শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট তুরস্ক

খলকু কামাল | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

সামরিক সক্ষমতায় মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের ভ‚মিকার কারণে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা দিন দিন দেশটির শত্রু হয়ে ওঠেছে। সেই শত্রুতার জের ধরে তুরস্ক ও এরদোগানের বিরোধিতাও প্রবল হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট তুরস্কের সামরিক বাহিনীর বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অ্যাডমিরাল সনার পোলাত বলেছেন, তুরস্ক ইসরাইলের পরবর্তী টার্গেট হতে যাচ্ছে। সিরিয়ায় ইসরাইলের অগ্রগতি মানে তুরস্কের কাছাকাছি চলে আসা। সিরিয়ায় পিকেকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সিরিয়া ও তুরস্কের বিজয় ফিলিস্তিনি এবং জেরুসালেমকে অবশ্যই প্রভাবিত করছে। এ জন্য তুরস্ক ইসরাইলের চূড়ান্ত টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল যেভাবে তার সামরিক কৌশল ঠিক করছে, আঞ্চলিক স্থাপনাগুলো যেভাবে সাজাচ্ছে তাতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, সে তুরস্ককে টার্গেট করেছে।
তুরস্কের কাছে লোকহেড মার্টিন এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান বিক্রি বন্ধ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য মার্কিন সিনেট কমিটি দেশটির বিদ্যমান একটি আইনে সংশোধনী বিল পাস করেছে। এই বিল পাসের ক্ষেত্রে গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার কাছ থেকে ভ‚মি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এস-৪০০ মিসাইল ক্রয়ে তুরস্কের স্বাক্ষরিত চুক্তিও প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছেন ডেমোক্র্যাট সিনেটর জেন শাহিন। সিনেটর শাহিন বলেছেন, এই চুক্তি মার্কিন আইনে নিষেধাজ্ঞার যোগ্য। রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা একটি জাতির কাছে সংবেদনশীল এফ-৩৫ বিমান ও স্পর্শকাতর প্রযুক্তি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে প্রচন্ড দ্বিধা রয়েছে। ওই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছে এই ধরনের বিমানগুলোকে ভ‚পাতিত করার জন্য।
স¤প্রতি বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি বিরোধ দেখা গেছে সিরিয়ায় মার্কিন সমর্থিত কুর্দিবিরোধী তুরস্কের সামরিক অভিযান নিয়ে। এছাড়াও রয়েছে দুই দেশের অভ্যন্তরে পরস্পরের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনগত মামলা। পেনসিলভেনিয়ায় থাকা তুর্কি নাগরিক ফাতুল্লাহ গুলেনকে নিয়েও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। এরদোগান ব্রানসনের বিনিময়ে গুলেনকে ফেরত চাইলে তা বাতিল করে দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।
সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার ব্যাপারে তুরস্ককে বাধা দিচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না। রাশিয়া থেকে উন্নত মানের এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার জন্য ন্যাটো জোটের সদস্য তুরস্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে অপরাধটা কী? আঙ্কারার বিরুদ্ধে এ ধরনের চাপ সৃষ্টি করা অন্যায়। এরদোগানকে এ ধরনের চাপ দিয়ে সুফল পাওয়া কঠিন। উল্টো এমন চাপ তাকে এস-৪০০ কেনার ব্যাপারে আরো উৎসাহিত করবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তিনি কোনো আপোস করবেন না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বলেছেন, এস-৪০০ কেনা থেকে তুরস্ককে বিরত রাখতে ওয়াশিংটন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এ ধরনের ব্যবস্থা ন্যাটোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তুরস্কের কাছে লোকহেড মার্টিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের বিরোধিতার মধ্যেও সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে তুরস্ক। জনশক্তি, যুদ্ধাস্ত্র, প্রযুক্তি-প্রশিক্ষণ ও সামরিক ব্যয়সহ বিভিন্ন দিক থেকে তুর্কি সামরিক বাহিনী বিশ্বের সেরা বাহিনীগুলোর একটি। ১৯৫২ সাল থেকেই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। বর্তমানে দেশটির সামরিক বাজেট ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। তুরস্ক সামরিক শক্তিতে বিশ্বে ৮ম, ন্যাটো জোটে ৪র্থ, এশিয়ায় ৪র্থ, মধ্যপ্রাচ্যে ১ম ও মুসলিম বিশ্বে ১ম। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এরদোগান তুর্কি সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। আর বাহিনীর কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনা করেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ বা সশস্ত্র বাহিনী প্রধান। তুর্কি সামরিক বাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজার। রিজার্ভ সদস্য রয়েছে আরো ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০ জন। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার। সব মিলে দেশটির বর্তমান সামরিক জনশক্তি ৭ লাখেরও বেশি। অ্যাকটিভ ফ্রন্টলাইন পার্সোনেল ৩ লাখ ৫০ হাজার, অ্যাকটিভ রিজার্ভ পার্সোনেল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৫। স্থলবাহিনীতে ট্যাংক আছে ৩৪৪৬টি, আর্মড ফাইটিং ভেহিক্যালস ৯০৩১টি, সেলফ প্রপেলড গানস ১০১৮টি, টাওয়ার্ড আর্টিলারি ৮৭২টি, মাল্টিপল-লঞ্চ রকেট সিস্টেম ৪১৮টি। বিমান বাহিনীতে আছে টোটাল এয়ারক্রাফট ১০৫৬টি, ফাইটার্স ২০৭টি, ফিক্সড-উইং অ্যাটাক এয়ারক্রাফট ২০৭টি, ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট ৪৪৫টি, ট্রেইনার এয়ারক্রাফট ২৮৭টি, হেলিকপ্টার্স ৪৭৫টি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার্স ৫৪টি। নৌবাহিনীতে রয়েছে-নেভাল স্ট্রেন্থস ১৯৪টি, ফ্রিগেইটস ১৬টি, কর্ভেটেস ১৩টি, সাবমেরিন ১২টি, কোস্টাল ডিফেন্স ক্রাফট ৩৪টি ও মাইন ওয়্যারফেয়ার ১১টি। বিমান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬০ হাজার, নৌ বাহিনীর সদস্য ৪৮ হাজার। তুরস্ক তার নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে করব্যাড রণতৈরি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও বেটল ট্যাংক নির্মাণ করছে। ২০২৩ সালের ভেতর পাইলটবিহীন যুদ্ধ বিমান তৈরি করবে।
সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী নিয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠিত। জেন্ডারমেরি ও কোস্টগার্ডরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করলেও যুদ্ধের সময় এরা সামরিক কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে, যথাক্রমে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ড অনুসরণ করে। দেশটির সেনাপ্রধানকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে দেশটির মন্ত্রিপরিষদ পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ। কোনো যুদ্ধ ঘোষণা, বিদেশে সৈন্য প্রেরণ কিংবা দেশের ভেতরে বিদেশি সৈন্যদের ঘাঁটি স্থাপন প্রত্যেকটি বিষয়েই পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগে।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী হচ্ছে ৪র্থ বৃহত্তম। ন্যাটোভুক্ত যে পাঁচটি দেশ যৌথ পরমাণু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তুরস্ক তার অন্যতম সদস্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিশনে তুর্কি বাহিনী কাজ করছে। জাতিসঙ্ঘ ও ন্যাটোর অধীনেই তারা বিভিন্ন মিশনে অংশ নিচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর অধীনে তুর্কি বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে সোমালিয়ায় কাজ করছে। এছাড়া সাবেক যুগো¯øাভিয়ায় শান্তি মিশনে ও প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাথে সহায়তা করেছে। বর্তমানে তুর্কি স্বীকৃত সাইপ্রাসে ৩৬ হাজার তুর্কি সেনা দায়িত্ব পালন করছে এবং ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাথে ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানেও দায়িত্ব পালন করছে তুর্কি সেনারা। ইসরাইল-লেবানন সংঘাত এড়াতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় ২০০৬ সালে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তুরস্ক কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ ও ৭০০ সৈন্য মোতায়েন করে।
লেখক : নিউ ইয়র্ক প্রবাসী, গবেষক ও সমাজসেবক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মামুন ২০ আগস্ট, ২০১৮, ৩:৪৪ এএম says : 0
মুসলিম বিশ্বকে সাথে নিয়ে তুরস্ককে এগিয়ে যেতে হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন