে সেখানে হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা আরোপ করার অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত্ব কায়েম করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের সমস্যা প্রসঙ্গে এটা সবসময় স্মরণ রাখা দরকার।
চার.
এই হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত্ব কায়েম করার আকাক্সক্ষা ব্যাপক, বিশাল এবং গভীরভাবে বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুদের ইতিহাসবিষয়ক লেখায়, কবিতায়, সাংবাদিকতায়, কাহিনী-কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে, ছোটগল্পে রূপায়িত হয়ে এই উভয় বিষয়ে ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে একটা হিন্দু গণমন তৈরি করে দিয়েছে। এর পর এই হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের রাজনীতিতে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের রাজনীতিতে মহারাষ্ট্রের গুপ্ত সমিতি (১৮৯৪), মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাঙলার অনুশীলন সমিতি (১৯০২) ও যুগান্তর দল (১৯০২) ও এরকম অন্যান্য আধা সামরিক সংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে এবং ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে দামোদর বিনায়ক আভারকার প্রতিষ্ঠিত আধা সামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠন ‘অভিনব ভারত’ এর মাধ্যমে। এসব আধা সামরিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠনের সভ্যদের এক অংশ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভায় ঢুকেছে, এক অংশ ১৯২০-এর দশকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)-এ ঢুকেছে, ১৯২০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ১৯৩০-এর দশকে ঢুকেছে এক অংশ ১৯৩৯-এ প্রতিষ্ঠিত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকে ঢুকেছে এক অংশ এবং আর একটা অংশ ১৯৪০-এ গঠন করেছে রেভুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি (আরএসপি)। এসব তারিখ তথ্যের কথা জানতে হবে এবং স্মরণ রাখতে হবে।
অনুশীলন সমিতির সভ্য ও ভারতের জাতীয় কংগেসের সদস্য, কলকতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের বিজয়া দশমীর দিন নাগপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন আধা সামরিক-সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, ধর্ম রক্ষা সমিতি, দুর্গা বাহিনী, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, বিদ্যা ভারতী, রাম সেনা, ভারতীয় মজদুর সংঘ, হিন্দু সেনা, ধর্ম সেনা, আরোগ্য ভারতী, হিন্দু যুব বাহিনী, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ, হনুমান সেনা, রাজপুত কর্মী সেনা, হিন্দু একতা মঞ্চ, ইউনাইটেড হিন্দু ফ্রন্ট এ রকম অসংখ্য শাখা সংগঠন আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙঘ (আরএসএস)-এর মাতৃসংগঠন ‘অনুশীলেন সমিতি’ (১৯০২)-সহ মহারাষ্ট্রের ‘গুপ্ত সমিতি’ (১৮৯৪), মুসলিম প্রধান বাঙলার ‘যুগান্তর দল’ (১৯০২)-সহ বিভিন্ন আধা সামরিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠন এবং আবার মহারাষ্ট্রেই ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে দামোদর বিনায়ক সাভারকর প্রতিষ্ঠিত ‘অভিনব ভারত’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঋষি বঙ্গিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের আদর্শে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)-এর পৃষ্ঠপোষকতায়। ইসলাম ও মুসলিমমুক্ত এক হিন্দু ধর্মের এবং এক হিন্দু জাতির দেশ হিসেবে হিন্দু তামাম ভারতীয় উপমহাদেশকে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এবং এর শাখা সংগঠনগুলোও প্রসার ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসেরই বুকের তলায়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) কাজ করেছে স্রেফ একটা আধা সামরিক-সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে। বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার জাতীয়তাবাদী মহলের সমাজের তরফে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সহযোগী হিসেবে ১৯৩৭-এর এবং ১৯৪৬-এর মুসলিম নিধনযজ্ঞে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল আরএসএস সভ্যরা। ‘অভিনব ভারত’ (১৯৩৪)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৩৭ থেকে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার নেতা দামোদর বিনায়ক সাভারকর-এর পরামর্শে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি তারিখে নাথুরাম গড়সে এবং নারায়ণ আপ্টে মধ্য দিল্লির বিড়লা হাউজে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে হত্যা করেছিল (১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্ট পরবর্তীকালের) মুসলিম গণহত্যার এবং মুসলিম উৎখাত অভিযানের আপত্তি জানানোর অভিযোগে। খোদ পন্ডিত জত্তহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সরকারের আমলে নাথুরাম গডসেকে এবং নারায়ণ আপ্টেকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হলেও এই বিচারে প্ররোচণা দেয়ার দায়ে ‘অভিনব ভারত’ (১৯০৪)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার নেতা দামোদর বিনায়ক সাভারকর-এর কোনো সাজা হয়নি। কারণটা হলো এই যে, সমাজহীন মুসলমান সমাজের যেমন অবস্থান মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের নিচে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের আইন বিভাগের এবং বিচার বিভাগের ও শাসন বিভাগের নিচে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমাজপ্রধান রাষ্ট্রের অবস্থানটা সে রকম নয়। হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র হিন্দু সমাজপ্রধান রাষ্ট্র। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমাজের নিচে হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রের আইন বিভাগের, বিচার বিভাগের এবং শাসন বিভাগের অবস্থান।
পাঁচ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সংঘচালক (সর্বাধিনায়ক) মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের অনুরোধে আরএসএস প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পর অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদভানী, দীন দয়াল উপাধ্যয়, নানাজি দেশমুখ, সুন্দরসিং ভান্ডারী প্রমুখ ‘স্বয়ং সেবক’দের নিয়ে হিন্দু মহাসভার সাবেক নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতীয় জনসংঘ। ভারতীয় লোকদল, সংগঠন কংগ্রেস, সমাজবাদী দল এবং ভারতীয় জনসংঘ মিলে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয়েছিল জনতা পার্টি। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে জনতা পার্টি ভেঙে গেলে ভারতীয় জনসংঘ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক শাখা সংগঠন হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টি এই নতুন নাম ধারণ করে।
ছয়
আরএসএসের মাতৃসংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’ (১৯০২)। অনুশীলন সমিতি থেকেই ‘যুগান্তর দল’ (১৯০২) এবং এরকম আরো অনেক আধা সামরিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র¿ সংগঠন তৈরি হয়েছে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৫ ডিসেম্বর ১৮৮২) উপন্যাসের সন্তান দলের আদর্শে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলে সে জায়গায় হিন্দু সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা আরোপ করে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে।
প্রসঙ্গত এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, হিন্দু সমাজের জাতীয়তাবাদী মহল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে এখনো একটা আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকার না করার একতরফা শর্ত আঁকড়ে ধরে আছে বলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কোনোরকমের কোনো অধিকার এখনো স্বীকার করে না। এই চিন্তাধারা অনুসারে ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো মুসলিমপ্রধান দেশকেও ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্ট থেকেই স্থায়ীভাবে স্বীকার করে না। জাতীয়তাবাদী ভারত রাষ্ট্র ঠিক সেই লক্ষ্যেই সব কিছু করে আসছে।
১ আগস্ট ২০১৮ তারিখ বুধবারের দৈনিক কাগজ ‘যুগান্তর’ এর অষ্টম পৃষ্ঠায় ‘আসামের দেখাদেখি নাগরিক তালিকা আরও দুই রাজ্যে’ শিরোনামে পূর্বোল্লিখিত প্রতিবেদনে দ্বিতীয় স্তবকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজ্যটির মোট ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জন নাগরিক তালিকায় নেই। অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রহীন।
১ আগস্ট ২০১৮ তারিখ বুধবারের দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ১৩ পৃষ্ঠায় ‘কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আছে যে, ৩১ আগস্ট ২০১৮ মঙ্গলবার ‘সুপ্রিম কোর্ট’ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, খসড়া তালিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। যাঁদের নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের আপত্তি বা দাবি-দাওয়া মেটাতে একটা স্বচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ‘বিচারপতি রঞ্জন গগৈই ও বিচারপতি আরএফ নরিম্যান এই নির্দেশ জারি করে বলেন, (২০১৮’র) ১৬ আগস্টের মধ্যে সেই স্বচ্ছ পদ্ধতির বিষয়টি আদালতকে জানাতে হবে।’
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, পাদ্রি, জৈন প্রভৃতি যে সব সমাজে থাকে সে সব সমাজে সবাই জাতীয়তাবাদী হয় না। জাতীয়তাবাদী স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে শান্তি ও মানবাধিকারকর্মী, লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, গবেষক হার্শ মেন্ডারের মতো মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ অনেক মহৎ মানুষ আছেন। ৯ আগস্ট ২০১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার ঢাকার দৈনিক কাগজ ‘যুগান্তর’-এর পঞ্চম পৃষ্ঠার ‘আসামের বিদেশিদের দুর্ভোগ শোনার এখনই সময়’ শিরোনামে তাঁর একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লেখা ছাপা হয়েছে। ‘বাংলাদেশি’ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করে গত ৯ বছর যাবৎ ইতোমধ্যেই সেখানে অনেক মুসলমানকে ছয়টি ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রেখে মানবেতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে কেবলমাত্র মৃত্যুর দিন গুণতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্ত্রীকে তাঁর স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। ছয় বছরের বেশি বয়সের শিশুদের অন্য আরেক জায়গায় রাখা হচ্ছে। কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগ করার এবং কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। অন্য কারো সঙ্গেও নয়। এই সব ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে আন্তর্জাতিক আইন প্রাথমিক মানবাধিকার এমনকি ভারতীয় সংবিধান ইত্যাদি কিছুই মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত খবর দেখে উপলব্ধি করা যায় যে, সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অজস্র মুসলমানকে ‘বাংলাদেশী’ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করে এভাবে আরো বহু ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রেখে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশকে ইসলাম ও মুসলিম মুক্ত করা হবে। মুসলমানরা যে ভারতের নাগরিক সেটা প্রমাণের দায় মুসলমানদের ওপরই চাপানো হয়েছে ২০০৫ থেকে। সব কিছু লক্ষ্য করে স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায় যে, এটা হিন্দুধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুধর্মীয় একজাতিতত্ত্ব প্রসূত সমস্যা এই সমস্যাটাকে গুরুত্ব দেয়ার মতো শিক্ষা আমরা আমাদের সমাজ থেকে যেমন পাইনি, তেমনি পাইনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন